অ্যানিমের ইতিহাস ২ – ১.৯৯ তম পর্বঃ এ স্পেস অডিসি

ষাটের দশকে Astroboy প্রথম অ্যানিমে হিসেবে টেলিভিশনে প্রচার হওয়ার পর অনেকটাকাল সাই-ফাই আর ফ্যান্টাসী অ্যানিমে ছোটপর্দা শাসন করেছে। অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা সম্পন্ন অথবা আদর্শবান সব মূল চরিত্র। ভালো আর খারাপের স্পষ্ট ব্যাবধান থাকা গল্প। অ্যানিমে ছিল বিনোদনের এক ভিন্নধর্মী মাধ্যম যা উপভোগ করতে পারতো পরিবারের সবাই।

যার ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালে শুরু হল “ওয়ার্ল্ড মাস্টারপিস থিয়েটার”। Dororo, Moomin’, Anderson Monogatari, Rocky Chuck অথবা তাকাহাতার Heidi – প্রথমে Zuiyo Eizo আর পরে Nippon TV তে প্রতি রবিবার সন্ধ্যা ৭ঃ৩০ বরাদ্ধ ছিল Mushi Production এর অ্যানিমেশনে তৈরি বিশ্বের জনপ্রিয় সব ধ্রুপদী গল্পের জন্য।

সত্তরের শুরুতে আরো একটা জিনিস যা জনপ্রিয়তা পাওয়া শুরু করল তা হল, স্পোর্টস অ্যানিমে। TIger Mask, Kyojin no Hoshi-’র পর, ১৯৭০ সালে ওসামু দেজাকির পরিচালনায় শুরু হল Ashita no Joe. ইকি কাজিওয়ারার মাঙ্গা অবলম্বনে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত চলা ৭৯ পর্বের প্রথম মৌসুমে ছিল জো ইয়াবুকির শুন্য থেকে শীর্ষে ওঠার এক অনবদ্য কাহিনী। কিন্তু অ্যানিমের পরবর্তী বিশাল জাগরনটা আরো তিন বছর পরের।

১৯৭৩ সালে প্রযোজক ইয়োশিনোবু নিশিজাকি প্রথম সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী এক অ্যানিমের পরিকল্পনা শুরু করেন। যার গল্প হবে গতানুগতিক অ্যানিমে থেকে তুলনামূলক জটিল আর পরিণত। প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী এই অ্যানিমের হওয়ার কথা ছিল “Lord of the Flies”-এর আন্তঃমহাকাশীয় পূনর্বণনা। যাতে পৃথিবী রক্ষার এক অন্তীম মহাকাশীয় যাত্রায় সঙ্গী হবে বিভিন্ন দেশের ছোট ছোট বাচ্চারা। কিন্তু পরবর্তীতে মাঙ্গাকা লেইজি মাৎসুমোতো এই প্রকল্পে যোগদান করায় প্রাথমিক গল্পের প্লট আমূল বদলে গেল ১৯৭৪ এ প্রচার শুরু হওয়া অ্যানিমেতে।

“ ২১৯৯ সাল। পৃথিবী দূর মহাকাশের অ্যালিয়েন জাতি “গামিলাস”-দের আক্রমনের শিকার। পৃথিবীপৃষ্ট বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাওয়া এখন মানবজাতি আবাস গেড়েছে ভূতলে, কিন্তু সেখানেও ক্রমশ বিকিরনের কারণে তাদের সমাপ্তী ক্ষনীয়ে আসছে। এমন সময় সাহায্যের হাত বাড়ালো ইস্কান্দার গ্রহের রাণী স্টারশা। পথ বাতলে দিলো পরিত্রানের। মানবজাতিকে মোকাবেলা করতে হবে গ্রহে গ্রহে ওঁত পেতে থাকা শত্রুর আক্রমন, পাড়ি দিতে হবে হাজার হাজার আলোকবর্ষ, আর সময়-কালের বাধা; পৌছতে হবে বৃহৎ ম্যাজেলানিক মেঘ-এর কাছে থাকা ইস্কান্দার গ্রহে। যেখানে অতিবুদ্ধিমান ইস্কান্দারিয়ানদের কাছে আছে গ্রহ পূনর্জীবিত করার ক্ষমতা থাকা – কসমো ডিএনএ। “

ডার্ক, ইমোশোনালি ড্রামাটিক, কাহিনীপ্রবাহে ধারাবাহিক;বাস্তব-ত্রুটিপূর্ণ, মোরালি অ্যাম্বিগিউয়াস চরিত্রের আনসাম্বল – জায়ান্ট রোবট, সুপার রোবট আর সুপার হিউম্যান থেকে বের হয়ে এসে Space Battleship Yamato সাই-ফাই অ্যানিমে জগতে প্রথম এক নতুন ধারার সূচনা করলো – স্পেস অপেরা। ইয়ামাতো পেল তুমুল জনপ্রিয়তা। এবং তা শুধু জাপানেই না।

১৯৭৭ এ বের হওয়া Star Wars-এর রেষ কাটতে না কাটতেই ১৯৭৯ সালে ইয়ামাতো আমেরিকায় প্রচার শুরু হল “Star Blazers” নামে। ইউরোপীয়ান আর লাতিন দেশগুলোও পিছিয়ে ছিলো না। ইতালীতে একই নামে, গ্রীসে “Spaceship Argo”, স্পেন আর লাতিন আমেরিকায় “Starship Intrepid” আর ব্রাজিলে “Star Petrol” নামে প্রচার হওয়া ইয়ামাতো অ্যানিমের জনপ্রিয়তা নিয়ে গেল বিশ্বব্যাপী, নতুন এক প্রজন্মের কাছে।

প্রথম প্রচারিত ২৬ পর্বের সিজনের পর সিকুয়াল হিসেবে বের হয়েছে আরো দুটি সিজন এবং চারটি মুভি। আর এর পর তৈরি করার চেষ্টা হয়েছে আরো কয়েকটি রিবুট। প্রথম প্রচারের তিন দশক পরও ইয়ামাতোর জনপ্রিয়তার রেশ কমেনি একটুও। ২০১২ প্রথম ২৬ পর্বের মূল গল্পের পূনর্বর্ণনা হয়ে ইয়ামাতো ফিরে এসেছে, Space Battleship Yamato 2199 নামে।

শুধু অ্যানিমের জনপ্রিয়তা বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত করায় ইয়ামাতো্র অবদান সীমাবদ্ধ ছিল না, অ্যানিমে ইন্ড্রাস্ট্রিতে এক বিশাল পরিবর্তনের সূচনা এর মাধ্যমেই। ইয়ামাতোই প্রথম অ্যানিমে বা মুভি যা জাপানের Seiun Award জয়লাভ করেছিল। Gundam, Macross, Legend of the Galactic Heroes, Space Runaway Ideon কিংবা একই মাঙ্গাকার Galaxy Exoress 999 Space Pirate Harlock-এর মত স্পেস অ্যাডভেঞ্চার আর স্পেস অপেরা অ্যানিমে ‘৭০ আর ‘৮০ জুড়ে জাপানের টিভি শাসন করেছে। যে পথটা বাতলে দিয়েছিল ইয়ামাতোই।

Gundam আর Macross-এর আগে, Harlock আর Legend of the Galactic Heroes-এর আগে, Star Wars আর Battlestar Galactica-’র আগে ইয়ামাতো সাই-ফাই ভক্তদের জন্য দিয়ে গেছে মহাকাশে মহাকাব্যিক এক যাত্রার গল্প। আর ইয়ামাতো দেখে বড় হওয়া, অনুপ্রানিত হওয়া এক প্রজন্ম আর কয়েক দশক পর অ্যানিমের হাল ধরেছে নিজেরাই। যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নামটা সম্ভবত আনো হিদেয়াকি।

11169559_959241624107655_3981340516219597846_o

 

অ্যানিমের ইতিহাস (অথবা অমরত্বের অপ্রত্যাশিত বর্ত্ম) – ১.৯৮৯ তম পর্বঃ আমরা কী নিয়ে কথা বলি, যখন আমরা কথা বলি ওসামু তেজুকাকে নিয়ে

শিন তাকারাজিমার সাফল্যের পর তেজুকা পেশাদার মাঙ্গাকা হওয়ার পথে পা বাড়ালেন।
১৯৪৯ সালে তেজুকা লিখলেন এক সাই-ফাই, গোয়েন্দা গল্প। Metropolis. যা পরবর্তীতে হয়েছে ২০০১ সালের একই নামের অ্যানিমে ফিল্ম এর অনুপ্রেরণা।

পরবর্তী বছর বেরোল তার অন্যতম জনপ্রিয় কাজ, Jungle Emperor. আমেরিকায় যা Kimba The White Lion নামে পরিচিত। এটাই ছিল তেজুকার সর্বপ্রথম “সিরিয়ালাইজড” মাঙ্গা। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৪, চার বছরে এই মাঙ্গার বের হয়েছিল তিনটি ভলিয়্যুম। কিম্বা হয়ে উঠল আইকনিক এক চরিত্র।

১৯৫১ সালে তেজুকা লিখলেন Captain ATOM. এই মাঙ্গাতেই প্রথম আবির্ভাব ঘটে তেতসুয়ান অ্যাটমের। পরবর্তী বছর তিনি লিখলেন এর সিক্যুয়েল, Tetsuwan Atom. তেতসুয়ান অ্যাটমের সাফল্য ছাড়িয়ে গেল তাঁর আগের সব কাজকে। যেকোন মাঙ্গার আগের সব সাফল্যকে। অনেকটা হঠাৎ করেই মাঙ্গা হয়ে ঊঠল যেন জনসাধারনের গ্রহনযোগ্য একটি বিনোদনের মাধ্যম। ছোটবড় সবাই অপেক্ষা করত সপ্তাহের সেই দিনের জন্য যখন নতুন চ্যাপ্টার মুক্তি পাবে। এই সাফল্যের জোয়াড়ে চড়েই তেতসুয়ান অ্যাটম প্রকাশিত হয়েছে টানা ১৬ বছর ধরে।

প্রায় একই সময়, ১৯৫৩ সালে প্রথম প্রকাশ হওয়া শুরু হয় তেজুকার আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ, Princess Knight. তাকারাজুকা গীতিনাট্যের কথা মনে আছে? যেখানে নারী-পুরুষ সব চরিত্রে অভিনয় করত মহিলারা? মেয়েদের ছেলের মত পোশাক পড়া, রাজকন্যা আর রাজপুত্রের গল্প, প্রিন্সেস নাইট হল সর্বপ্রথম শৌজো মাঙ্গার। প্রিন্সেস নাইটে তেজুকা বললেন এক “জেন্ডার বেন্ড”
প্রোটাগনিস্ট প্রিন্সেস স্যাফায়ারের গল্প, যার দেহে ছিল একই সাথে দুটো আত্নার সহাবস্থান, একটি ছেলে এবং একটি মেয়ের। যার প্রভাব লক্ষনীয় তার অনুগামী জনপ্রিয় শৌজো মাঙ্গায়, অ্যানিমেতে।

সময় যত যেয়েছে তেজুকার চোখ বড় বড় চরিত্রের, “কার্টুনীয়”, সাধারণ বিনোদনের গল্প গুলো হয়েছে আরো গভীরতা পূর্ণ, কখনো ডার্ক, আর তাঁর আঁকা হয়েছে আরো বাস্তবিক।
১৯৫৬ সালে তেজুকা আঁকা শুরু করলেন, তাঁর নিজের মতে যা তাঁর সেরা এবং সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী কাজ, Hi no Tori(Phoenix). নিজের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যা তেজুকা লিখে গেছেন এবং তা এখনো অসম্পুর্ণ। ফিনিক্সের গল্প; স্থান-কালের এক অনবদ্য যাত্রা, ভিন্ন যুগ আর ভিন্ন পরিবেশে, ভিন্ন সব মানুষের গল্প; যাদের যোগ সূত্র অমরত্ব লাভের আকাঙ্ক্ষা।

তেজুকার আরেকটি সমালোচকদের দ্বারা প্রশংসিত কাজ হল, Buddha. বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্টাতা গৌতম বুদ্ধের জীবনি, যাতে অবশ্যই ছিল তেজুকার নিজস্ব ছোঁয়া। ২০০৪-২০০৫, টানা দুই বছর বুদ্ধ জিতেছে আইসনার অ্যাওয়ার্ডস, আন্তর্জাতিক বিভাগে।
ড.ওসামু তেজুকা তার চিকিৎসা বিদ্যার জ্ঞান কাজে লাগালেন তার পরবর্তী কাজে। Black Jack, এক প্রতিভাবান শল্য চিকিৎসকের গল্প। ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত টানা দশ বছর ব্ল্যাক জ্যাক প্রকাশিত হয়েছে।
আশির দশকের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ, Adolf. ত্রিশের দশকের জার্মানীর তিন অ্যাডলফের গল্প; যাদের একজন এক সাধারণ জার্মান, একজন ইহুদী আর একজন স্বয়ং স্বৈরশাসক!

তেজুকা কাজ করতেন সপ্তাহে ৫ দিন, তার নিজস্ব এক অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে;যেখানে ঢুকতে পারত কেবল তার স্ত্রী। এমনকি তার এডিটরও না। বছরে মাত্র গড়ে ৬০ দিন থাকতেন নিজের বাসায়, পরিবারে সাথে। তিনিই শুরু করেন মাঙ্গাকাদের অ্যাসিটেন্ট রাখার প্রচলন, যা একই সাথে যেমন সাপ্তাহিক সিরিয়ালাইজেশনের কাজ সহজ করে দিলো, তেমনি উদীয়মান মাঙ্গাকাদের পেশাদার কাছ থেকে শেখার সু্যোগ করে দিলো। যা আজো অনুসরন করা হয়।

১৯৮৯ সালে পাকস্থলীর ক্যান্সারে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত ওসামু তেজুকা লিখেছেন ৭০০ ভলিয়্যুম আর প্রায় দেড় লাখ পৃষ্ঠার মাঙ্গা! ১৯৮৫ তে তার ৪০ বছরের মাঙ্গাকা জীবন উপলক্ষে এনএইচকে তে প্রচারিত এক ডকুমেন্টারিতে তিনি বলেছিলেন তিনি লিখে যেতে চান আরো চল্লিশ বছর। কারণ তার এখনো অনেক, অনেক গল্প বলা বাকি। ওসামু তেজুকা আরো চল্লিশ বছর বাঁচেন নি, ফিনিক্সের অমরত্বের গল্পও শেষ করে যেতে পারেননি, কিন্তু তার মাত্র ৬১ বছরের জীবনে তিনি মাঙ্গার ইতিহাসকে যতটা বদলে দিয়েছেন, তাতে কি তিনি নিজে অমরত্ব নিশ্চিত করে যাননি?

“Foreign visitors to Japan often find it difficult to understand why Japanese people like comics so much. One explanation for the popularity of comics in Japan is that Japan had Osamu Tezuka, whereas other nations did not.”

10959489_913106612054490_6674192471629459510_n

 

অ্যানিমের ইতিহাস যোকু শৌ – ১.৯৪৮ তম পর্বঃ ওসামুশি(-শি)

“You should work doing the thing you like most of all.”

২০ বছর বয়সে যখন ওসামু তেজুকা জীবনের এক সন্ধিক্ষনে পৌছলেন, চিকিৎসক না মাঙ্গাকা, কোন নেশাটাকে পেশা হিসেবে নিবেন তা নিয়ে দোদুল্যমান, তখন এটাই ছিল তাঁর মায়ের উপদেশ। দুই পেশার প্রতিই তার ভালোবাসা আর সম্মান ছিল। যদিও সামাজিকভাবে মাঙ্গাকা হওয়া সেসময় যেমন খুব একটা সম্মানের পেশা ছিল না, আর সম্মানীটাও ছিল সেরকমই কম। কিন্তু যদি আসলেও পারিবারিক চাপে তুলনামূলক ভালো আর্থিক ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মাঙ্গাকা হওয়ার স্বপ্ন বিসর্জন দিতেন, তাহলে ভাবুন তো মাঙ্গার ইতিহাসটা কতটা বদলে যেত?
অ্যানিমের ইতিহাস?
জাপানের ইতিহাস, তাদের পুরো সংস্কৃতিও কি না?

তিন সন্তানের সবচেয়ে বড়, ওসামু তেজুকার জন্ম ৩ নভেম্বর, ১৯২৮; ওসাকা প্রিফেকচারের তোয়োনাকা শহরে। কিন্তু তাঁর বেড়ে ওঠা হিয়োগো প্রিফেকচারের তাকারাযুকা শহরে। ছোট ওসামু তেজুকার ভালোবাসার বিষয় ছিল তিনটি।

পোকা সংগ্রহ।
থিয়েটার। তার মায়ের সাথে তাকারাযুকা থিয়েটারে তাকারাযুকা গিতীমঞ্চনাটক দেখতে যাওয়া। তাকারাযুকা থিয়েটারের মঞ্ছস্থ হত রোমান্টিক সব গল্প, রাজকন্যা আর রাজপুত্রের গল্প। কিন্তু মজার বিষয় এর অভিনেত্রী-“অভিনেতা” সবাই ছিলেন মেয়ে। এমনকি পুরুষ চরিত্রেগুলোতেও।
আর বাসায় তার বাবার সংগ্রহের কমিকস আর কার্টুন। তেজুকার আগ্রহী চোখ নিবিদ্ধ থাকতো ওয়াল্ট ডিজনী আর ম্যাক্স ফ্লাইসার(পপাই, বেটি বুপ, সুপারম্যান) এর অনবদ্য অ্যানিমেশনে। তার দুই অনুপ্রেরণা।
জ্বলজ্বল করা বড় বড় সব চোখের চরিত্রের কার্টুন।
বাম্বি, মিকি মাউস, পপাই।

তেজুকা কমিকস দ্বারা এতটাই মুগ্ধ হলেন যে এলিমেন্টারি স্কুলের দ্বিতীয় বর্ষেই নিজে তা আঁকা শুরু করলেন। কিন্তু বাদ সাধল ভাগ্য। যে হাত দুটো দিয়ে তিনি বছর বছর পরে আঁকবেন Black Jack, সেই হাতদুটোই সংক্রমণের ফলে এত ফুলে গেল যে তা হারানোর যোগাড়। চিকিৎসকের নিবিড় পরিচর্যায় তেজুকা সুস্থ হয়ে উঠলেন। তবে এ ঘটনা তার মনে বড় একটা প্রভাব ফেলল। তেজুকা মাঙ্গা লেখা চালিয়ে গেলেন ঠিকই, কিন্তু একই সাথে ভর্তি হলেন ওসাকা ইউনিভার্সিটির মেডিক্যাল ফ্যাকাল্টিতে। কলেজের প্রথম দিকেই, মাত্র ১৭ বছর বয়সে তার প্রথম মাঙ্গা প্রকাশ পেল ছোটদের পত্রিকায়, চার-প্যানেলের এক মাঙ্গা, The Diary of Ma-chan.
[http://i.imgur.com/OqWZzNk.jpg]

তার কাজে পশ্চিমের অনুপ্রেরণা ভালোভাবে প্রকাশ পেল তার পরবর্তী মাঙ্গায়, ১৯৪৭ এ। ছোটবেলায় যেসব ধ্রুপদী গল্প পড়ে বড় হয়েছেন, তেমনই একটি, Tressure Island এর গল্পে নিজের ছোঁয়া লাগিয়ে তিনি লিখলেন The New Tressure Island/Shin Takarazima। যা আগের সব মাঙ্গার থেকে আলাদা ছিল তার অসাধারন গল্পবুঁনট, সিনেমাটিক দৃশ্যায়ন আর দ্রুতগতির কাহিনীর কারণে। Shin Takarazima জনপ্রিয়তা জাপান জুড়ে ছড়াল, তা বিক্রি হল হটকেকের মত। প্রায় ৪ লাখ কপি!
[http://i.imgur.com/DWoL60k.jpg]

“পোকা সংগ্রাহক” তেজুকা অবশ্য তার এই ভালোবাসাটাও ভুললেন না। Osamushi বা Ground Beetle এর নামে রাখলেন নিজের ছদ্মনাম।
মেডিকেল স্কুলের পাঠ শেষ হল। কিন্তু “ডক্টর ওসামু তেজুকা” চিকিৎসাবিদ্যা বাদ দিয়ে যুদ্ধ-পরবর্তী জাপানের মানুষের জীবনকে পরিবর্তনের দায়িত্ব নিলেন।
মাঙ্গার প্যানেলে।

10451023_911098545588630_673127875041019372_n

 

অ্যানিমের ইতিহাস – পঞ্চম পর্বঃ বিশ্বজয় – চেনা জগত; লা এইচ ট্রিও– ফাহিম বিন সেলিম

ষাটের দশকে শুধু টিভিতে অ্যানিমের জাগরণের গান।
ওসামু তেজুকা আর তার মুশি প্রোডাকশন শুধু অ্যাস্ট্রো বয়েই থেমে থাকেননি। সেটা তো ছিল মাত্র শুরু। ১৯৫৯ আর তারপর ১৯৬৩ তে মাইটি অ্যাটম বা আরো বেশি জনপ্রিয় নাম, অ্যাস্ট্রো বয়ের নতুন যে সিরিজ শুরু হল সেগুলোর ধারাবাহিকতায় ১৯৬৫ সালে তেজুকা তার নিজের লেখা মাঙ্গা জাঙ্গল এম্পেররের অ্যানিমে তৈরি করেন; যা সারা বিশ্বে আরো বেশি পরিচিত কিম্বা – দ্য হোয়াইট লায়ন নামে(Kimba – The White Lion)।
আফ্রিকার অরন্যের বেড়ে উঠা লিও(ইংরেজিতে কিম্বা) আর তার অভিযান নিয়েই তৈরি এই ৫২ পর্বের সর্বপ্রথম পুর্নরঙ্গিন অ্যানিমে। মাত্র এক বছরের মাথায় এটা আমেরিকায়ও মুক্তি পায়। আর এভাবেই জাপান থেকে সুদূর যুক্তুরাস্ট্র হয়ে সারাবিশ্বে অ্যানিমে প্রসার শুরু হল। যা পরবর্তীতে অনুদিত হয়েছে ইতালি, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, কাতালান, ডাচ, জার্মান সহ বিভিন্ন ভাষায় আর প্রচারিত হয়েছে শ’ কয়েক দেশে – হয়ত বাংলাদেশ টেলিভিশনের পর্দায়ও আপনি তা দেখে থাকবেন। যা আজ পর্যন্ত, এই প্রজন্মের কাছে না হলেও এবং অ্যানিমে হিসেবে তেমন প্রচার না থাকলেও, অন্যতম জনপ্রিয় ও প্রভাব বিস্তারকারী অ্যানিমে।

আর এসব অ্যানিমে শুধু জাপানই নয়, বিশ্বব্যাপী ছোট ছেলেমেয়েদের ‘চাইল্ডহুড’ বদলে দিচ্ছিল চিরদিনের জন্য। তেজুকার এসময়ের আরো একটি উল্লেখযোগ্য কাজ প্রিন্সেস নাইট, সর্বপ্রথম সৌজো, ম্যাজিকাল গার্ল জনরার অ্যানিমে। তবে তেজুকা যে একাই সব করছিলেন তা না, জাপানের ‘ডিজনী’ তোয়েই অ্যানিমেশন আর অন্যান্য নতুন গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলোও বসে ছিল না। ১৯৬৩ সালেই প্রচারিত হয় জাইগেন্টর(Gigentor), আমেরিকার সেসময়কার বেশ জনপ্রিয় এক ‘কার্টুন’; যা মাত্র এক বছরের মাথায় আমেরিকা আর অর্ধদশক না পেরোতে পা রেখেছিল ডাউন-আন্ডারে। টিভি ডৌগার ম্যারিন বয়(Marine Boy), তোয়েই-এর সাইবর্গ ০০৯(Cyborg 009) এর পাশাপাশি ‘৬০-এর সবচেয়ে বড় নাম, তাতসুয়োকো প্রোডাকশনের – মাক গোগোগো(Mach GoGoGo)। টিনেজার স্পীড আর তার মাক ফাইভের রক্তগরম, শিরদারা আর হৃদস্পন্দন থামিয়ে দেওয়া সব রেসিং। সাথে আছে রহস্যময় রেসার এক্স। ওহ, অ্যানিমেটার ১৯৯৭ সালের রিমেক, ২০০৮-এর কার্টুন রিমেক নেক্সট জেনারেশন অথবা একই সালের হলিউড লাইভ অ্যাকশন ফিল্ম হয়ত দেখে থাকবেন। অ্যানিমেটা বিশ্বব্যাপী পরিচিত স্পীড রেসার(Speed Racer) নামে।

আর এসব অ্যানিমে দেখে বড় হওয়া প্রজন্ম কয়েক দশক পর আনবে নতুন এক মেলবন্ধন। জাপান, আমেরিকা – অ্যানিমে, হলিউডের মাঝে। তবে সে অনেক পরের গল্প।

টিভির কাছে স্তিমিত হয়ে গেলেও হলে তখনো অ্যানিমে মুভি বের হওয়া বন্ধ হয়নি। কিন্তু ১৯৬৯ সালে মাঙ্গার জনক, আধুনিক টিভি অ্যানিমের জনক, তেজুকা যা বানালেন তার কথা কেউ ভাবতেও হয়ত পারেনি। ১৯৬৯ সালের জুনে জাপানের হলগুলোতে বেরোল ওয়ান থাউজ্যান্ড এন্ড ওয়ান নাইটস(1001 Nights), হ্যা আলাদিনের সেই ধ্রুপদি কাহিনী। কিন্তু তেজুকার হাতে এই চেনা কাহিনীটাই আমূল বদলে গেল। শব্দ আর চিত্র গ্রহনের অনন্য পরিচালনায় তৈরি হল অনবদ্য মুভি, তাতে আছে শিল্পের ছোয়া আবার যৌনতা আচড়। আর-এক্স রেটেড, আনসেন্সরড – ওয়ান থাউস্যান্ড এন্ড ওয়ান নাইটস হয়ে গেল সর্বপ্রথম অ্যানিমেটেড পর্নোগ্রাফি – হেন্তাই। যদিও তা বর্তমানের ‘হেন্তাই’-শব্দটার ব্যবহারিক অর্থের সাথে মিলে না। বাগদাদ, অ্যাামাজন অথবা আলিবাবার ও ৪০ চোরের গুহা পার হয়ে এ অ্যানিমে পরিবেশন করবে বাস্তব আর স্বপ্নের এক অসাধারন সমাহার।

শুধু এখানেই অবশ্য শেষ না, পরের বছর বেরোল ক্লিওপেট্রা – দ্য সেক্স কুইন(Cleopetra The Sex Queen) আর ১৯৭৩-এ ২৩তম বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভালে মুক্তি পেল বেলাডোনা অফ দ্য স্যাডনেস(Belladona of the Sadness)। সবগুলোই আর-এক্স হেন্তাই।

আর এভাবেই টিভির জাগরন আর থিয়েটারে বড়সড় একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ‘৭০-এ পা রাখল অ্যানিমে। কাতসুদো সাশিন আর কুমো তো চুরিপ্পুর মত অজানা এক জগত পেরিয়ে এজায়গাটা সাধারন অ্যানিমে ভক্তদের কাছে অবশ্য বেশ পরিচিত। ১৯৭০-এর অনেক অ্যানিমেই আমাদের হয়ত আমাদের প্রিয়, বারবার দেখা। আবার হয়ত কারো দেখা সেগুলোর সাম্প্রতিককালে প্রচারিত রিমেক। নামগুলো শুনেই হয়ত মুখে ক্ষীন একটা হাসির আভাস দেখা দিবে। অ্যানিমে এখন বিশ্বব্যাপী, অ্যানিমে এখন বিশ্বজয়ী।

কারণ ‘৭০-এ অ্যানিমে জগতে পা রাখবে –
লুপিন দ্য থার্ড, আশিতা নো জো, ফিউচার বয় কোনান, মাজিঙ্গার জি, গ্যালাক্সি এক্সপ্রেস ৯৯৯, রোস অফ ভার্সাইলেস, স্পেস ব্যাটলশিপ ইয়ামাতো, মোবাইল স্যুট গুনদাম।
ডোরেমন!

// জাপান থেকে আমেরিকায় অ্যানিমের প্রভাব, প্রচার ও প্রসার সম্পর্কে বেশ ভালো একটা ডকুমেন্টারি – অ্যানিমে ড্রয়িং এ রেভ্যুলুশন। দেখতে পারেনঃ http://www.veoh.com/watch/v15806437gxSnEpdK?h1=anime+drawing+a+revolution //

 

অ্যানিমের ইতিহাস – চতুর্থ পর্বঃ স্নেক এন্ড সাসকে – নিউক্লিয়াস এন্ড অ্যাটম – ফাহিম বিন সেলিম

 

1781574_734068656624954_453149461_o

অ্যানিমের গল্প বলতে গেলে মাঙ্গাকে তো বাদ দেওয়া যায় না! লেখা-আঁকার যুগলবন্ধী প্রচলিত ছিলো বহু আগে থেকেই। কিন্তু অ্যানিমের মত “মাঙ্গা”-র প্রসার ভালোভাবে শুরু হল যুদ্ধের পর। ১৯৪৭ সালে নতুন সংবিধান অনুযায়ী জাপানে সকল সেন্সরশীপ নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ায় সাহিত্য, বিনোদনের অন্যান্য মাধ্যমের মত মাঙ্গা-অ্যানিমেতেও ভিন্নধারার সূচনা ঘটল। ১৯৪৫ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠনের সময়গুলোতে, আমেরিকার তত্বাবধায়নে থাকার কারণে তাদের সংস্কৃতি দ্বারা অনুপ্রানিত হওয়াকেও একটা কারণ হিসেবে বলা যায়। মার্কিন সুপার-হিরো কমিকস জাপানীদের জন্য নতুন এক অভিজ্ঞতা ছিল। অনুপ্রানিত হলেও, জাপান অবশ্য তা অনুসরন করল না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রসঙ্গ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা হলেও সামগ্রিকভাবে যুদ্ধ-শান্তির প্রভাবটা বেশ ভালোভাবেই লক্ষনীয় ছিল। ১৯৫১ সালে, প্রথমবারের মত ‘সুপার হিরো’-দের কাহিনী জাপান নিজেদের আদলে বলা শুরু করল। ওসামু তেজুকা, যাকে বলা হয় আধুনিক অ্যানিমের নিউক্লিয়াস মাঙ্গার ধর্মপিতা, আঁকা শুরু করেন Tetsuan Atom(Mighty Atom), যেটা অধিক পরিচিত Astro Boy নামে।
আধুনিক আরেকটি উল্লেখযোগ্য মাঙ্গা অবশ্য তারও আধ-দশক আগে শুরু হয়েছে। ১৯৪৬ সাল থেকে শুরু হয়ে দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে যা প্রকাশিত হয়! ১৯৭৪ সালে মাঙ্গা প্রকাশ শেষ হওয়ার পাঁচ বছর আগেই অবশ্য তার অ্যানিমে প্রচারও শুরু হয়ে গিয়েছিল, ১৯৬৯ সালে। এবং তা আজ অবধি চলছে!
ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘকালব্যাপী এবং সর্বাধিক প্রচারিত পর্বের অ্যানিমে, মাচিকো হাসেগাওয়ার – Sazae-san।

এই Astro Boy আর Sazae-san কেই বলা যায় যথাক্রমে আধুনিক শৌনেন-সেইনেন আর শৌজো-জোসেই জনরার অ্যাডাম-ইভ।

অ্যানিমের গল্পে ফিরে আসা যাক। ১৯৪৮ সালে আলোর মুখ দেখল “জাপান অ্যানিমেটেড ফিল্ম” স্টুডিও। প্রথম দিকে তেমন উল্লেখযোগ্য কোন কিছু তৈরী করতে না পারলেও, ১৯৫৬ সালে তোয়েই কোম্পানী এই স্টুডিওকে কিনে নেওয়ার পর অবস্থা পাল্টে যায়। নতুন নাম হয় – তোয়েই অ্যানিমেশন। মাত্র দুই বছরের মাথায় তারা বের করে প্রথম রঙ্গিন জাপানিমেশন এবং সর্বপ্রথম আধুনিক “অ্যানিমে” – The Tale of the White Serpent, ১৯৬১ সালে যা সর্বপ্রথম অ্যানিমে হিসেবে আমেরিকায় মুক্তি পায়। প্রথম আধুনিক অ্যানিমে হিসেবে বিবেচিত হলেও বর্তমান-প্রচলিত অ্যানিমে থেকে ডিজনীর রুপকথার গল্পগুলোর সাথেই এটার বেশি মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। এবং যথাযথ কারণেই এই মুভিটি তোয়েই অ্যানিমেশনকে এনে দেয় “প্রাচ্যের ডিজনী” উপাধি।
শুধু রঙই নয়, জাপানের তৎকালীন অ্যানিমেশন প্রযুক্তির একেবারে চূড়ান্ত ব্যবহার করা হয় এই চলচ্চিত্রে। কিন্তু চমকপ্রদভাবে তাইজি ইয়াবুশিতা আর কাজুহিকো ওকাবে পরিচালিত এই অ্যানিমে তৈরী করতে লেগেছিল মাত্র ৮ মাস! একসাথে কাজ করেছিল সাড়ে তের হাজারেরও বেশি কর্মী!

তার পরের বছরই ইয়াবুশিতা আবার আকিরা দাইকুবারার সাথে মিলে তৈরী করেন Magic Boy, যার জাপানী নাম Shounen Sarutobi (না, হিরুজেনও না, আসুমাও না, এমনকি কোনোহামারুও না) Sasuke [  ]!
এই অ্যানিমেও ডিজনীর গতবাধাঃ লোকগাথা-রুপকথা-গান-কথাবলাপশুপাখি ফর্মুলা অনুসরন করেছিল। ৮৪ মিনিটের এই দ্বিতীয় রঙ্গিন অ্যানিমে The Tale of the White Serpent-এর সাথে একই বছর আমেরিকায় মুক্তি পায়।

প্রতিবছর একটি মুভির ধারাবাহিকতায় ১৯৬০ সালে ওসামু তেজুকার My Son Goku মাঙ্গার উপর ভিত্তি করে তৈরী হয়, Alakazam the Great। তেজুকা আবার মাঙ্গাটি এঁকেছিলেন ষোল শতকের চাইনিজ উপন্যাস Journey to the West এর অবলম্বনে। তোয়েই অ্যানিমেশনের পক্ষ থেকে তেজুকাকে পরিচালক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলেও, তেজুকার ভাষ্যমতে স্টুডিওতে তার গমন বিজ্ঞাপনের জন্য ছবি তুলতে যাওয়া পর্যন্তই। তবুও এই মুভির কারণেই অ্যানিমেশনের প্রতি প্রথম তাঁর আগ্রহ জন্মায়। আর ১৯৬১ সালে অসন্তোষ আর সৃজনশীল অসামঞ্জস্য, যে কারণেই হোক, তোয়েই অ্যানিমেশনের সাথে চুক্তি শেষ হওয়ার সাথে সাথেই তেজুকা নিজেরই একটা স্টুডিও খুলে বসলেন!
তোয়েই অ্যানিমেশনের সাথে সাথে কাঁধে কাঁধে পাল্লা দেওয়ার জন্য – মুশি প্রোডাকশন।

মাঙ্গার মতোই অ্যানিমেতেও আমেরিকানদের অনুসরন না করে জাপানের স্বকীয় আখ্যান বর্ণণা করতেই তিনি বেশী মনোযোগী হলেন। ১৯৬৩ সালে নতুন বছরের প্রথম দিনে জাপানের টেলিভিশন ইতিহাস পাল্টে গেল চিরদিনের জন্য।
হলের বড় পর্দার গন্ডি পেড়িয়ে অ্যানিমেশনের যাত্রা শুরু হল টিভির চারকোনা বাক্সে। আর মাঙ্গার মতই এখানেও প্রথম নামটি হল – Astro Boy!

 

অ্যানিমের ইতিহাস – তৃতীয় পর্ব: ওয়ার এন্ড পিস – ফাহিম বিন সেলিম

1796548_730218773676609_649659517_n

ত্রিশের দশক। জাপানীজ অ্যানিমেশন ততদিনে ডিজনীর কাছে ব্যাবসায়িক খেলায় হেরে দেশীয় চলচ্চিত্র বাজারের আধিপত্য হারিয়েছে। হলের বড় পর্দায় ব্যাবসায়িক অ্যানিমেটেড ফিল্মের পরিবর্তে তারা দায়িত্ব নিয়েছে শিক্ষা-জনসচেতনতা মুলক আর বিজ্ঞাপন-প্রচারণামুলক ভিডিও তৈরীর। জাপান সরকার এসময় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ প্রবর্তন করায়, সেন্সরশিপ অনেক কঠোর হয়ে গেল।

তারা জাপানী চেতনা আর জাতীয়তা বাদে উদবুদ্ধ সিনেমা তৈরী করা পরিচালকদের অগ্রাধিকার দেওয়া শুরু করল। এ অভিব্যক্তি আরো জোড়ালো হল ১৯৩৯-এর চলচ্চিত্র আইন প্রণয়নের পর। ছোট ছোট অ্যানিমে ফিল্ম কোম্পানীগুলো একত্রিত হয়ে বড় বড় স্টুডিও গড়ে তুলল। আবার সো চিকুর মত বৃহত্তর স্টুডিও লাইভ অ্যাকশনের পাশাপাশি অ্যানিমে ফিল্ম বের করা শুরু করল। আর এই সোচিকুর সহায়তায় কেনজো মাসাওকা(Chikara to Onna no Yo no Naka) ১৯৪৩ সালে তৈরী করেন Kumo to Churippu[The Spider and the Tulip](১৯৪৩)-র মত মাস্টারপিস[যা ২০০১ সালে প্রকাশিত অ্যানিমেজের সর্বকালের সেরা অ্যানিমের তালিকায় ৪র্থ স্থান দখল করে ]।

যুদ্ধ শুরু হল। আর এসময় সকল স্টুডিওর একত্রিকরণের ধারাবাহিকতায় মাত্র ৩ টি বড় স্টুডিও অবশিষ্ট থাকল, আর এবার তারা সেনাঅর্থায়নে সিনেমা তৈরী করা শুরু করল। আর যুদ্ধকালীন সময় আমেরিকানরা যেমন কমিক আর কার্টুনের চরিত্র ব্যাবহার করে প্রোপাগান্ডা চালিয়েছিল, পুরোনো চরিত্রদের যুদ্ধের সাজে সাজানো অথবা নতুন চরিত্রই তৈরী করা(সবচেয়ে বড় উদাহরণ Captain America); জাপান ও তার সৈন্য আর সাধারণ জনতাকে এই কঠিন সময় পার করতে সাহায্য নিল অ্যানিমের।

১৯৪৩ সালে মিতসুয়ো সেও(Ari-chan) গেইজুতসু এইগাশার প্রযোজনায়, জাপানের লোকগাথার সাথে চলমান যুদ্ধের আবহকে কাজে লাগিয়ে তৈরী করেন Momotaro’s Sea Eagles. [মজার ব্যাপার হল, আমেরিকান সমসাময়িক কার্টুন আর কমিকসে যেমন প্রতিপক্ষ হিটলার অথবা জাপানী সেনাদের আবির্ভাব ঘটা শুরু করল, তেমনই জাপানীরাও তাদের জবাব দেওয়া শুরু করল। যেমন এই অ্যানিমেতে বহুল জনপ্রিয় কার্টুন পপাই এর চরিত্র ব্লুটোকে দেখা যায় একজন সাধারণ মাতাল হিসেবে।] ৩৭ মিনিটের এই অ্যানিমেকে বলা যায় ফিচার লেংথ অ্যানিমেশনের পথে প্রথম সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ।

মাত্র দুই বছর পরই সেও তৈরী করেন এর সিকুয়্যেল, এবার সোচিকুর প্রযোজনায় – Momotaro’s Divine Sea Warriors. ৭৩ মিনিটের এই অ্যানিমে ফিল্মটিই সর্বপ্রথম ফিচার লেংথ জাপানিজ অ্যানিমেশন। ১৯৪১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ডিজনী মুভি Fantasia দ্বারা অনুপ্রানিত হয়ে তৈরী হওয়া এই দুটি মুভির উপরের প্রোপাগান্ডার আর যুদ্ধের ভয়াবহতার চাদরের আড়ালে ছিল শান্তি আর আশার বার্তা।

যুদ্ধে পরাজিত হলেও তাই জাপানীরা নিজেদের সমৃদ্ধ অতীত, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর সৃজনশীলতা প্রকাশের নতুন এক মাধ্যমের খোঁজ পেল। ধংসস্তুপ থেকে জাপানের নবজাগরনের সাথে নতুন শুরু হল অ্যানিমেরও।
আরো বৃহৎ, আরো ভালোভাবে!

যারই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮ সালে সূচনা ঘটল জাপানের ডিজনী – তোয়েই অ্যানিমেশনের।
আর এই তোয়েই অ্যানিমেশনই অ্যানিমের ইতিহাসকে বদলে দিবে সবচেয়ে বড়ভাবে। শুধু প্রথম রঙ্গিন অ্যানিমে অথবা সর্বপ্রথম “আধুনিক” অ্যানিমেই নয়; হালের জনপ্রিয় সব অ্যানিমেগুলোতেও তারা রাখবে অবদান, দশক দশক পর এই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকেই তৈরী হবে –
Seint Seiya, Space Captain Harlock, Toriko, Sailor Moon…
Slam Dunk, One Piece…
Dragon Ball Z!

// ছবি Kumo to Churippu-র //
// Momotaro’s Divine Sea Warriors লিঙ্ক: https://www.youtube.com/watch?v=me5bFtkEAso //

 

অ্যানিমের ইতিহাস – দ্বিতীয় পর্বঃ জনাব ওয়াল্টারের এম্পায়ার বিজনেস, ব্রেকিং সাইলেন্স এবং ফ-অ্যানি-লা – ফাহিম বিন সেলিম

কিতায়ামা সেইতারোর কথা মনে আছে?
জাপানিমেশনের একের দশকের তিন পথিকৃৎদের মধ্যে একজন। নিজের ব্যাক্তিগত স্টুডিও থেকে তিনি ১৯১৮ সালে মুক্তি দিয়েছিলেন Urashima Tarou. কিন্তু দুইয়ের দশকের প্রথমেই বড় একটা বিপর্যয় ঘটে গেল ― ১৯২৩ সালের টোকিও মহাভূমিকম্প। আর এতে তার স্টুডিওর অধিকাংশই ধ্বংস হয়ে যায়। যার কারণে এসময়ে তাঁর অধীনে থাকা শিষ্যরা চারিদিক ছড়িয়ে পড়ে নিজেরাই আলাদা আলাদা স্টুডিও খোলা শুরু করল।

১৯২৩ সালে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটল, প্রায় সাত হাজার মাইল পশ্চিমে ― শিকাগোর ২২ বছর বয়সী এক যুবকের হাত ধরে। The Walt Disney Company-র সূচনা।

ডিজনীর বড় বাজেটের উন্নতমানের অ্যানিমেটেড সিনেমা শুধু আমেরিকা নয় বরং সারাবিশ্বেই একচ্ছত্র সাম্রাজ্য গড়ে তুলল। জাপানও তার ব্যাতক্রম ছিল না। আর ডিজনীর অ্যানিমেটেড সিনেমাগুলোর সাথে জাপানের অ্যানিমেটররা রীতিমত হিমশিম খেতে শুরু করল। একদিকে ডিজনীর ফিল্মগুলো ইতোমধ্যেই বাইরে থেকে প্রচুর লাভ করে আসায়, শুধু আসল উশুল করতে পারলেই হত বলে, জাপানে বেশ স্বল্পমূল্যের টিকেটে থিয়েটারগুলোতে চলা শুরু করল। তার উপর তাদের তুলনামুলক বিশাল কোম্পানীর শব্দের কারুকাজ, সেলুলয়েডে ফ্রেমে রঙ্গিন অ্যানিমেশন আর পরিচালনার কাজ ছিলো বেশ উন্নতমানের। তাই শুধু লড়াইয়ে টিকে থাকতে হলেই জাপানের নির্মাতাদের কম বাজেটে সিনেমা তৈরী করে আরো কম মূল্যে বাজারে ছাড়তে হত।

স্বল্প আয়ের ফলাফল হত পরবর্তীতে আবারো স্বল্প বাজেট। আর তা দিয়ে সাধারণ কাট-আউট ব্যাকগ্রাউন্ড আর হাতে আঁকা ছবির অ্যানিমেশনে আবারো তৈরী হত নিম্নমানের ফিল্ম(ব্যায়বহুল সেলুলয়েডের ফিল্মের তুলনায়)। স্বল্প বাজেট-নিম্নমান-স্বল্প আয়-স্বল্প বাজেটঃ ব্যার্থতার এই চক্র থেকে বের হতেই পারছিল না জাপানের নির্মাতারা।

২০ আর ৩০-এর শুধু ব্যার্থতার হাজারো গল্পের মধ্যেও দুজন নির্মাতার নাম উল্লেখ না করলেই নয়। কেনজো মাসাওকা আর মিৎসুয়ো সেও।
মাসাওকা ১৯৩৩ সালে তৈরী করেন Chikarato Onna no Yo no Nako, সর্বপ্রথম সবাক অ্যানিমে! এর পরের বছরই বের হয় সম্পূর্ণ সেল অ্যানিমেশনে তৈরী প্রথম অ্যানিমে Dance of the Chigamas.
আর ১৯৪১ সালে মিৎসুয়ো মাল্টিপ্লেন ক্যামেরা ব্যাবহার করে বানান Ari-chan.

তবে ব্যাতিক্রম অবশ্যই উদাহরণ নয়। আর্থিক সমর্থনের অভাবে এধরনের মান বজায় রাখা সম্ভব ছিলো না। আর সে কারণেই হলে বের হওয়া দেশীয় অ্যানিমেটেড সিনেমার সংখ্যা অনেকটা কমে গেলো। বরঞ্চ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন, রাজনৈতিক আর শিক্ষা-জনসচেতনতামূলক প্রচারণা ভিডিওর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিল অ্যানিমে। এক্ষেত্রে জাপানের শিক্ষা বিভাগ একটা উল্লেখযোগ্য ভুমিকা পালন করেছিল।

দুই দশকের ক্রান্তিকাল শেষে ততদিনে অবশ্য আবার বদলের মুখোমুখি এসে পড়েছিলো অ্যানিমে।
শুধু অ্যানিমে না, পুরো পৃথিবীতেই বিরাট এক পালা বদল ঘটবে।
আর তা শুরু হবে চারের দশকের সূচনাতেই।
আর তাতে অবদান রাখবে ― দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ! 

/দুঃখিত অনেক খুঁজেও এই তিনটার কোন ভিডিও লিঙ্ক খুঁজে পেলাম না, কয়েকটা স্ক্রিনশট বাদে – ছবিটি Chikarato Onna no Yo no Nako-এর/

 

1901900_721282971236856_868206932_n

অ্যানিমের ইতিহাস প্রথম পর্ব – ফাহিম বিন সেলিম

পশ্চিমের অ্যানিমেশন যখন বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই যাত্রা শুরু করেছে, তখন জাপানও খুব একটা পিছিয়ে ছিলো না। Katshudou Shashin[Moving Picture] (১৯০৭) কে ধরা হয় প্রথম অ্যানিমে ফিল্ম, সম্ভবত ব্যাক্তিগত অথবা পরীক্ষামূলক সম্প্রচারের লক্ষ্যে যা তৈরী হয়েছিল। কার তৈরী, তা অবশ্য অজানা। মাত্র ৩ সেকেন্ডের।

রাজনৈতিক ক্যারিকেচারিস্ট/কার্টুনিস্ট ওতেন শিমোকাওয়া, জাপানিজ অ্যানিমেশনের অন্যতম অগ্রদূত, একের দশকে ৫ টি অ্যানিমেটেড ফিল্ম তৈরী করেন তেনকাৎসু কোম্পানীর প্রযোজনায়। এর মধ্যে ছিলো Imokawa Mukuzo Genkanban no Maki (১৯১৭), প্রথম বাণিজ্যিকভাবে তৈরী অ্যানিমে, ২০০৫ সালে Katshudou Shahsin আবিষ্কারের পূর্বে যেটাকে ধরা হত সর্বপ্রথম অ্যানিমে।

একের দশকের আরো দুই পথিকৃৎ জুনিচি কৌইচি এবং সেন্তারো কিতায়ামা।

কার্টুনিস্ট এবং জলরঙ্গে দক্ষ আঁকিয়ে কৌইচি ১৯১৬ সালে কোবায়াশি শোকাই-এ যোগ দিয়ে একে একে তৈরী করেন প্রায় ১৫ টি মুভি। তাকে বলা যায় এই সময়ের সবচেয়ে কুশলী অ্যানিমেটর।

শিমোকাওয়া বা কৌইচির মত কিতায়ামা অবশ্য কোন বাণিজ্যিক স্টুডিওর হয়ে কাজ করতো না। বরং নিজের ব্যাক্তিগত স্টুডিওতেই চকবোর্ড পেইন্টিং আর পেপার পেইন্টিঙ্গের কলাকৌশল কাজে লাগিয়ে তিনি বেশ কিছু অ্যানিমে তৈরী করেন। 

কৌইচির Namakura Gatana(১৯১৭)-র সাথে তার Urashima Tarou(১৯১৮) ২০০৭ সালে আবিষ্কৃত হয় এক অ্যান্টিক মার্কেটে।

প্রথম দিককার মাত্র কয়েক মিনিটের নির্বাক এসব অ্যানিমে দিয়ে জাপান যখন অ্যানিমেশন জগতে যাত্রা শুরু করেছে, সীমিত সামর্থের মধ্যে শত বাঁধা বিপত্তি কাটিয়ে এগিয়ে চলেছে – দুইয়ের দশকে পা রাখতেই তখন বাণিজ্যিকভাবে তাদের সামনে এসে পরলো আরেক বিশাল বাঁধা। আন্তর্জাতিক এক মহা প্রতিদ্বন্দ্বী।

ডিজনি!

Katshudou Shashin – THE First Ever Anime: 

www.youtube.com/watch?v=i1bUwGkdBrU&desktop_uri=%2Fwatch%3Fv%3Di1bUwGkdBrU