মিয়াজাকির মতো আমারও প্লেন সম্পকে আগ্রহ অনেক দিনের ।যখন ইন্টারনেট হাতে পায় তখন এরোপ্লেন সম্পকে আমার আগ্রহকে খোরাক দি ,নাহলে তার আগে কিছু বাংলা-ইংরেজি বিশ্বকোষ ছিলো ভরসা ।ইন্টারনেট আসার পর মিয়াজাকির সিনেমা জগত সম্পকেও পরিচিত হয়,দেখি পোরকো রোসো , আড্রিয়াটিকের নীল ফেনিল জল আর ততোধিক নীল আকাশ মাতাচ্ছে একটা লাল স্যাভোয়া এস-21, একটা কুরটিস আর থ্রি সি জিরো আর একটা অজানা ডাবোহায এবং আরও আরও নাম না জানা সীপ্লেন আর তাদের পাইলটরা ।
এই লেখাতে পোরকো ,মিস্টার কুরটিস এবং সি পাইরেটদের প্লেন গুলোর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগে আমাদের উচিত কিছু পরিভাষার সঙ্গে পরিচিত হওয়া যা এভিয়েশন জগতে প্রচণ্ড প্রচলিত ।
1. ফিউজিলাজ:-
ডানা বা উইং ছাড়া বিমানের মূল কাঠামো ।
2. ফিক্সড উইং এয়ারক্রাফট:-
পৃথিবীতে সব ধরনকে এরোপ্লেনই হচ্ছে ফিক্সড উইং এয়ারক্রাফট । সব সব ফিক্সড উইংএয়ারক্রাফটের উইং বা ডানা আছে । এই প্লেনের ডানা ,প্লেনের সামনে দিয়ে আসা বাতাসের সাহায্যে,প্লেনকে উপরে তোলে ।এছাড়া ফিক্সড উইং এয়ারক্রাফটের উদাহরণ হতে পারে ঘুড়ি, গ্লাইডার,ভেরিয়েবল স্যুঈপ উইং এয়ারক্রাফট বা পরিবর্তনশীল ডানাওয়ালা বিমান ।এই স্যুঈপ উইং এয়ারক্রাফট নিজের ডানাকে মূল বিমানের কাঠামো বা ফিউজিলাজের সমান্তরালে ছড়িয়ে দিতে পারে অথবা গুটিয়ে নিতে পারে । এই ধরনের বিমানের সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ হলো আমেরিকা বিমানবহরে আধুনা রিটায়ার্ড গ্রুম্যান এফ-14 টমক্যাট,যা টম ক্রুজের “টপগান” সিনেমার জন্য মোটামুটি সবার কাছে পরিচিত । এছাড়া ইউরোপের পানাভা টর্নেডো ,সোভিয়েত(এবং বর্তমানের রাশিয়ার) বিমান বহরের মিগ -23,মিগ-27 ইত্যাদি যুদ্ধবিমান ।
3. মনোপ্লেন এবং বাইপ্লেন :-
সব ফিক্সড উইং এয়ারক্রাফটের মূল ডানা আছে, কিন্তু তা একটা হতে পারে অথবা দুটো (কিংবা কিছু পুরনো ডিজাইনে ততোধিক) হতে পারে । মনোপ্লেন হচ্ছে সেই ধরনের প্লেন যার একটি মূল ডানা আছে ,যা প্লেনের মূল কাঠামো বা ফিউজিলাজের দুদিক বরাবর অবস্থান করে । যে প্লেনের ডানা মূল কাঠামো বা ফিউজিলাজের উপরের দিক বরাবর থাকে তাকে হাই উইং প্লেন ,মূল কাঠামোর মধ্য বরাবর থাকলে মিড উইং প্লেন আর নিচের দিকে থাকলে তাকে লো উইং প্লেন বলে ।
বাইপ্লেন এর মূল ডানা দুটো । একটা থাকে মূল কাঠামোর নিচের দিকে আর একটা উপরের দিকে ।উপরের মানে অনেকটা উপরে, মূল কাঠামো বা ফিউজিলাজ ছাড়িয়ে বাইপ্লেন বিখ্যাত হয়েছিল কুড়ি আর ত্রিশের দশকে, এখন কিছু যাত্রী পরিবহনকারী প্লেন বা সীপ্লেন হচ্ছে বাইপ্লেন শ্রেনির ,নাহলে এখন মোনোপ্লেনের রাজত্ব ।
4. সীপ্লেন বা সমুদ্রবিমান :-
আমরা সবাই জানি এই ধরনের প্লেনগুলো জল থেকে উড়তে(টেকিং অফ) এবং নামতে (ল্যান্ডিং)
এ সক্ষম। সীপ্লেন বা সমুদ্র বিমানকে দুভাগে ভাগ করা যায় , ফ্লোটপ্লেন আর ফ্লাইং বোট ।
5. ফ্লোটপ্লেন :-
যে ধরনের সীপ্লেনের ফিউজিলাজের নিচে ফ্লোট নামে একধরনের বায়ুর থেকে হালকা ফাঁপা কাঠামো থাকে( মূলত একাধিক) তাকে ফ্লোটপ্লেন বলে । এই ফ্লোট হতে পারে কিছু নির্দিষ্ট ফাঁপা বস্তু, মূলত প্লেনকে জলের উপর ভাসিয়ে রাখার জন্য এবং উড়তে পারা বা টেক অফ করার জন্য কাজে লাগে ।
এই ধরনের প্লেনগুলো জলে এবং স্থলে নামতে পারে,সেজন্য এগুলোকে উভচর বিমান বা এমফিবিয়াস এয়ারক্রাফটও বলে।
6. ফ্লাইং বোট:-
ফ্লাইং বোট হচ্ছে এমন এক ধরনের সী প্লেন ,যার ফিসজিলাজ বা মূল কাঠামোটা জলে ভাসে ,কাঠামোর দুপাশে বড় বড় ডানা থেকে ঝোলানো “হূল” (hull) এর সাহায্যে ।এই হূলের আক্ষরিক অর্থ হলো “জাহাজের কাঠামো”। মূলত যেকোনো ফ্লাইং বোট বা সীপ্লেনে ব্যাবহার করা হূলগুলো জাহাজের কাঠামো আকৃতিই হয় ।ল্যান্ডিং এর সময় মূল কাঠামোর সঙ্গে হূলও জলে ভাসে ।
এবার পোরকো রোসো সিনেমাতে ব্যাবহার করা প্লেনগুলোর দিকে চোখ বোলানো যাক ।
1. স্যাভোয়া এস -21:-
সিনেমার মূল হিরো পোরকোর লাল রঙের প্লেনটা হচ্ছে স্যাভোয়া এস-21। পোরকো যখন ইতালীয়ান এয়ার ফোর্স ছেড়ে আসে তখন এই প্লেনটাকে ফোর্স থেকে কিনে নেয় ।তার অনেক প্রিয় এই লাল রঙের প্লেনটার ইঞ্জিন হচ্ছে রোলস রয়েস ক্রেসট্রল (ক্রেসট্রল হচ্ছে বাজ জাতীয় এক ধরনের শিকারি পাখি,সেই থেকে নাম)।বারো সিলিন্ডারের আর সাতশো কুড়ি হর্স পাওয়ারের মোটর যুক্ত এই লাল “এড্রিয়াটিকের রানি”র সর্বোচ্চ গতিবেগ তিনশো কুড়িকিলোমিটার প্রতি ঘন্টা ।অস্ত্র হচ্ছে দুটো এমজি 08 টাইপের মেশিনগান ,যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান এবং তার মিত্র সেনারা ব্যাবহার করত ।পোরকোর প্লেনের পেছনে যে R চিহ্নটা আছে সেটা রোসো আর রিপাবলিক ,এই দুটোর প্রতীক ।পোরকো ফ্যাসিবাদ ঘৃণা করত ।
এই শ্রেণীর প্লেন বাস্তবে সত্যিই ছিলো ,এবং মাত্র একটাই তৈরি করা হয়েছিলো ।রেসের জন্য বানানো এই প্লেনটাকে কনট্রোল করা ছিলো খুবই মুশকিল ।তো,প্রজেক্ট বাতিল ।
দুটোই ফ্লাইং বোট হলেও মিয়াজাকি পোরকোর স্যাভোয়া এস-21তে কিছু পরিবর্তন আনে,যা আসল স্যাভোয়া এস-21 থেকে আলাদা ।পোরকোর এস-21 টা মোনোপ্লেন আর আসলটা ছিলো বাইপ্লেন ।
2. কুরটিস আর থ্রি সি জিরো:-
ডোনাল্ড কুরটিস, যার সঙ্গে সিনেমার শেষের দিকে পোরকোর রেস এবং ডগফাইট হয়,তার প্লেনটা ছিলো আর থ্রি সি জিরো সিরিজের । বারোটা টা সিলিন্ডার যুক্ত ছশো দশ হর্স পাওয়ারের মোটর সর্বোচ্চ তিনশো আটচল্লিশ কিলোমিটার প্রতিঘন্টা বেগে যেতে পারতো ।এর অস্ত্র হচ্ছে দুটো এম টু ব্রওনিং মেসিনগান,যা আমেরিকাতে তৈরি ।
পোরকোর প্লেনের মতোই ,এই শ্রেণীর প্লেনও সত্যি ছিলো,যা 1925 সালে আমেরিকায় তৈরি হয় ,মূলত রেসিং এর জন্য ।তৈরি করে “কুরটিস এরোপ্লেন এন্ড মোটর কোম্পানি”, যার প্রতিষ্ঠতা গ্লেন হ্যামনড কুরটিস, আমেরিকার এরোপ্লেন জগতের অন্যতম পায়োনিয়ার ।
3. ডাবোহায (যে) :-
এটা সিনেমার সী পাইরেটদের ফ্লাইং বোট ,যা একটা মোনো প্লেন।এর বডি স্টিলের তৈরি, যেখানে স্যাভোয়া এস -21 আর কুরটিস আর থ্রি সি জিরোর বডি কাঠের তৈরি ।দুটো রোলস রয়েস ঈগল ফোর ইঞ্জিন,বারোটা সিলিন্ডার যুক্ত তিনশো ষাঠ হর্স পাওয়ারের ক্ষমতা দিয়ে সর্বোচ্চ একশ তিরানববই কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা গতিবেগ দিতে পারে ।
এটি একটি কাল্পনিক প্লেন, সম্ভবত মিয়াজাকির মস্তিকপ্রসূত।