“এনিমখোর রিভিউ কন্টেস্ট [২০১৫] – বিশেষ পুরস্কার অধিকারী এন্ট্রি”
————————————————————————————————————-
এনিমে : মনস্টার ( Monster )
মাঙ্গাকা : নাওকি উরাসাওা
জনরা : মিস্ট্রি , ড্রামা , হরর , সাইকোলজিকাল , থ্রিলার , সেইনেন
পর্ব সংখ্যা : ৭৪
মাই এনিমে লিস্ট রেটিং : ৮.৭৫
প্রায়শই এনিমেতে খুঁজে পাওয়া সকল কল্পকাহিনীর অতিমানবীয় শক্তি ও অতিপ্রাকৃত ঘটনা থেকে অনেক দূরে ,”মনস্টার” হচ্ছে বাস্তবতার নিরিখে গড়ে ওঠা এক শিহরণ জাগানো কাহিনী । জোরপূর্বক মানুষের মনস্তাত্ত্বিক গঠন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা , একজন সোসিওপ্যাথের মনজগতের চিন্তাভাবনা , অশুভ সবকিছুর উৎস ও মানব জীবনের প্রকৃত মূল্য এর মত কিছু অস্বস্তিকর বিষয় এইখানে বেশ ভয়ংকরভাবে উপলব্ধি করার সুযোগ পাওয়া যায় । সকল অশুভ শক্তির এক মূর্তিমান প্রতীক, এক মানবরূপ দানবের বিরুদ্ধে নিজের মনুষ্যত্ব বজায় রেখে এই দুনিয়ার যা কিছু নষ্ট তা ঠিক করার জন্য সংগ্রামের এক ব্যাতিক্রমধর্মী , রহস্যময় , রোমাঞ্চকর এক গল্প “মনস্টার” ।
কাহিনী : ( ৯/১০)
সময়কাল আশির দশকের মাঝামাঝি, পশ্চিম জার্মানি । আইসলা মেমোরিয়াল হাসপাতালে কর্তব্যরত দক্ষ নিউরোসার্জন , ডাক্তার কেনজো টেনমা, আমাদের গল্পের মুল নায়ক । এক সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি , হাসপাতাল পরিচালকের অনুগ্রহ এবং বাগদত্তা হিসেবে তার সুন্দরী কন্যা ; সবই ভালো চলছিল তার । কিন্তু একটি সিদ্ধান্ত তার দুনিয়া সম্পূর্ণ ওলট-পালট করে দেয় । হাসপাতালের অভ্যন্তরের রাজনীতি , দুর্নীতি ও রোগীদের চিকিৎসা নিয়ে বিভিন্ন অনিয়মে অতিষ্ঠ ডাক্তার টেনমা যখন দোটানার সম্মুখীন হয়ে নিজের বিবেকের কথায় সাড়া দিয়ে পরিচালকের আদেশ অমান্য করে শহরের মেয়রকে বাদ দিয়ে এক গুলিবিদ্ধ বালকের চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নেয় তখন থেকেই তার সুন্দর জগতের সব ধিরে ধিরে ভেঙ্গে পরতে শুরু করে । তাকে পদচ্যুত করা হয়, তার বাগদত্তা তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে , তার উন্নতির সব পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয় ।
হাসপাতাল থেকে সেই আহত বালক এবং তার জমজ বোনের উধাও হয়ে যাওয়া এবং পরিচালক ও আরও দুই চিকিৎসকের রহস্যজনক হত্যাকাণ্ডে ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন দিকে মোড় নেয় । কিন্তু এই রহস্যের সমাধান করা তখন সম্ভব হয়ে উঠে না । এই ঘটনার দশ বছর পরে, পুনরায় বিভিন্ন রহস্যজনক হত্যাকাণ্ড ঘটতে থাকে , টেনমার সামনে হত্যা হয় তার এক রোগী । পারিপার্শ্বিক প্রমাণের কারণে সন্দেহের তীর তার দিকে ধেয়ে আসে । বাধ্য হয়ে সে নেমে পরে সব অঘটনের পিছে দায়ী এই “দানবের” খোঁজে , সব অশুভ অশুভ শক্তিকে মূলে ধ্বংস করতে । তার এই খোঁজে বেড়িয়ে আসে তৎকালীন সময়ে গোপনে চলতে থাকা এবং পূর্বে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার ভয়ংকর চিত্র ।
সম্পূর্ণ গল্পটি বেশ গুছিয়ে লেখা হয়েছে । সকল ঘটনার জট ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করে , গল্পের এই গতি দর্শকদের কাছে বিস্ময় ও সামনের ঘটনার জানার আকাঙ্ক্ষার অনুভুতি জাগাতে সহায়ক ছিল । বেশ সুচিন্তিত ডায়ালগগুলো চরিত্রগুলোর ব্যাক্তিত্ত সম্পর্কে আমাদের সুস্পষ্ট ধারনা দেয় । বিশেষ করে প্রত্যেক চরিত্রের মাঝে যে সম্পর্ক ,অতি যত্নের সাথে যেভাবে তাদের নিজ নিজ পরিবেশের সাপেক্ষে উপস্থাপন করা হয়েছে তা সত্যিই প্রশংসনীয় । মাঝে কাহিনীর গতি কিছুটা ধীর যাওয়া দর্শকের কাছে বিরক্তির কারণ হতে পারে কিন্তু আমার মতে তা সম্পূর্ণ গম্প উপস্থাপন করতে প্রয়োজন ছিল । যদিও মাঝে কাহিনীর সাথে তেমন সম্পর্কহীন কিছু পর্ব বাদ দিলে এনিমেটির আবেদন আরও বাড়তো ।
আর্ট ও অ্যানিমেশন :(৮.৫/১০)
বর্তমানের এনিমের মত ঝকঝকে না হলেও, গল্পের আবহের সাথে সম্পূর্ণ মানানসই । আলো এবং ছায়ার সাহায্যে বিভিন্ন ঘটনা , অনুভূতির প্রকাশ বেশ দক্ষভাবে দেখানো হয়েছে । চরিত্রগুলোর ডিজাইন বেশ বাস্তবধর্মী , তাদের দেহের ও মুখের গঠনে এর ছাপ স্পষ্ট । এছাড়া বিভিন্ন সময় পরিচয় করিয়ে দেওয়া নানা জাতির মানুষের ডিজাইনে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে । ব্যাকগ্রাউন্ডে জার্মানি , চেক প্রজাতন্ত্র ও ফ্রান্সের বিভিন্ন স্থানের চিত্র উপস্থাপনে যে বৈচিত্রের দেখা মিলে তা সত্যি মনোমুগ্ধকর ।
সাউন্ড : (৮.৭/১০)
বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবহৃত আবহ সঙ্গীত সম্পূর্ণ গল্পকে আরও বাস্তবধর্মী করে তুলেছে । প্রতিটি বন্ধুকের গুলির শব্দও যেভাবে বন্ধুকের ধরনের সাথে মিলিয়ে তৈরি করা হয়েছে তাতে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে । ওপেনিং হিসবে ব্যবহার করা সাউন্ডট্রাকটি ( https://www.youtube.com/watch?v=i8Rhb-Ln01Q ) আমাদের মনে যে ছমছমে ভাবের জন্ম দেয় , তা গল্পের ভাবকে আরও সুস্পষ্ট করে তুলেছে । এন্ডিং হিসেবে ব্যবহার করা ” ফর দ্যা লাভ অফ লাইফ ” (https://www.youtube.com/watch?v=qhPGbr51jfc ) আমার শোনা অন্যতম অদ্ভুতুড়ে এন্ডিং । আবার রয়েছে “আইডলার হুইল” (https://www.youtube.com/watch?v=GBim5JAZQrY&index=17&list=PLA78A59F7388EC1A7) এর মত মন ভালো করে দেওয়া সাউন্ডট্রাক । এই এনিমে কেবল তার সাউন্ডট্রাক এর জন্য সুপারিশযোগ্য । এই এনিমের ডাব্বড ভার্শন দেখতে আমি সুপারিশ করবো কেননা আমার মতে সাব্বড এর তুলনায় ডাব্বড ভার্শন গল্পের সেটিং এর সাথে ভালোভাবে মিলে ।
চরিত্র : ( ৯.৫ / ১০)
এই গল্পের মুল আকর্ষণ এর চরিত্রগুলোর গভীরতা এবং যেভাবে সুক্ষভাবে যত্নের সাথে এদের চরিত্রায়ন করা হয়েছে । এইখানে আমাদের দেখা মিলে এই জনরের অন্যতম শক্তিশালী কিছু চরিত্রের । পার্শ্ব চরিত্রগুলো অন্যান্য সিরিজের মূল চরিত্রের তুলনায় অনেক ভালভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে । সমগ্র সিরিজ জুড়ে অনেক চরিত্রের অবতারনা করা হলেও তাদের প্রত্যেকের মধ্যে আলাদাভাবে পার্থক্য করা সম্ভব । পার্শ্ব চরিত্রগুলো অনেক ক্ষেত্রেই মূল চরিত্রগুলোকে ছাপিয়ে দর্শককে আকর্ষণ করার ক্ষমতা রাখে । চরিত্রগুলো ধরন এবং তাদের মধ্যের সম্পর্ক আবিষ্কার করাই হবে দর্শকদের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা ।
সর্বোপরি, এর অসাধারণ সব চরিত্রের দক্ষ চরিত্রায়ন থেকে এর বাস্তব সেটিং, দুর্দান্ত সাউন্ডট্রাক ও সুষম গতিতে চলতে থাকা কাহিনী , সবই আপনাকে আপনার সিটের কিনারে এনে ছাড়বে । এনিমে জগতে এরকম বাস্তবধর্মী গল্প খুজে পাওয়া আসলেই দুর্লভ এবং যদিও ৭৪ পর্বের এই কাহিনী কিছুটা দীর্ঘ হলেও পরিশেষে আপনি তৃপ্তই হবেন । সামনে কী ঘটতে যাচ্ছে, এই চিন্তায় আপনি সবসময় ব্যস্ত থাকবেন । তাহলে আর অপেক্ষা কেন ? দেখে ফেলুন রোমাঞ্চে ভরপুর , বাস্তব অথচ অপার্থিব এক থ্রিলার “মনস্টার” ।

