ফুজিওকা শহর থেকে একটু দূরে ,যখন ভোরের সাদা কুয়াশাগুলো সবুজ শস্যক্ষেতের উপর গাঢ় হয়ে ভাসতে ,কাছেই একটা বাড়িতে,এক কিশোরের স্বপ্ন আর বাস্তবের সীমারেখা ধংস হয়ে যায় ।গাঢ় সাদা কুয়াশার সমুদ্রের মধ্যে বনেদি জাপানি বাড়িটা একটা বিচ্ছিন্ন ভাসমান দ্বীপের মতো লাগে ,যার বিশাল ত্রিকোনাকার ছাদের একপ্রান্তে ছেলেটাকে চড়তে দেখি ,চোখে একটা এভিয়েসন গ্লাস।সে ছাদের একপ্রান্তে একটা কাঠের এরোপ্লেনে চড়ে বসে ।প্লেনটা বেমানান, ছোট ইঞ্জিন,ডানাদুটো বাঁকানো ,শেষ প্রান্তে আবার পাখির পালকের মতো কারুকার্য করা ।ছেলেটা ইঞ্জিনটা চালু করে,প্লেনের প্রোপেলার ঘোরে ।দূরে সূর্যের প্রথম লাল আলো পড়া হলুদ -সবুজ পাহাড়গুলো ঘুরন্ত প্রপেলারের মধ্যে দেখলে মনে হবে একটা গলন্ত সুন্দর লাল – হলুদ কিছু পদার্থ ।প্লেনটা পাখির মতো ডানা ছাড়ে, আর ছেলেটা প্লেনের সঙ্গে ওড়ে ।সূর্যের প্রথম লাল -হলুদ আলো ,আর নীচের সবুজ উপত্যকা ,শস্যক্ষেত ।প্লেনটা যত এগোয় ,সেই শস্যক্ষেত থেকে অন্ধকার দ্রুত পেছনে সড়ে যেতে থাকে ।যেন প্লেনটা একটা বাজপাখি আর অন্ধার কোন ভীতু ইঁদুর ।নীচের ছোট-বড় নদী,সবুজ নদীদ্বীপ ছাড়িয়ে প্লেনটা এসে পৌছয় ফুজিওকা শহরের মধ্যে ,যেখানে কাঠের সাঁকো, রেল লাইন,মেয়েদের বোডিং হাউস পেরিয়ে দেখতে পায় কালো সারসের মতো অসংখ্য ছোট বেলুন শহরে ঢুকছে ,যার মধ্যে অদ্ভুতদর্শন কালো কাপড় পড়া মানুষ দাঁড়িয়ে ,বেলুনগুলো আবার একটা বিশাল কালো বেলুন থেকে ঝুলছে ।ছেলেটা সেগুলোকে বিপদ মনে করে লড়তে যায় ,পারেনা ,ছোট প্লেনটা ভেঙে যায়,তার এভিয়েসন গ্লাস ভেঙে পড়ে যায়,সেও পড়তে থাকে এবং একসময় তার স্বপ্ন ভেঙে যায় ।ছেলেটা জীরো হোরিকোশি ,আর দৃশ্যটা হায়াও মিয়াজাকির শেষ মাস্টারপিস উইন্ড রাইজেসের প্রথম স্বপ্নদৃশ্য ।তার সিনেমাগুলোকে প্রায়ই সিনেমার ম্যাজিক রিয়ালিজম জঁরের অন্যতম সেরা সাক্ষর মনে করা হয়,উইন্ড রাইজেসও এর বাইরে নয় ,এই সিনেমাতে বারবার স্বপ্ন আর বাস্তবের সীমানাটাকে মুছে ফেলা হয়েছে ।যেমন এর পরের স্বপ্নদৃশ্য,কায়ো,জীরোর ছোট বোন যখন জীরোর সঙ্গে বাড়ির ছাদে গাঢ় নীল রাত্রিআকাশে উল্কাবৃষ্টি দেখছিলো ,তখন জীরোর চোখ চলে যায় ইতালির রঙিন আকাশে ,একগাদা কাপ্রোনি কা 31 প্লেন ,যার পাখার রঙ ইতালির পতাকার মতো লাল-সাদা-সবুজে রাঙানো ,হয়ত কোনও যুদ্ধে যাচ্ছিল , আমরা পরে জানতে পারি এর ডিজাইনার জিয়োভাননি কাপ্রোনির মুখে ,ঐ প্লেনগুলো কেউ ফিরে আসবে না।পরের দৃশ্যে দেখব একটা শহরের ছবি ,যার গোটাটা প্লেনগুলোর বোমের লাল আগুনের শিখাতে গিলে ফেলেছে,প্লেনগুলোও বাঁচতে পারছে না ।এখানেই জীরো অনুপ্রেরনা পায় কাপ্রোনির কাছে ,পাইলট নয়,প্লেনের ডিজাইনার হওয়ায় উচিত তার লক্ষ ।আর অবশ্যই , “প্লেন কোনো যুদ্ধের যন্ত্র নয়,সেগুলো কোন টাকা কামাবার জিনিস নয়।এয়ারপ্লেন হচ্ছে সুন্দর স্বপ্ন,যার ইঞ্জিনগুলো স্বপ্নকে বাস্তবে পরিনত করে”।
পাঁচ বছর পর,জীরো নিজের স্বপ্নগুলোকে সত্যি দেখার জন্য ট্রেনে করে যাচ্ছে টোকিওতে,এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং শিখতে টোকিও ইউনিভার্সিটিতে ।ট্রেনে দেখা হয় নায়োকোর সঙ্গে।দুজনেই ইটালিয়ান ভাষা জানে ।
Le vent se leve
Il faut tenter de vivere.
(The wind is rising ,we must try to live)

এই আসার পথেই জীরো পরিচিত হয় প্রকৃতির ধংসের মুখের দিকে ,1923 সালের টোকিওর ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প, মিয়াজাকি তার সিনেমাতে ভূমিকম্পকে এক ভয়ঙ্কর সুন্দর মাত্রায় দেখিয়েছেন ।ভূমিকম্প যেন এক জীবন্ত সরীসৃপ, বিশাল বড় নিশ্বাস ফেলে স্থলভাগের দিকে ধেয়ে আসছে ,তারপর এক বিশাল শব্দ, মাটির উপর দিয়ে যেন এক বিশাল বড় ঢেউ খেলে গেল,টোকিওর বাড়িগুলো,রেলপথ আর ট্রেনটাও ও সেই ঢেউএর তালে নেচে উঠল ।দানবীয় শব্দের সঙ্গে মিয়াজাকি আমাদের পরিচয় করিেছেন ভূমিকম্প পরবর্তী বিশাল অগ্নিকান্ডের,টোকিওর রাস্তায় লক্ষ জনার ভীড়,বিশাল লাল-কালো মাশরুমের মতো আগুনের ধোঁয়া ঢেকে ফেলেছে টোকিওর আকাশ ।নায়োকোর আয়াকে বাঁচানোর পর জীরো দেখে তার বিশ্ববিদ্যালয় জ্বলে গেছে,তার বন্ধু কিরো হোনজো আরও কিছু বন্ধুদের নিয়ে কিছু বই আর গবেষনা পত্র বাঁচাতে সক্ষম হয়েছে ।উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে আগুনে পোড়া কাগজ,কাঠের দরজা,পোড়া গাছের ছোট ডাল ।টোকিও শেষ ।প্রায়।
“কে জানে,সেখানে হয়ত কোনও আগুনের সমুদ্র ছিলো”
1927 সালে জীরো আর কিরো গ্রাজুয়েট হয় টোকিও ইউনিভার্সিটি থেকে ,তারপর তারা মিৎসুবিসি কোম্পানির হয়ে ফ্যালকন নামে একটা ফাইটারের ডিজাইনের উপর কাজ করতে থাকে ,যেটা পরে পরিত্যক্ত হয় ।এরমধ্যে তারা দুজনা জার্মানি যায়,সেই সঙ্গে উপলব্ধি করে যুদ্ধখাতে ব্যায় বারানোর জন্য কী দারিদ্র্যের মধ্যে যাচ্ছে জাপান ।জীরো সবসময় কাপ্রোনির কথা মনে রাখতো ,যে তাকে অনেক স্বপ্নদৃশ্য এ দেখা দিয়েছে,” এই পৃথিবীটা আরো ভালো হয়ে উঠতে পারে ,সুন্দর প্লেনের সাহায্যে”।
সিনেমার শেষ স্বপ্নদৃশ্য খুব সুন্দর, একগাদা মিৎসুবিসি এ ফাইভ সিক্সের ধংসাবশেষ পেরিয়ে জীরো এগিয়ে যাচ্ছে একটা নীল আকাশ আর সবুজ ঘাসের উঁচু প্রান্তে ,যেখানে কাপ্রোনি দাঁড়িয়ে আছে কথা বলার জন্য ।কথার ফাঁকে দেখতে পারি কিছু এ ফাইভ সিক্স উড়ে যাচ্ছে নীল আকাশে ,ফরিঙের মতো ,কিংবা অসংখ্য কাগজের প্লেনের মতো ।নীচে একটা ছাতা নিয়ে নায়োকো আসছে ।
উইন্ড রাইজেসের প্লেনগুলি:-
ক্যাপ্রোনি কা 1 বা ক্যাপ্রোনি কা 31:-
জীরোর দ্বিতীয় স্বপ্ন দৃশ্যে যে বাইপ্লেনগুলো আমরা দেখতে পায়,সেগুলো সম্ভবত ক্যাপ্রোনি কা 31 সিরিজের ।এগুলো আসলে বোমারু বিমান ,দিনের বেলায় শত্রু দেশে বোম ফেলার জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নাগাদ তৈরি হয় ।মোট 162 থেকে 166 টা তৈরি করা হয়েছিলো।এর প্রথম প্রটোটাইপের নাম ছিলো ক্যাপ্রোনি কা ওয়ান,যেটা প্রথম উড়ানেই ক্রাশ খেয়েছিলো ।প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইতালির হারের পর কিছু এই সিরিজের বিমান যাত্রী পরিবহনে ব্যাবহার হতো ।মোট ছয় থেকে চারজন যাত্রী ধরতো এখানে ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এগুলো অস্ট্রিয়া -হাঙ্গেরি, লিবিয়া এবং ফ্রান্সে বোমাবর্ষণের কাজে ব্যাবহার করেছিলো ইতালি ।
ফ্যালকন প্রোটোটাইপ:-
সিনেমাতে দেখি জীরো হোরিকোশি আর কিরো হৌনজো ,দুজনেই একটা এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার বেসড প্লেন তৈরি করার চেষ্টা করে ,মিৎসুবিসির হয়ে,জাপানি নেভির জন্য ।সেই প্রজেক্টটার নাম ফ্যালকন, মাত্র দুটো তৈরি হয়েছিলো ।আর এটাই ছিলো জাপানের প্রথম ক্যারিয়ার বেসড এয়ার ক্রাফট তৈরির উদ্যোগ ।এই প্লেনটা নেভির দ্বারা প্রতাখ্যাত হয়,তার বদলে জাপানি নেভি বেছে নেয় নাকাজিমা এ ওয়ান এন ।যেটা 1935 অবধি জাপানিজ নেভির সঙ্গে ছিলো ।মোট একশ একান্নটা তৈরি করা হয় ।
মিৎসুবিসি এ ফাইভ এম :-
জীরো হোরিকোশির অন্যতম পিয়েটা,যে প্লেনকে দেখে সিনেমাতে তার বন্ধু কিরো বলেছিলো একটা “আঁভা গার্দ” ডিজাইন ।আমেরিকার মিত্রপক্ষ এর নাম দিয়েছিলো ক্লাউড ।
1934 সালে যখন জাপানের নেভি একটি এমন এক ডিজাইন চাইলো দুই কোম্পানি, মিৎসুবিসি আর নাকাজিমার কাছে যেটা 350 কিলোমিটার প্রতিঘন্টা গতিবেগ নিয়ে উড়তে পারবে,আর 6.5 মিনিটে পাঁচ হাজার মিটার উচ্চতায় উঠতে পারবে ।আগের 1927 সালের প্রতিযোগিতায় নাকাজিমা জেতে ,মিৎসুবিসির ফ্যালকনকে হারিয়ে ।কিন্তু এবার জেতে মিৎসুবিসি ।
মোট দশটা ভারসন ছিলো,প্রথম প্রটোটাইপের ডানা অনেকটাই বাঁকানো ছিলো ।এ ফাইভ এম ফোর ভারসনের সবচেয়ে বেশি 440 কিলোমিটার প্রতিঘন্টা গতিবেগে যেতে পারতো আর 1200 কিমি এর রেনজ ছিলো ।
মিৎসুবিসি এ সিক্স এম জিরো :-
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ডগফাইটে যে আমেরিকার মিত্রপক্ষের শিরঁদাড়া কাঁপিয়ে দিয়েছিলো ,সেটা নেভির টাইপ জিরো ক্যারিয়ার ফাইটার ওরফে মিৎসুবিসি এ সিক্স এম জাপানিজ জিরো ।মোট দশ হাজারের উপর বানানো হয়েছিলো ।
জাপানিজ নেভি চাইছিল এমন এক ফাইটার, যেটা সাড়ে তিন মিনিটে তিন হাজার মিটার যেতে পারে এবং “600 কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা” সবচেয়ে বেশি গতিবেগ হয় ।
প্রচণ্ড হালকা করা হয়েছিলো একে,যাতে শত্রুপক্ষের প্লেনকে ডগফাইটে নাস্তানাবুদ করতে পারতো সহজে ।অথবা দ্রুত দুটো ষাঠ কেজির বোম শত্রু পক্ষের ঘাঁটির উপর ফেলে চলে আসতে পারতো ।
কিন্তু এই অতিরিক্ত হালকা করার জন্য কিছু অনেক জিনিজ বাদ দিতে হয়েছিলো ।আর সেটাই হয় জিরোর দুর্বলতা ।
1942 এর 4 টা জুন,আমেরিকার ডাচ হারবারের উপর হামলা চালানোর সময় একটা জিরো তেলের অভাবে ল্যান্ডিং করে ,ডাচ হারবারের কুড়ি মাইল দূরে ।পিছলে গিয়ে ল্যান্ডিং টা ক্রাশ ল্যান্ডিং এ পরিনত হয়,পাইলট মাথার আঘাতে মারা যায় আর আমেরিকা প্রশান্ত মহাসাগরের উপর তার অন্যতম ত্রাসের অপারেশনের সুযোগ পায় ।ভালোভাবে যাচাই করার পর দেখে ওজন কমানোর জন্য জিরোর পাইলট , ইঞ্জিন বা অন্য ক্রিটিক্যাল পয়েন্টের চারপাশে কোন বর্ম দেওয়া নেই,যেটা সেযুগের প্লেন এবং পাইলটের অন্যতম রক্ষাকবচ ।
মিৎসুবিসি জিথ্রিএম :-
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের অন্যতম সেরা বোমারু বিমান তথা পরিবহন বিমান ।এটা ডিজাইন করেছিলো জীরোর বন্ধু কিরো হৌনজো। হাজারের উপরে তৈরি করা হয় এই বোমারু বিমান ।সিক্স এম জিরোর মতো,এটাও ওজন কমানোর জন্য বেশি বর্ম (আর্মর ) দেওয়া হয়নি ।সাতজন লোক এবং আটশ কেজি বোম অথবা একটা এরিয়াল টর্পেডো নিয়ে পাড়ি দিতে পারতো চার হাজার চারশ কিলোমিটার দুরত্ব ।পার্ল হারবারের উপর আক্রমণের সময় এটার অবদান অনেক ।
ক্যাপ্রোনি কা ফোর :-
অনেকগুলো(মূলত তিনটে) মূল ডানা যুক্ত বাইপ্লেন সিনেমাতে দেখা যায়। এগুলো ক্যাপ্রোনি কা ফোর সিরিজের প্লেন, মূলত বোমারু অথবা যাত্রীবাহী এরোপ্লেন হিসাবে তৈরি করার কথা ভেবেছিলেন ডিজাইনার জিয়োভাননি ক্যাপ্রোনি ।এর যাত্রীবাহী মডেল ক্যাপ্রোনি কা 48 ,প্রথম উড়ানেই ক্রাশ করে,ইটালির ভেরনা নামক জায়গায়, চোদ্দ থেকে সতেরো জন মারা যায় ।এটা ইতালির প্রথম বিমান দুর্ঘটনা ,সিনেমাতে এই ঘটনার একটা রেফারেন্স সম্ভবত আছে ।
সব শেষে-
ক্যাপ্রোনি কা 309 জিবলি :-
সম্ভবত মিয়াজাকির সবচেয়ে প্রিয় প্লেন, যার নামানুসারে নিজের (অথবা নিজেদের) কোম্পানির নামকরণ করেন ।
