মিলেনিয়াম একট্রেস ও একটি জাতির পুনর্জন্ম — Fahim Bin Selim
মিকিও নারুসের দৃষ্টিপাত বরং নিকট অতীত আর বর্তমানে – যুদ্ধ-পূর্ববর্তী এক গ্রামীন স্কুল কিংবা যুদ্ধ-শেষে টোকিওর ধ্বংসস্তুপ। যুদ্ধের ভয়াবহতা যে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে দেশের ভিতরেও চলে এসেছিলো। আকাশে ভেসে বেড়ানো কালো মেঘের ভেতর থেকে বর্ষণ হলো গুলি-বোমা। তা বিদায় নিলে আবার হাজির দূর্ভিক্ষ, বাস্তুহরণ আর বেকারত্ব। আর নিজভূমে থেকেও পরাধীনতার স্বাদ পাওয়া প্রথমবারের মত। রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো আমেরিকান সেনারা জানান দেয় সেই নতুন বাস্তবতার। সে সময়টায় চিয়োকো মাথায় জড়ায় হিদেকো তাকামিনের স্কার্ফ। ভাঙ্গা কাঠ আর জঞ্জালের নিচে হাতড়ে ফিরে স্মৃতি আর স্বপ্ন। গলায় তখনো ঝুলতে থাকে সেই আরাধ্য চাবি।
কারণ তবুও তো জীবন থেমে থাকে না। ইয়াসুজিরো ওযু তাই আসন গাড়েন মেঝেতে, ক্যামেরা সাজান এমনভাবে যাতে ধরা পড়ে পুরো ঘর আর তাতে থাকা সব মানুষ। বাইরের সব কোলাহলমুক্ত, অন্তত ব্যক্তিগত এই জায়গা-ই তো শেষ সম্বল। অতীতকে পাশে রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্রণা দেন। সেৎসুকো হারার হাসি জায়গা নেয় চিয়োকোর ঠোঁটে। নাকি তার পুরোটাই দখল করে নেয়! তাই কি ষাটের দশকের মাঝ থেকে দুজনেই হারিয়ে গেলো লোকচক্ষুর আড়ালে?
সে-ও তো অনেক বছর আগের কথা। সবার স্মৃতিতেই কিছুটা মরচে পড়েছে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে কীভাবে! চিয়োকো যে পান করেছে অমরত্বের সুধা। ফিল্মের ফিতা আর গেনিয়ার মুগ্ধতায় চিয়োকোর প্রতিটি সংলাপ আর অভিব্যক্তি টিকে আছে আগের মতই। তাই গেনিয়া হাজির হলো চাবি নিয়ে। ধুলোর আস্তরণ সরিয়ে খুলে বসলো বাক্সটা আবার। চিয়োকো, জাপান, সাতোশি কনের নিজের কিংবা আমাদের স্মৃতির। মুখে-ক্ষতওয়ালা লোকটা এখনো বিদ্যমান; নতুন চরিত্র নিয়ে, নতুন জায়গায় দখলদারিত্ব আর সাম্রাজ্যবিস্তারের সেই পুরনো নাটকের মঞ্চায়ন।
তাতামি গ্যালাক্সিতে কিয়োটো — Fahim Bin Selim
তাতামি গ্যালাক্সি দেখতে গেলে প্রিয় চরিত্র খুঁজতে বেগ পেতে হবে না। ওয়াতাশি আর আকাশি তো প্রত্যাশিতই। ওয়াতাশির দুই বছরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের টানাপোড়েনে আমরা পরিচিত হই ওযু, আর হিগুচি-সেনসেই, বা তাদের সাথে জুড়ে যাওয়া জৌগাসাকি আর হানুকির সাথে। একেক পর্বে একেক জনের সাথে কাটাই। তাদের সাথে পরিচিত হই দূর বা কাছ থেকে, নিজের চোখে আর মানুষের বর্ণনায়, ভিন্ন দৃষ্টিকোণ নিয়ে। শুধু পর্দায় থাকা কোন ছবি না, সম্পূর্ণ গভীরতা নিয়ে;স্ব স্ব আকাঙ্ক্ষা আর হতাশা থাকা, ভালো আর খারাপের মিশেলে, ত্রিমাত্রিক মানুষ হিসেবে। এমনকি স্বল্প সময়ে পর্দায় থাকলেও সবসময়ই নেকো রামেন বিক্রেতা, জ্যোতিষী বৃদ্ধা কিংবা কোহিনাতার উপস্থিতিও অনুভব করা যায়। তবে এই সবগুলো চরিত্রকে একসাথে জুড়ে আনার ক্ষেত্রে যেটার অবদান, অ্যানিমের মূল উপন্যাসের লেখক তোমিহিকো মোরিমির বাকি কাজেও(যেমন- উচুতেন কাযোকু) যেটার প্রভাব লক্ষণীয়, সেটা কোনো রক্তমাংসের মানুষও না – সব ঘটন আর অঘটনের মঞ্চ, একই সাথে আধুনিক আর পুরাণের জাপান যেখানে একত্রিত হয়, সেই কিয়োটো শহর!
ওয়াতাশির সাড়ে চার তাতামির ঘরটার কথাই চিন্তা করা যাক, এর অবস্থান শিমোগামো ইউসুইসৌ বোর্ডিং হাউজে। ওয়াতাশি যেটার তুলনা করে হংকং এর কোওলুন ওয়ালড সিটির সাথে। ১৯৯৩-এ ধ্বংসের আগে কোওলুন ওয়ালড সিটি তো ছিলো এরকম এক ঘিঞ্জি এলাকাই – আলো-বাতাসের প্রবেশ এখানে সীমিত, রঙচটা আর নোটিশ-বিজ্ঞাপনে ঢাকা দেওয়াল, আগোছালো আধোয়া জামাকাপড়ের স্তুপ, এবং তার মাঝে পরজীবী বিড়াল, তেলাপোকা আর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের বসবাস।
ওয়াতাশির ঘরের জানালার কাঁপন আর ভেসে আসা শব্দে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিয়ে যায় এইযান দেমাচিইয়ানাগি স্টেশনের আগত আর বিদায়ী ট্রেনেরা। কামো নদীর পূর্ব পাড়ের এইযান দেমাচিইয়ানাগি স্টেশনের নাম হয়েছে এপাশে ইয়ানাগি আর পশ্চিমে দেমাচি এলাকার নাম জুড়ে দিয়ে। এই স্টেশনের ভূতলে চলে কেইহান রেলওয়ে; বয়স আর অবস্থানে তার উচ্চাসনে এইযান ইলেকট্রিক রেলওয়ে। ১৯২৫ সালে বসানো এই এইযান ইলেক্ট্রিক রেলওয়ের যাত্রাপথ অবশ্য কেবল কিয়োটোর সাকিও ওয়ার্ডের ভিতরেই বিদ্যমান; দেমাচিইয়ানাগি থেকে উত্তরে গিয়ে তাকারাগাইকেতে দুইভাগে ভাগ হয়ে – পূর্বে ইয়াসে-হেইযানগুচি আর পশ্চিমে কুরামা স্টেশন – সর্বসাকুল্যে ১৪.৫ কিলোমিটার এর মধ্যে। ট্রেনেদের আনাগোনাও তাই খুব নিয়মিত।
শিমোগামো ইউসুইসৌ বোর্ডিং হাউজের আরেক বাসিন্দা আট বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরে থাকা হিগুচি। কখনো বাড়ির পাশের রাস্তায়, কখনো বা দেমাচিইয়ানাগি স্টেশন থেকে ১০ মিনিটের হাঁটা দুরত্বে শিমোগামো মন্দিরের পাশের তাদাসু নো মোরিতে হাজির হয় রহস্যময় নেকো-রামেনের ফেরি; সেখানে সাক্ষাৎ মিলে তার। হিগুচি নিজের পরিচয় দেয় কামো তাকেৎসুনোমি হিসেবে, এই শিমোগামো মন্দিরের দেবতা। তাদাসু নো মোরি, শিমোগামো মন্দির আর কিছুটা উত্তরে তার যুগল কামিগামো মন্দিরের সাথে কিয়োটোর সম্পর্ক তো হাজার বছরের।
সহস্রবর্ষী এক আদিবনের অবশেষ হিসেবে পরে আছে এই তাদাসু নো মোরি। মধ্যযুগ আর মেইজিকালের অনুশাসনের সময় এর আকৃতি কমে এলেও, কিয়োটোর সব যুদ্ধ আর ধ্বংসযজ্ঞের শিকার এবং সাক্ষী হিসেবে মানবহস্তের সাহায্য ছাড়াই বারবার পুনোরুত্থান ঘটেছে তার। এই বনের ভেতরেই ষষ্ঠ শতাব্দীতে শিমোগামো মন্দিরের সূচনা, তারও কিছুকাল পর কামিগামো মন্দিরের। এমনকি কিয়োটোও তো তখনো জাপানের প্রাচীন রাজধানী হয়ে ওঠেনি! শিমোগামো মন্দিরে এসে মানুষ অর্চনা করে দুজনের – তামাইয়োরি-হিমে আর তার পিতা দেবতা তাকেৎসুনোমির। তামাইয়োরি-হিমে আর আগুন-ও-বিদ্যুতের দেবতা হোনোইকাযুচি-নো-মিকোতোর ভালোবাসার ফসল কামো ওয়াকাইকাযুচির জন্য বিদ্যমান কামিগামো মন্দির। তামাইয়োরি-হিমে আর হোনোইকাযুচি-নো-মিকোতোর মিলনের এই পুরাকথার রেশ ধরেই রোজ পাণিপ্রার্থীদের আগমন শিমোগামো মন্দিরে।
এই কনপিরাগু আর শিমোগামো আর কামিগামোর, সর্বজাপানেরই দেবতাদের তাদের মন্দিরগুলোতে অবশ্য পাওয়া যাবে না দশম চন্দ্রমাসে, যেটাকে বলা হয় কান্নাযুকি(দেবতাশূন্য মাস)। দেবতারা তাদের ভক্ত আর উপাসকদের সকল ইচ্ছা-আকাঙ্খা-কামনা-বাসনা-আর্জি নিয়ে হাজির হয় ইযুমো শহরের ইযুমো-তাইশা মন্দিরে। পরবর্তী বছরের জন্ম-মৃত্যু আর বিয়ের ভাগ্য লিখন নিয়ে দেবতাদের সম্মেলন বসে সেখানে। সে শহরের অবশ্য এই মাসেরই নাম আবার কামিআরিযুকি(দেবতাদের মাস)। সম্পর্ক জুড়তে চাইলে এটাই তো সময়!
কিন্তু বারবার যে ভজকট পাকিয়ে ফেলে ওয়াতাশি! আকাশির সাথে কচ্ছপ-মাজনী খুঁজতে ঘুরে বেড়ায় কাওয়ারামাচিতে। শিমানামি বাইকরেস চলার মাঝে তাদের দেখা হয় কেয়াগে ঢালের পাশের রাস্তায়। আবার কখনো ওযুর ফাঁদে পরে, কখনো বা সত্যি সত্যিই চেরী সাইকেল ক্লিনার কর্পসের নেতা হিসেবে এখানেই ধরা পরে যায় আকাশির হাতে। মজার ব্যাপার হলো কেয়াগে ঢাল ঘুরতে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময় হলো বসন্তকাল, যখন এই ৫৮২ মিটার দীর্ঘ আর উপর থেকে নিচে ৩৬ মিটার উঁচু ঢাল দিয়ে হেঁটে গেলে দেখা মিলবে সারি বেধে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের ডালে ডালে ফুটতে থাকা চেরী ফুলের। ঢালটির উপর দিয়ে চলে গেছে রেললাইন, যাতে করে একসময় নিচে বিওয়া হ্রদের ক্যানেল থেকে উপরে কেয়াগে স্টেশন পর্যন্ত জলযান উঠানো নামানোর হতো। সেই পানিপথ অনেক কাল যাবত বন্ধ দেখেই কিনা বার্ডম্যান সঙ্ঘের উড়োজাহাজ চুরি করে নিয়ে যাওয়ার কাজে চেরী সাইকেল ক্লিনার্স কর্প সেটা ব্যবহার করা শুরু করলো! ঢাল বেয়ে নামতে নামতে উড্ডয়ন হলো ওয়াতাশির…তারপরই তো আবার পানিতে মুখ থুবড়ে পড়া।
Hibike! Euphonium:নো-ওয়েইস্টেড-শট! — Fahim Bin Selim
একটা ভালো অ্যাডাপ্টেশন হওয়ার জন্য কী প্রয়োজন? অনেক বেশি সংখ্যক অ্যানিমে ফ্যান, এবং সামগ্রিকভাবেই ভিজুয়াল ফিকশনের ফ্যানরাই ভালো অ্যাডাপ্টেশন বলতে সম্ভবত বুঝে তার সোর্স ম্যাটেরিয়ালকে পুরোপুরিভাবে অনুসরণ করাকে। কিন্তু সেটা কি তার গল্প বলায় একটা সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করে না? কারণ শেষ পর্যন্ত, “অ্যাডাপ্টেশন” মানেই তো নতুন পরিস্থীতি, নতুন মাধ্যমের সাথে মানিয়ে নেওয়া – গল্পের বিন্যাস, কাঠামো আর বর্ণনা পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে হলেও। কারণ, অবশ্যই, বইয়ের পাতার লেখার মাধ্যমে গল্প বলা, আর টেলিভিশন, সিনেমার পর্দায় ছবি আর শব্দের মিলনে তা বলার মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য আছে। একই সাথে পার্থক্য আছে, আসলেই গল্প “বলাতে”, এবং তা কেবল “দেখানো”-র মাঝেও। ছবি আর শব্দের মেলবন্ধন – আর তা যদি ভালোভাবে ব্যবহার করা যায়, অ্যানিমেশনের সম্ভাবনা অসীম, তৈরি হয় আসলেই ত্রিমাত্রিক অনুভূতির এক জগৎ। কিন্তু অবশ্যই এক্ষেত্রে গল্প বলার ক্ষেত্রে পরিচালকের কল্পনাশক্তির প্রাচুর্য্য থাকা জরুরী, যেহেতু ছবি এবং শব্দের উপস্থিতি দর্শকদের নিজেদের কল্পনাশক্তি ব্যবহারের সুযোগ অনেকাংশে কেড়ে নিচ্ছে। এবং এটা আরো বিশেষভাবে, যখন একটা উপন্যাসকে অ্যাডাপ্ট করা হয়। কারণ এখানে মাঙ্গার মত আর চরিত্রদের চেহারা, তাদের অঙ্গভঙ্গি কিংবা তাদের আশেপাশের জায়গাগুলোর টেমপ্লেট আগে থেকেই দেওয়া থাকেনা। পুরোপুরিই পরিচালকের নিজের ইন্টারপ্রেটেশনের উপর নির্ভর করে। একজন পরিচালকের প্রতিভার পরিচায়ক তো কেবল সুন্দর কোন গল্প বলাতে নয়, কোন গল্পকে সুন্দরভাবে বলাতেই!
এখানে আর বাকি সব কিয়োঅ্যানির অ্যানিমের মত সুন্দর অ্যানিমেশন আর ভিজুয়াল উপস্থিত, হয়তো মাঝে মাঝে তুলনামূলক কম ভালোও। কিন্তু Hibike-’র শক্তি বরং এর গল্পবর্ণনায়। এর মূল গল্প বড় এক নভেল সিরিজ থেকে নেওয়া, একারণে গল্প আর চরিত্র – উভয়ের গভীরতাই তুলনামূলক বেশি। কিন্তু এই কারণেই বরং তার পুরোটা টিভির পর্দায় ফুটিয়ে তোলা আরো অনেক, অনেক বেশি কঠিন! কিয়োঅ্যানির ফ্ল্যাগশিপ পরিচালক তাৎসুইয়া ইশিদার কাছ থেকে আসায় যদিও এর সাফল্য নিয়ে আশাবাদী হওয়াটা যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু তার পরও, ইশিদার বাকি সব অ্যানিমের চেয়ে Hibike আলাদা। Air, Clannad, Haruhi -‘র মত Hibike-তে বড় এনসাম্বলের কাস্ট থাকলেও, এর গল্প অনেক বেশি কানেক্টেড, কমপ্যাক্ট…বাস্তবিক! ফ্যান্টাসি জনরা গায়ে না লেগে থাকা একটা বড় কারণ, কিন্তু এটা বাদ দিলেও Hibike-’র প্রতিযোগীতা, সাফল্য আর ব্যর্থতার গল্প পরিচিত। গল্পবর্ণতাতে আছে আলাদা একটা নিজস্বতা। কেবল “দেখানো”-তেই সীমাবদ্ধ না, Hibike তার গল্পের বড় একটা অংশ “বলে” তার ভিজুয়াল দিয়ে।
“ক্যামেরা”-’র ব্যবহারটাই চিন্তা করা যাক, Hibike-তে ফোকাসিংকে কাজে লাগানো হয়েছে শিল্পের পর্যায়ে। পুরোটা সময় ঘোলাটে ব্যাকগ্রাউন্ড আর চরিত্রদের চেহারার উপর পূর্ণাঙ্গ ফোকাসই বলে দিবে মনোযোগটা কোথায় রাখা জরুরী। কিয়োঅ্যানিমের আর বাকি সব অ্যানিমে থেকেও তো একে এই এক বিষয় দিয়ে আলাদা করা যায়! কুমিকো গল্পের ন্যারেটর, তার স্বগোক্তিতেই সব বলা, প্রতি পর্ব শুরু আর শেষও তা দিয়ে। তার মাথার ভেতর, বিক্ষিপ্ত চিন্তাভাবনা আর স্মৃতি, কুইক-কাট ট্রানজিশনে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে নিয়ে যায়। কুমিকো যদিও বেশিরভাগ সময়ই আশেপাশে চলমান ঘটনার পার্শ্বচরিত্র; প্রভাবক, নীরব দর্শক আর গুপ্ততথ্যের রক্ষক। She sees everything and she understands. একজন ওয়ালফ্লাওয়ার! যার জন্য উপন্যাসের পাতা ভর্তি লেখা প্রয়োজন, তার জন্য এখানে একটি শব্দেরও প্রয়োজন হয় না; চরিত্রদের মুখের অভিব্যক্তি আর প্রতিক্রিয়া অনুসরণ করলেই হবে। নো-ওয়েইস্টেড-শট!
দ্বিতীয় সিজনের তৃতীয় পর্ব এর একটি ভালো উদাহরণ। এই পর্বের শুরুটা কুমিকোর মনোলোগ দিয়ে, কানসাই কম্পিটিশনের আগে শেষ প্রস্ততি পর্ব। কুমিকো আর আসুকার ছোট কথোপকথনের পরবর্তী ৩ঃ১৬-৩ঃ১৬ এ তিন সেকেন্ডের ট্রানজিশন, আর তার সাথে সাথে কুমিকোর এক্সপ্রেশন, সম্পূর্ণ ভিন্ন দুইটি সময় আর জায়গার মধ্যে সংযুক্তি। কোন এবরাপ্ট কাট না যেটা গল্পের গতি নষ্ট করে দিবে, অথবা কোন দীর্ঘায়িত অপ্রয়োজনীয় শট না, বরং দুটো একত্রে মিলিয়ে দেওয়া, গল্পের প্রবাহ বজায় রাখার জন্য! অথবা তার পরবর্তী দৃশ্য, আসল পারফর্মেন্সের আগে শেষবারের মত সব পারফর্মারদের একসাথে থাকা শেষ দৃশ্য। নিয়ামা আর হাশিমোতো-সেনসেই এর বিদায়ী ভাষন, উপদেশ। ক্যামেরা একজনের থেকে আরেকজনের পারস্পেকটিভে বদলাতে থাকে অনবরত, কার কোন কোন দূর্বলতা জানান দেয়, এবং তার সাথে সাথে পারফর্মারদের প্রতিক্রিয়া। কুমিকোর চেহারার অবিশ্বাস, আনন্দ, ভয় এবং একই সাথে অস্থিরতা ইউফোনিয়াম সোলোর অংশ হওয়ার খবর পাওয়ায়, রেইনার সন্তুষ্টির অভিব্যক্তি। কিংবা ইয়োরোইযুকার চোখে হাতের ওবোর দিকে স্থির, রোবোটিক দৃষ্টি, যখন হাশিমোতো তাকে যান্ত্রিকভাবে বাজানো বাদ দিয়ে আরো বেশি “এক্সপ্রেসিভ” হওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু তার জন্য তো “এক্সপ্রেস” করা সব সময়ই কষ্টকর ছিলো, সংগীত কিংবা শব্দ দিয়েও। তা তার গতবাঁধা জবাবেই আটকানো, “I’ll try to do better.” ব্যাকগ্রাউন্ড ফোকাসে ইউকোর চেহারায় অনিশ্চয়তা! প্রিয় মানুষের জন্য!
গল্পটা কুমিকোর মাথার ভেতরে, তাই তো সবকিছু সামনে থেকে দেখা হয় না। রেইনা যখন তাকি-সেনসেইকে নিয়ামা-সেনসেইয়ের সাথে তার সম্পর্কের কথা জানতে চেয়ে প্রশ্ন করে, আগুনের অপর পাশে। তাদের কথা শোনা যায় না, পর্দায় কেবল দূর থেকে রেইনা আর তাকির শব্দহীন অভিব্যক্তি। কিন্তু অবশ্যই Hibike এই মুহূর্তটা অপচয় করবে না। বরং এপাশে সমান্তরালে হাশিমোতো-সেনসেইয়ের সাথে কুমিকোর কথোপকথন চলতে থাকে। তাকি-সেনসেই এরই অতীত নিয়ে! একই সাথে শব্দ আর ছবি দিয়ে দুটো আলাদা গল্প বলা! কনসার্টেশনে, কোনভাবেই ইনফরমেশনের ওভারফ্লো না, ইকোনমিক! কিংবা আসুকাকে আঁকড়ে ধরা নস্টালজিয়ার প্রতিটি মুহূর্ত, হাইস্কুলের শেষ বছরে এসে। যদিও তা মুখ ফুটে কেবল বেরোয় না সরাসরি। ক্লাবকে আগলে রাখার প্রতিটি চেষ্টায়, প্রতিটি ধাপ পেরোনোর আনন্দের বিহবল হওয়ার পরবর্তী নীরবতায়, অবশ্যম্ভাবী বিদায়ের কথা মনে পড়ায়, গ্রাস করা বিষাদ ঠিকড়ে বেরোয় তার হাসির পেছন থেকে, আর যখন সে বলে, “I wish this summer would never end”।
কিন্তু সবচেয়ে বড় উদাহরণ অবশ্যই এর পারফর্মেন্সের দৃশ্যগুলো! মিউজিক অ্যানিমের সাফল্যের জন্য তো অসাধারণ সঙ্গীতেরই দরকার সবার আগে! Hibike এইক্ষেত্রে বরং Showa Genroku-’র সাথে তুলনীয়। Hibike-’র সঙ্গীতের বিচারক দর্শক নিজেরাই! কোন শর্টকাট না, এমনকি ৮ মিনিটের লম্বা পারফর্মেন্সেও! প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি বিট অ্যানিমেটেড। আর মনে রাখার মত ব্যাপার, অন্যান্য আর বেশিরভাগ অ্যানিমের মত Hibike-’র সঙ্গীত একক পরিবেশনা না, দলীয়! কন্ডাকটরের হাতের নির্দেশনা, প্রতিটি পারফর্মারের চলমান হাত অথবা মুখ, অথবা দুটোই, সঙ্গীতের সাথে মূর্ছনায়; নড়তে থাকা, সামনে, ব্যাকগ্রাউন্ডে একসাথে; ট্রামবোন, ট্রামপেট, টিউবা, ক্ল্যারিনেট, হর্ন, ট্রিমপানি, চাইম, টামবুরিন, ওবো, ফ্লুট, বেস, ইউফোনিয়াম! একসাথে চলতে থাকা! কোন স্ট্যাটিক শট না! আবার যখন রেইনার সোলোর দৃশ্য আসে, তখন পর্দায় রেইনার কল্পনায় ভেসে স্টেজ আর পাহাড়ের কিনারায় মিশে এক হয় কুমিকোর সাথে ফেস্টিভালের সেই রাতের দৃশ্য, কারণ এই পারফর্মেন্স তো তার জন্যই! অথবা ইয়োরোইযুকার কল্পনায় নোজোমি। কাওশিমার সামনে রাখা স্ট্যান্ডে বন্ধুদের সাথে তার ছবি। তাকি-সেনসেইয়ের সামনে তার স্ত্রীর। সবারই আলাদা আলাদা গল্প!
সামনে বসে থাকা দর্শকরা ফোকাসের বাইরে, পেছনে ব্যাকস্ট্যাজে বন্ধুদের বিচলিত পায়ের নড়াচড়া কেবল। আর এই দূর্দান্ত পরিবেশনার পরের দৃশ্যটাই কী? প্রথমে সবার হাঁপাতে থাকা চেহারা, বন্ধুদের কান্নার দৃশ্য, আর সবার শেষে দর্শকদের করতালি। আর তা ক্ষীন হতে হতে সরাসরি এন্ড ক্রেডিট। কারণ শেষ পর্যন্ত এটা তো তা-ই ছিলো, যা উপন্যাসের পাতায় কখনোই বোঝানো সম্ভব না, পাতার পর পাতা বাক্য দিয়ে ভরে ফেললেও, একইসাথে শব্দ আর চিত্রের পরিবেশনায়ঃ শ্বাসরুদ্ধ, চিত্তসম্মোহিত আর হতবিহবল করা।
নো-ওয়েইস্টেড-শট!
91 Days (2016) রিভিউ — Fahim Bin Selim
91 Days(২০১৬)
★★★★☆
পরিচালনাঃ কাবুরাকি হিরো(Tonari no Kaibitsu-kun, Kimi ni Todoke, Hoozuki no Reitetsu)
মৌলিক গল্প
পর্ব সংখ্যাঃ ১২
জনরাঃ অ্যাকশন, ড্রামা, হিস্টোরিকাল
প্রযোজনাঃ স্টুডিও শুকা(Durarara x2, Natsume Go)
১৯২০; আমেরিকায় প্রোহিবিশন এরার শুরু। ১৮তম সংশোধনীর প্রেক্ষিতে “ড্রাই ক্রুসেডার”-দের নেতৃত্বে দেশজুড়ে অ্যালকোহলিক পানীয়ের তৈরি, আমদানী, পরিবহন কিংবা বিক্রি নিষিদ্ধ করে দেওয়া হলো। পন্য খোলাবাজারে নিষিদ্ধ হওয়া মানে স্বভাবতই তার জায়গা হলো কালোবাজারে। আর তখন পর্যন্ত মাফিয়াদের মূল ব্যবসা পতিতালয় আর জুয়াড় আসরকে ফেলে প্রথম স্থান দখল করলো মদ্যপানের চালান। যার কাছে যত স্থায়ী, শক্তিশালী পানীয়ের মজুত, তাদের হাতেই শহরের দায়িত্ব!
ল’লেস, ইলিনয়। নামের স্বার্থকতা রক্ষার্থেই তাতে আইনের কোন বাধা ধরা নেই, অন্তত প্রচলিত অর্থে। বরং এখানকার আইনের বিধানকর্তা তার মাফিয়া পরিবারগুলো – ভানেত্তি আর অর্কো। তার ব্যাত্যয় ঘটলেই লাশ পরা সুনিশ্চিত; দিন-রাতে, খোলা রাস্তায়, পাব, নিজের ঘরে। ‘পরিবার’-কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই পরিবারের জন্যই ভানেত্তি পরিবারের অংশ অ্যাঞ্জেলো লাগুসা ছোটবেলায় বাবাকে খুন হতে দেখলো তার বাবার নিজের বন্ধু ভিনসেন্ট ভানেত্তির হাতে। সাথে তার মা আর ছোটভাইকেও – পুরো পরিবার একসাথে! ভাগ্যক্রমে একমাত্র বেঁচে যাওয়া অ্যাঞ্জেলো সাতবছর পর ফিরে আসলো ল’লেস-এ। প্রতিশোধের নেশায়, ব্রুনো আভিলিও ছদ্মনামে। এই ভানেত্তি পরিবারের ঢুকে যেতে। ভেতর থেকে একে একে খুন করতে, তালিকা ধরে, যারা খুন করেছিলো তার পরিবারকে। তার প্রবেশপত্র? ল’লেস হেভেন, শহরের সেরা মদ। যার প্রস্তুতকারক তার বাল্যকালের বন্ধু কর্তেও।
৭ বছর অপেক্ষার পর অ্যাঞ্জেলোর – আভিলিওর…৯১ দিনের শীতল প্রতিশোধ পরিবেশনের গল্প!
আমেরিকা আর ত্রিশের দশক, মাফিয়া, প্রতিশোধ গল্প – কোন অ্যানিমের আগে বরং স্করসেসি[১] কিংবা কোপোলার[২] চলচ্চিত্রের কথাই মাথায় আসার কথা সবার আগে! এবং তারপর যখন দ্বিতীয় পর্বে শিকাগোর গালাসিয়া পরিবারের রোনালদোর সাথে ভিনসেন্টের মেয়ে ফিও ভানেত্তির বিয়ের অনুষ্ঠানে অ্যাঞ্জেলো উপস্থিত হয়, নাচের দৃশ্য আর ভেতর অন্ধকার রুমে বসে থাকা ভিনসেন্ট ভানেত্তিকে দেখে ডন কর্লেওনি(Godfather[৩]) ভেবে ভুল হওয়া অস্বাভাবিক না। অথবা টাইটল স্ক্রিনের লোগোটার কথাই ধরা যাক। হেনরি হিলের(Goodfellas[৪]) মত সিসেরোর…না, না, কস্টিগানের(The Departed[৫]) মত কস্তেওদের সাথে অ্যাঞ্জেলোর মিশে যাওয়া! 91 Days এর অনুপ্রেরণা তো কোপোলা আর স্করসেসিতেই। এবং গল্পবর্ণনাতেও এই প্রভাব লক্ষনীয়। পর্বে পর্বে ক্লিফহ্যাঙ্গার আর একের পর এক অননুমেয় গল্প উপাদান, টিভি সিরিজের তুলনায় বরং সাড়ে চার ঘন্টার একটার মুভির সাথেই একে তুলনা করা যায়।
আর অ্যাঞ্জেলোর যাত্রাটা শুধু ক থেকে চন্দ্রবিন্দুতে গিয়েই শেষ না, নিজের অজান্তেই ল’লেস-এর অন্ধকার মাফিয়া জগতের মাকড়সার জালে ধীরে ধীরে পেঁচিয়ে যাওয়ায়। লম্বা সময় ধরে মিথ্যা অভিনয় করতে থাকো, সেটা একসময় বাস্তবতা হয়ে দাঁড়াবে। অ্যাঞ্জেলোর রেইসন দে’ত(Raison d’etre), বেঁচে থাকার একমাত্র অনুপ্রেরণা এই প্রতিশোধই, আর সেটা ছাড়া সে যেন এক অন্তস্বারশুন্য খোলের মত। সেও অংশ হয়ে যায় ল’লেস-এর মাফিয়া যুদ্ধে। লাল পানি আর রক্তের খেলায় – প্রতিশোধ সেখানে মধ্যবিরতির আকর্ষন কেবল। কাটা পরতে থাকে তালিকার বাইরের অনেক নামও।
গল্পের মূলচরিত্র, কিন্তু অ্যাঞ্জেলোর মাথার ভেতরে কখনো আমরা ঢুকতে পারি না, তার মনোলোগের অংশ হই না, কিংবা জানিনা তার পরবর্তী পরিকল্পনা কী। প্লেহাউসের উপর তলায় বসে কোন অপেরার মত অ্যাঞ্জেলোর এই অভিনয় আমরা দেখি বাইরে থেকে। গল্পের মূলচরিত্র, কিন্তু কোন পর্যায়েই অ্যাঞ্জেলো গল্পের ‘নায়ক’ না, বরং ফিল্ম-নয়ারের নিয়ম মেনে আর বাকিসব চরিত্রের মতই অ্যাঞ্জেলোর বিবেকবিচার আর কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ। এটাই গল্পের অননুমেয়তা আর বিষ্মিত করার প্রধান অস্ত্র। কস্টিগানের মত অ্যাঞ্জেলোর এই অভিনয় ‘খেলার’ পেছনে কোন ‘গ্রেটার গুড’ নীহিত নেই। তার পুরো যাত্রাটাই ব্যক্তিগত, স্বার্থপরতার। একাকীত্বের।
কস্টিগান – অ্যাঞ্জেলোর এই প্রতিশোধ চক্রের ব্যাসের অপর পাশেও একজন কলিন আছে – নেরো ভানেত্তি, ভিনসেন্টের ছেলে। নেরো বরং অ্যাঞ্জেলোর চেয়ে আরো বেশি জীবন্ত এক চরিত্র। অ্যাঞ্জেলোর প্রতিশোধ তালিকায় কাটা যেতে থাকা নামের সংখ্যা বাড়তে থাকার মানে হলো তার পরিচিতদের মৃত্যুর তালিকা ক্রমাগত বড় হওয়া। তবে এই তিনমাসের গল্প নেরোর জীবনটা উল্টেপাল্টে যাওয়ার, অ্যাঞ্জেলোর সাপের মত আষ্টেপৃষ্ঠে ধরা পরিকল্পনার কেন্দ্রে তো সে নিজেই! তার ছলচাতুরির ফাঁদে পরা সবচেয়ে বড় শিকার। তার দাবার গুটির শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখা স্যাক্রিফাইসিং পন। বরং নেরোকেই গল্পের ট্র্যাজিক হিরোর উপাধি দেওয়া যায়। তার অভিনয়টা অবশ্য তিনমাসের জন্য না, সারাজীবন ধরে চলা। বারুদ আর রক্তের গন্ধ। বিশ্বাসঘাতকতা আর অবিশ্বাসের এক জগতে। পরিবারের সাথে মিশে যাওয়ার…টিকে থাকার জন্য। পরিবারের জন্য। তার যাত্রাটা সম্পূর্ণ বিপরীত – আত্নবিসর্জনের। তবে একাকীত্বেরও!
স্করসেসির মাফিয়াদের মত অ্যাঞ্জেলোর জীবনটা অবশ্য অতটা অবশ্য জাঁকজমকের না, অনেক বেশি গ্রাউন্ডেড। তার পতনটা যে অনিবার্যতায় ঘেরা। 91 Days-এর পরিবেশনাও সাধারণ। বেশিরভাগ সময় আবহসঙ্গীতবিহীন, জ্যাজ আর অর্কেস্ট্রা সেখানে প্রবেশ করে কদাচিৎ। বরং তার স্থানে জায়গা করে নেওয়া বাইরের যান-বাহন আর কোলাহলের শব্দ ল’লেস-এর মাফিয়াদের বাইরেরও আলাদা সাধারণ জীবনটা সম্পর্কে জানান দেয়। রক্তপাত, বিশ্বাসঘাতকতা আর ছলচাতুরিবিহীন, আসলেই পরিবারের সাথে একসাথে থাকা এক জীবন।
কিন্তু উপরতলার বিধান কর্তাদের সেখানে প্রবেশ করা নিষেধ। প্রতিশোধের নেশায় পাগল হওয়া মানুষদেরও।
১ – [https://en.wikipedia.org/wiki/Martin_Scorsese]
২ – [https://en.wikipedia.org/wiki/Ford_coppola ]
৩ – [https://en.wikipedia.org/wiki/The_Godfather]
৪ – [https://en.wikipedia.org/wiki/The_Departed]
৫ – [https://en.wikipedia.org/wiki/Goodfellas]
আসানো ইনিও – মাঙ্গায় সাহিত্য-বাস্তবতা — Fahim Bin Selim
সাধারণভাবে কমিকবই অথবা মাঙ্গাকে সম্ভবত সবসময়ই হালকা শিল্প হিসেবে ধরা হয়ে এসেছে। একই সাথে সাহিত্য আর চিত্রকর্মের সংযোগ, কিন্তু কোনটাই পুরোপুরি না। লেখা ও ছবি দুটোই ব্যবহার করায়, কমে যাওয়া পাঠকের উপর অর্পিত ভাবনা আর কল্পনার সুযোগও। আমেরিকার সুপারহিরো কিংবা জাপানের কিশোর-নায়ক – বরং প্রচলিত কমিকবই, মাঙ্গার সাথে টেলিভিশন সিরিজ অথবা ম্যাগাজিনের ধারাবাহিক গল্পের তুলনাটা বেশি যুক্তিযুক্ত; নির্দিষ্ট কিস্তিতে অনেক সময় ধরে প্রকাশ হয় বলে বাজারে কাটতি ধরে রাখা অপরিহার্য ব্যাপার যেখানে, শিল্পের পাশাপাশি টিকে থাকার জন্য ব্যবসায়িকও চিন্তাটাও। বাস্তবতা থেকে টেনে নিয়ে বিমোহিত করা ফ্যান্টাসি গল্প, কিংবা পাতার পর পাতা লোমখাঁড়া করা অ্যাকশন দৃশ্য – এমনকি ভালোবাসা, বেড়ে ওঠা আর জীবন সংগ্রাম নিয়ে স্লাইস-অফ-লাইফ গল্পের ঘাটতিও জাপানের কখনো ছিলো না। কিন্তু আসানো ইনিওর রীতি ভাঙ্গার চেষ্টাটা তার গল্পের জনরাতেও না, গল্পের ধরনেও না — তা আরো সুক্ষ্ণ — গল্প বর্ণনায়, তার চরিত্রের উপস্থাপনায় লুকানো।
ইনিওর মাঙ্গায় বারবার ঘুরে ফিরে আসে পুরোপুরি কালো প্যানেলে কেবল ন্যারেশন কিংবা মোনোলোগ, সাহিত্যের কাছাকাছি যাওয়া সবসময়ই হয়তো তার চেষ্টা ছিলো। শুরুটাও সাহিত্যিকদের মত ছোট ব্যপ্তীতে, কতগুলো ওয়ান-শট মাঙ্গা দিয়ে। ধীরে ধীরে হাত শানিয়ে নেওয়া, নিজের জীবন থেকে টেনে আনা গল্পতে। এই সময় ইনিও মাত্র বিশের ঘরে পা রাখা যুবক। বেশিরভাগ গল্পতেই তাই স্লাইস-অফ-লাইফ, সেইনেন, এই দুই জনরা উপস্থিত। প্রথম দিকের ধারাবাহিক মাঙ্গা Solanin(২০০৫-২০০৬) আর Hikari no Machi[City of Lights](২০০৪)-তে আধুনিক শহুরে জীবনকে কাছ থেকে তুলে আনার চেষ্টা। ঘটনাকেন্দ্রিক না হয়ে ইনিওর মূল দৃষ্টি বরং তার চরিত্রদের উপর, চ্যাপ্টার ভেদে গল্প-বর্ণনার পয়েন্ট-অফ-ভিউ পরিবর্তিত হওয়া, ওমনিবাস ন্যারেটিভে হালকাভাবে সংযুক্ত অনেকগুলো সুতো দিয়ে ধীরে ধীরে মাকড়সার জালের মত শক্ত একটা গল্প-কাঠামো তৈরিতে।
Solanin-এর মূলচরিত্র মেইকো যেমন জীবনের যান্ত্রিকতা থেকে মুক্তি পেতে দুই বছরের চাকরি ছেড়ে দেওয়া ২৪ বছরের এক যুবতী, ইনিওর বয়সটাও এসময় ২৪-ই। কৈশোর আর তারুণ্যের নদী পেরিয়ে জীবনসমুদ্রের অথৈজলে প্রথম অভিগমনের অভিজ্ঞতা এ মাঙ্গার পাতায় পাতায় — ভালোবাসা আর জীবন নিয়ে উদ্বেগ আর আশংকা, যখন প্রথমবারের মত নৌকাটার দাঁড়টা নিজের হাতেই, আর তার প্রতিটি টানের পরিণামও। নিজের স্বপ্ন আর সামর্থ্য নিয়ে চিরন্তন অন্তর্দ্বন্দ্বে আটকা থাকা। “Freedom without purpose feels a whole lot like a burden” – কালো প্যানেলের ন্যারেশনে মেইকোর স্বগতোক্তি আঁকা থাকে। মেইকোর সাথে সাথে হয়তো ইনিওর নিজেরও। শিল্পী হওয়ার চেষ্টাটা যখন সবসময়ই অনিশ্চয়তার এক পথ। “Maybe what you really want is something dreamy and unreal, and you are hesitating because of that.”
সাহিত্য-বাস্তবতা নিয়ে কাজ করলেও এই ড্রিমী এবং আনরিয়েল সুরা আর পরাবাস্তবতার ইনিওর গল্পে প্রবেশ করেছে হরহামেশাই। তার অ্যাবসার্ডিস্ট কমেডির হাত ধরে। Subarashi Sekai![What a Wonderful World!](২০০২-২০০৪) আর Sekai no Owari to Yokomae[Before Sunset and the End of the World](২০০৫-২০০৮), তার দুই গল্প-সংকলন, এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। প্রতি চ্যাপ্টারে আলাদা আলাদা চরিত্র আর তাদের গল্প। সদ্য মৃত্যু বরণ করা উড়ে বেড়ানো কোন আত্নার নতুন চোখে জীবনকে দেখা। কিংবা স্কুলে যাওয়ার পথে কাকের সাথে কোন মেয়ের কথোপকথন। আবার কোন তরূণীর বৃষ্টিস্নাত তন্দ্রায় এসে হাজির হয় মুরাকামির ব্যাঙ। ব্যর্থ এক মাঙ্গাকার অনেক বছর পর স্কুলের পূণর্মিলনীতে গিয়ে দেখা হয় ছোটবেলার প্রথম ভালোবাসার সাথে, এখন যখন সে অন্য এক বন্ধুর স্ত্রী।
“Sometimes I think if I open my eyes, I’ll be a kid again and none of this will have happened.
But this has happened. And this is the only me there is,” গ্রাস করা অনুশোচনা অথবা হতাশা।
জীবন কখন ছকে বাঁধা ছিলো? অথবা অনুমিত?
ইনিওর গল্প থেকে ঠিকরে বেড়োয় স্মৃতিকাতরতা। কৈশোরের বন্ধুত্ব আর প্রেম নিয়ে।
Umibe no Onnanoko[A Girl on the Shore](২০০৯-২০১৩)-র মত হয়তো তা কেবলই দৈহিক। র’ আর অনেস্ট। ভেঙ্গে পড়া মানুষের মাথার ভেতর ঢুকে যাওয়া। ভালোবাসার সংঙ্গাটাকে পুনর্নির্ধারনের চেষ্টায়। সোফিয়া কোপোলার Lost in Translation এর প্রাপ্তবয়স্ক হ্যারিস আর শার্লটের নিষ্পাপ ভালোবাসার সাথে বৈপরিত্য টানতেই যেন তখন ইনিওর হাতের কলম এঁকে বেড়ায় কৌশরে পা রাখা ইসোবে আর সাতৌর ব্যক্তিগত সব মূহুর্তে; Kafka on the Shore-এর কাফকা তামুরার মত সেক্সুয়ালিটি নিয়ে কৌশোরের দূর্নিবার কৌতুহলে। তাদের একাকীত্ব আর অবসন্নতায় ভর করা কোন দুপুরে, কানের হেডফোনে যখন বাজতে থাকে Kaze wo Atsumette.
Nijigahara Holograph(২০০৩-২০০৫)-এ সেটা আবার সাইকোলজিক্যাল হররে রূপ নেওয়া। নিষিদ্ধ কোন সম্পর্কে। আপাত সাধারণ জীবনের মাঝে হঠাৎ মাটি খুঁড়ে বের হওয়া কোন পুরনো, লুকানো, স্মৃতি। যেন সাদা কালো কালিতে আঁকা ডেভিড লিঞ্চের কোন ফিল্ম। টুইস্টেড আর আননার্ভিং। কিন্তু বাস্তব আর জীবন্ত।
Oyasumi Punpun[Goodnight Punpun](২০০৭-২০১৩)-এ পুনপুন আর আইকোর ভালোবাসাটা শৈশবের শুভ্র সাদা কাপড়ে মোড়ানো, সহজ এবং সরল। তাদের প্রথম শপথের মত, “Punpun, if you ever betray me, I’ll kill you.” এবং পুনপুনেই প্রথমবারের মত “সাহিত্যিক” ইনিওর বড় গল্পের পথে পা বাড়ানো। ১৪৭ চ্যাপ্টার আর ১৩ ভলিউমে, পুনপুন তো একটা উপন্যাসই! Oyasumi Punpun পুনপুনের জীবনের পিছে ঘুরে বেড়ায় একেবারে শৈশব থেকে। কোন রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে নভোচারী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা জন্মানোর মূহুর্তে, স্কুলে নতুন বদলি হয়ে আসা কোন বালিকার প্রেমে পরে যাওয়াতে, অথবা বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বেড়োনো কোন সন্ধ্যায় পরিত্যক্ত এক দালানের ছাদে অতিপ্রাকৃতের মুখোমুখি হওয়ায়। আবারো কালো প্যানেলে ন্যারেশন লেখা উঠে, কিন্তু কখনো পুনপুনকে আমরা কথা বলতে দেখি না, অথবা দেখি না তার আসল চেহারা। পুনপুনের ভাবনাগুলো জানতে পারি মধ্যম পুরুষে। পুনপুনের বুলিতে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় আফ্রো চুলের জাপানী এক ঈশ্বর! হয়তো অনির্ভরযোগ্য সত্যতায়। পুনপুনই যেখানে চুপচাপ, লাজুক এক ওয়ালফ্লাওয়ার, তখন সেটাই তো স্বাভাবিক! মাঙ্গাতে উত্তর-আধুনিক আখ্যানের আবির্ভাব!
ইনিও অনুসরণ করে পুনপুনের স্বপ্নগুলোকেও। ছোটোবেলার নভোচারী হওয়া থেকে যা কৈশোরে বদলে যাওয়া মাঙ্গাকা হওয়ার ইচ্ছায়। অথবা আরো পরে, যখন চোখে অগুণিত সম্ভাবনার স্বপ্নালুতার বদলে জায়গা করে নিয়েছে ব্যর্থতার শূন্যতা। থাকে পুনপুনের ভাঙন ধরা পরিবার, হারানো ভালোবাসা আর আলগা হওয়া বন্ধুত্বের গল্পে।
বেড়ে ওঠা কখন সহজ ছিলো? অথবা নিখুঁত?
এবং পুনপুন বেড়ে ওঠার গল্প, কামিং-অফ-এজ এর অনবদ্য উদাহরণ; শুধু মাঙ্গা না, সাহিত্য…শিল্পের যেকোন মাধ্যমেই অন্যতম সেরা।
ইনিও তার চরিত্রদের চিন্তাভাবনার ব্যবচ্ছেদ করে। পাঠকদেরও। তার গল্পগুলো কখনোই এসকেপিস্ট ফ্যান্টাসী না। ব্যাকগ্রাউন্ডে ব্যবহার করা তার নিজের ক্যামেরায় তোলা আসল রাস্তাঘাট আর ঘরবাড়ির ছবিগুলো বারবার বাস্তবতায় টেনে আনবে। সব উদ্ভট রসিকতা আর সুরা-পরা-বাস্তবতার আড়ালে ইনিওর চরিত্ররা চিন্তা করে সত্যিকারের মানুষের মত, কথা বলে সত্যিকারের মানুষের মত। তাদের সংগ্রামগুলোও সত্যিকারের মানুষের। মেইকো, ইসোবে অথবা পুনপুনের জীবনে – তাদের বেড়ে ওঠায়, বেড়ে ওঠার পর পেছনে ফিরে তাকানোয়, অথবা অনিশ্চয়তায় ঘেরা ভবিষ্যতে; স্কুলের টিফিনে বন্ধুদের আড্ডায়, প্রথম প্রেমে পরায়, অথবা তারূণ্যের জটিলতায়; বন্ধুত্বের ভাঙ্গা-গড়ায়, অনেক কাছের মানুষকে ভুলতে শেখায়; স্বপ্ন দেখায়, তা ভাঙতে জানায়, নতুন স্বপ্নে বিভোর হওয়ায়; মন্ত্র পড়ে ঈশ্বরকে ডাকার চেষ্টায়, পৃথিবীর সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কামনায়; ছোটবেলায় বড় হওয়ার বাসনায়, বড় হয়ে স্মৃতিকাতরতায় ভোগায়; মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখায়, নতুন জীবনের সাথে পরিচিত হওয়ায় – নিজেদের খুঁজে না পাওয়াটা দুষ্কর।
এবং তারপর তার ব্ল্যাক-কমেডি, অ্যাবসার্ডিসিজম আর সিনিসিজমের ভেতরে ইনিও যখন মাঙ্গার পাতায় জীবনের গল্প বলে আদি-অকৃত্রিমতায়, তার আঁকায় তুলে আনে সাধারণে লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্য্য, অথবা সাধারণে লুকিয়ে থাকা অন্ধকার, হতাশ করে, বিদ্ধ করে বাস্তবতার ছুড়ি দিয়ে, বলে মানুষের ব্যর্থতা আর সীমাবদ্ধতা নিয়ে, আবার শেষ পাতায় এসে লিখে যায়, “As long as you are alive, something good is bound to happen”, আমাদের আটকে ফেলে পুনপুনের পাখির অবয়বে, আইকোর সাথে ভালোবাসায় অথবা আরো পরে সাচির সাথে সাক্ষাতে, কিংবা মেইকোর সাথে অনেক দিন আগে ফেলে রাখা গিটার তুলে নেওয়ায়, আর তা যখন ভাবতে শেখায় – নতুন জিনিস এবং পুরনো জিনিস নতুন করে, আর মনে গেঁথে থাকে, চিরদিনের জন্য গেঁথে থাকে, একই সাথে লেখা আর আঁকার ভাষায় – তখন তা সাহিত্য…শিল্প, উঁচুদরের শিল্পই।
[১] Lost in Translation: https://en.wikipedia.org/wiki/Lost_in_Translation_(film)
[২] Kaze wo Atsumette: https://www.youtube.com/watch?v=k2SPeEeCj3I
[৩] Kafka on the Shore: https://en.wikipedia.org/wiki/Kafka_on_the_Shore
Penguindrum-এ ট্রেনযাত্রাঃ হারানো দশক অথবা টোকিওর ত্রানকর্তা — Fahim Bin Selim
Mawaru Penguindrum-এর অজনপ্রিয়তা সম্পর্কে সবচেয়ে বড় কারণ ধরা হয় এর দূর্বোধ্যতাকে – রূপক আর সাহিত্য-ঐতিহাসিক ঘটনার যোগসূত্র ব্যবহারে কুনিহিকো ইকুহারার স্বেচ্ছাচার। এক্ষেত্রে আপাত দৃষ্টিতে ব্যাপারটাকে ইডিওসিনক্রেসির কাতারে ফেলা যায়। যা একই সাথে এই অ্যানিমের সবচেয়ে বড় সমালোচনাগুলোর একটি। কিন্তু ইকুহারার Revolutionery Girl Utena-তেও তো রূপকের ছড়াছড়ি ছিলো, তারপরও কেন সেটাকে অবিসংবাদিতভাবে ধ্রুপদী অ্যনিমের কাতারে ফেলা হয়, Penguindrum-এর ক্ষেত্রে যা কেবল কাল্ট স্ট্যাটাসেই সীমাবদ্ধ? সম্ভবত পশ্চিম, তথা জাপানের বাইরের অ্যানিমে দর্শকদের আপ্রোচটাই ভুল। বার্থেসের “ডেথ অফ দ্য অথর”-এর অনুসারে বলা যায়, “একটি লেখার সঙ্গতি তার উৎসের – লেখকের উপর নির্ভর করে না, বরং তা নির্ভর করে তার গন্তব্য – পাঠকের উপর।” Mawaru Penguindrum কোন বৈশ্বিক গল্প না, তা পুরোপুরি জাপানের ইতিহাসের উপর ভর করা, এর মানুষ আর তাদের অতীত, তাদের পরিস্থিতি, তাদের দূর্দশার মনোসমীক্ষণ। Utena-তে থাকা ধর্ম, পরিবার, বেড়ে ওঠা, জেন্ডার-রোল নিয়ে দেওয়া সামাজিক-ভাষ্য এখানেও উপস্থিত, কিন্তু কনটেক্সটটা সেটার মত জেনারালাইজড না। স্থান, কাল আর পাত্রে সুনির্দিষ্ট।
Penguindrum-এর ট্রেন যাত্রায় সঙ্গী হতে হলে আপনার যাত্রা শুরুর প্রথম স্টেশন হবে ১৯৮০-এর শেষ ভাগের জাপান। বিশ্বযুদ্ধ যখন প্রায় ভুলে যাওয়া এক স্মৃতি, চার দশক পেছনে। জাপান দাঁড়িয়ে গেছে শক্তিশালী এক ভিত্তির উপর; সামাজিক, সংষ্কৃতিক আর অর্থনৈতিক – সব দিক থেকেই জাপানের বিস্তৃতি হতে লাগলো ক্রমাগত ফুলাতে থাকা এক বুদুবুদের মত। মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়তে থাকলো, তাদের চাহিদা বাড়তে থাকলো, সেই সাথে ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋনও। এবং এক্ষেত্রে যা হওয়া স্বাভাবিক, পুরোটাই ঘটলো অদূরদর্শী পরিকল্পনায়। এর পরের ব্যাপারটা হয়তো অর্থনীতিতে বিশেষজ্ঞ কেউ ভালো বুঝাতে পারবে, কিন্তু সাহিত্য আর রূপকের ব্যবহারে বলা যায় জাপানের অর্থনীতির বুদবুদটা, আর সব বুদবুদের অনিবার্য সমাপ্তীর সাথে মিলিত হলো। আর সেই বুদবুদের ভেতর থাকা মানুষেরা নতুন এক বাস্তবতার সম্মুক্ষীন হল। পরিণামটা হলো ভয়াবহ। পরিবর্তনটা হল বিপরীত। চাকরীর সংখ্যা কমলো, মানুষের আয় কমে গেলো, ইয়েনের দাম গেলো তলানিতে – কিন্তু নির্দিষ্ট একটা জীবন-ধাঁচের সাথে পরিচিত হয়ে যাওয়া মানুষেগুলোর চাহিদা কমলো না, তাদের প্রত্যাশাও। এক্ষেত্রে সরাসরি প্রথম আঘাতটা লাগলো সামাজিকভাবে – পরিবারে।
প্রথম যাত্রাবিরতি বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে – জাপানের ক্ষেত্রে এই সময়টার জন্য বেশ গালভরা একটা নাম আছে – লস্ট ডেকেইড, হারানো দশক। ঐতিহাসিকভাবে জাপানের পারিবারিক কাঠামোটা বেশ শক্ত গাঁথুনির ছিলো, একসাথে কয়েক প্রজন্মের বসবাস ছিলো প্রথাগত। আশির শেষ আর নব্বইয়ের শুরুতে এই প্রথায় ভাঙন ধরতে শুরু করলো, পারিবারিক সম্পর্কগুলোতেও। আর্থিক সামর্থ্য বজায় রাখার চেষ্টায় মা-বাবারা উভয়ই কর্মক্ষেত্রে যাওয়া শুরু করলো। এবং অনুমিতভাবেই পশ্চিমের অনুরূপ জাপানে পরিবার বিচ্ছেদের সংখ্যাটাও হঠাৎ করেই বেড়ে গেলো(অগিনোমে পরিবার)। সন্তানেরা শৈশব থেকেই অপরিচিত, একাকী একটা পরিবেশে বেড়ে উঠতে লাগলো। “সফল” হওয়ার একটা চাপ তাদের উপরে বর্তালো। মা-বাবার অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণ করার চাপও(তাবুকি, ইউরি পরিবার) – তা নিজেদেরটা বিসর্জন দিয়ে হলেও। ডানা কেটে দেওয়ার পাখির মত, সাঁতার না পারা মাছের মত – অথবা দুটোই – স্থলে আটকে পড়া পেঙ্গুইনের মত! আর এই ধারণাটাকে এগিয়ে নিতে পরিবারের সাথে জোট বাঁধলো সমাজের নিষ্ক্রিয়তা আর ঘুনে ধরা এক শিক্ষাব্যবস্থা। ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রবিহীন, যান্ত্রিক একটা জীবন। চাইল্ড ব্রয়লার!
কিন্তু পরিবারের নিঃস্বার্থ ভালোবাসার সম্পর্কে যখন শর্ত জুড়ে দেওয়া হলো, তখন পরিবারের সংজ্ঞা নিয়ে নতুন করে ভাবার একটা সময় এসে পড়াটা স্বাভাবিক। জাপানের পদার্পন পোস্ট-মডার্নিস্ট এক জগতে। আর পোস্ট মডার্নিজমের কথা বলতে গেলে ট্রেনে নতুন এক যাত্রীর আসাটা জরুরী। হারুকি মুরাকামি।
দ্বিতীয় স্টেশন – জানুয়ারী, ১৯৯৫। জাপানে আঘাত হানলো ৬.৯ মাত্রার এক ভূমিকম্প – দ্য গ্রেট হানশিন আর্থকোয়াক। জাপানীদের মনোবলের ভিতটা নড়ে গেলো। আর মুরাকামি লিখলেন তার “after the quake” ছোটগল্প সংকলনের কালজয়ী গল্প “Super Frog Saves Tokyo”. গল্পের শুরুতেই আমরা মূলচরিত্র কাতাগিরিকে দেখি একদিন কাজ থেকে ফিরে নিজের ঘরে এক বিশাল বড় ব্যাঙকে আবিষ্কার করতে। “আমাকে ব্যাঙ বলবেন”, ব্যাঙটা বলে নিস্পৃহভাবে, ম্যাজিক রিয়ালিজমের ব্যাকরণ মেনে। কাতাগিরির উপর দায়িত্ব বর্তায় টোকিওকে রক্ষা করার। কাতাগিরি সারাজীবনই নিঃস্বার্থভাবে দায়িত্ব পালন করে গেছে। তার পরিবারের বাকিদের জন্য নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়েছে, চাকরীর কঠিন দায়িত্ব নির্দ্বিধায় পালন করেছে। কিন্তু বদলে সে কখনোই কোন স্বীকৃতি পায়নি, তদ্বিপরীত, কাতাগিরির জীবনটা বরং একাকীত্বের। এখানেই যুক্তির ফাটল ধরে। পরিবার যদি তার সদস্যদের অসম্পূর্ণতাকে মেনে নিতে ব্যর্থ হয়, আব্র একই সাথে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতার পায়ে শিকল পরিয়ে দেয়, তাহলে তার কার্যকারিতা কোথায়? কেবলই রক্তের সম্পর্কে? আপনি কী জন্য আরেকজন ব্যক্তির জন্য নিজের ভালোকে বিসর্জন দিবেন? জৈবিক তাড়নায়, পার্থিব উন্নতির লক্ষ্যে? নাকি পুরো ব্যাপারটাতেই ঐশ্বরিক পুরষ্কারের আকাঙ্ক্ষা নিহিত?
Penguindrum-এ ইকুহারা এই ধারণাটাকে আমূল বদলে দিলেন। কাতাগিরির পরিবারের সম্পূর্ণ বিপরীত, আমরা তাকাকুরা পরিবারের তিন ভাই-বোনের সাথে পরিচিত হই, যারা প্রকৃতপক্ষে কেউ কারো সাথে সরাসরি রক্ত-সম্পর্কিত না! কিন্তু তাদের সম্পর্কের গভীরতা একটি “আসল পরিবার”-এর তুলনায় কোন অংশেই কম না। একজন আরেকজনের জন্য জীবন বাজি রাখতে প্রস্তুত!
ট্রেনের কামরায় নতুন একজনের অতিথির আগমন – কেনজি মিয়াজাওয়া। কেনজি মিয়াজাওয়া তার “Night on the Galactic Railroad” গল্পে এই আত্নত্যাগের বিষয়টা বারবার ফিরিয়ে এনেছেন। মিয়াজাওয়ার মতে জীবনের সব গুলো ঘটনাই সম্পর্কযুক্ত, তা যত ছোটই হোক না কেন। নিয়তির বিচারে সব অংকের যোগফল শুন্য। এবং আপনি কেবল বড় একটা নাটকের অংশ মাত্র, যার চিত্রনাট্য আপনার হাতে নেই; তার লাল-সুতায় সবাই বাঁধা, এবং এর থেকে মুক্ত হওয়ারও কোন উপায় নেই। ভালো সবসময়ই থাকবে, খারাপ সবসময়ই থাকবে। বৃশ্চিক হওয়ার নিয়তি যদি অনিবার্যও হয়, কিন্তু তার প্রক্রিয়া আর কার্যকারণ আপনার হাতে, তা কুয়োয় পরে জীবন হারাবেন, নাকি আকাশে নক্ষত্রমন্ডল হয়ে জ্বলতে থাকবেন। জীবনের সমাপ্তী কেবল বেঁচে থাকাতেই না।
কাতাগিরির যেমন দায়িত্ব পরে “ওয়ার্ম”-এর হাত থেকে টোকিওকে বাঁচানোর – যাকে ব্যাঙ বর্ণনা করে, “মানুষের মনের সব অন্ধকারের সমষ্টি” হিসেবে, কিন্তু “ওয়ার্ম”-কে সরাসরি ভালো-খারাপের মানদন্দে ফেলা যায় না। “ওয়ার্ম” বরং জাপানের মানুষের সমষ্টিগত চেতনার অনুরূপ। কেউই তার জন্য দায়ী নয়, এবং একই সাথে সবাই দায়ী।
ট্রেনের চেয়ারগুলোতে কি কতগুলো খেলনা ভাল্লুক দেখা যাচ্ছে? আমাদের যাত্রার শেষ গন্তব্য ২০ মার্চ, ১৯৯৫। জাপান যখন লস্ট ডেকেইড পার হচ্ছিল, তখন তার ছায়ায় বেড়ে উঠেছে এক ভয়ংকর টেরোরিস্ট সংগঠন – ওম শিনরিকিও(পিং গ্রুপ!)। ওম শিনরিকিওর শুরুটা বুদ্ধিজম আর হিন্দুইজমের যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টায়। কিন্তু এক পর্যায়ে সেটা হয়ে গেল তাদের নেতা শোকো আসাহারার ব্যক্তিগত এক কাল্ট, যখন সে নিজেকে দাবি করলো “ক্রাইস্ট” হিসেবে। এ ধরনের পাগলাটে সংগঠনে যোগ দেওয়ার মত বোকামি কে করবে! কিন্তু সেটা করলো জাপানের সেরা, সেরা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা, শিক্ষকরা, শিক্ষিত ব্যক্তিরাই! তাদের মতে জাপানকে এর যুদ্ধ-পূর্ববর্তী নির্মোহ, নির্জীব অবস্থা থেকে বাঁচাতে একটা “ধাক্কা”-’র প্রয়োজন ছিলো। ধাক্কাটা হবে টোকিওর নিচ দিয়ে চলে যাওয়া সুদীর্ঘ পাতাল-রেলপথে। হয়তো এতে অনেক মানুষ মারা যাবে – কিন্তু জাপানের সামগ্রিক “শুদ্ধির” জন্য এই বিসর্জনটা মেনে নেওয়াই যায়।
Penguindrum-এ ইকুহারা ওম শিনরিকিও-’র চিন্তাধারাটা বোঝার চেষ্টা করেছেন।তিন মূলচরিত্রের বাবা-মা-ই ওম শিনরিকিওর সদস্য! মুরাকামিকেও এই ব্যাপারটা ভাবিয়েছে, তিনি কেবল থট এক্সপেরিমেন্ট দিয়ে ফিকশনের “ওয়ার্ম”-এই পরে থাকেননি, সারিন গ্যাস অ্যাাটাক দ্বারা প্রভাবিত মানুষদের গল্প শুনেছেন, ওম শিনরিকিওর সদস্যদেরও। তারপর ১৯৯৭ সালে লিখলেন প্রায় শ’খানেক মানুষের সাক্ষাৎকার সম্বলিত নন-ফিকশন “Underground”. এই বইয়ের সাক্ষাৎকারগুলোতে জাপানের সেই সময়কার মানুষদের মানসিক অবস্থার একটা ধারণা পাওয়া। কেউ কেউ ছিলো যারা সকালবেলা এই দূর্ঘটনার মুখে পরেও, পরবর্তীতে কর্মস্থলে গেছে যেন কিছুই হয়নি, নির্দিষ্ট প্রোগ্রামে আটকে থাকা রোবটের মত। কারো কারো আবার জীবন বদলে গেছে, পরিবারে বিচ্ছেদ ঘটেছে, সবকিছু নতুন করে দেখতে শিখায়(“after the quake”-এর “UFO in Kushiro” পড়তে পারেন)। মানুষের মূল্যবোধকে ভেতর থেকে খাওয়া অ্যাপ্যাথেটিক এক সমাজব্যবস্থা আর সরাসরি মানুষ হত্যা করতে প্রস্তুত এক ডুম’স ডে কাল্টের মধ্যে আপনি কীভাবে তুলনা করবেন?
“And the opposite of life is not death, it’s indifference.”
― Elie Wiesel
এই কাল্ট যখন আবার সেই সমাজব্যবস্থার কারণেই বেড়ে ওঠা, সেই সমাজেরই “সব অন্ধকারের সমষ্টি”? পাতালপথের নিচে বাড়তে থাকা “ওয়ার্ম”, কাধের পেছনে ভর করা এক ভূত, একটি অভিশাপ – “সানেতোশি”। কেউই তার জন্য দায়ী নয়, এবং একই সাথে সবাই দায়ী। এর ফলাফলটাও ভোগ করবে সবাই। “ওয়ার্ম” অথবা “সানেতোশি”-’র হাত থেকে টোকিওকে বাঁচানোর দায়িত্বটাও কাতাগিরি বা মোমোকোর একার নয়, কিন্তু কাতাগিরি এবং মোমোকোরও দায়িত্ব। তার বদলে কোন স্বীকৃতি না পেলেও। একটি ব্যাঙ অথবা একটি ডাইরী বাদে কেউ তাদের বীরত্বের কথা না জানলেও। শোকো আসাহারার মত কেবল ফাঁকা বুলিতেই না, ক্রুশেও যে বিঁধতে হবে একজন “ক্রাইস্ট”-কে।
চিরস্থায়ী ভালোর আশা করাটা বোকামি, কিন্তু খারাপের বিপক্ষে ভালোর লড়াইটাও চিরস্থায়ীই। বারবার ফিরে আসা – চাক্রিক। টোকিওর পাতালপথের রেললাইনের মত! তাই তো মোমোকোর পর আবার কানবা আর শৌমার জন্ম হয়। অংকের যোগফল শুন্য হলেও তা বের করার পথটা বদলে দেওয়াই যায়।
শুধু জাদুমন্ত্রটা মনে থাকলেই হবে।
[১] কুনিহিকো ইকুহারা – অ্যানিমে পরিচালক; Penguindrum, Utena, Sailor Moon S, Yuri Kuma Arashi
[২] Revolutionary Girl Utena – ১৯৯৭ https://en.wikipedia.org/wiki/Revolutionary_Girl_Utena
[৩] লস্ট ডেকেইড – https://en.wikipedia.org/wiki/Lost_Decade_(Japan)
[৪] হারুকি মুরাকামি – জাপানী সাহিত্যিক; https://en.wikipedia.org/wiki/Murakami_Haruki
[৫] দ্য গ্রেট হানশিন আর্থকোয়াক – ১৯৯৫; https://en.wikipedia.org/wiki/Great_Hanshin_earthquake
[৬] after the quake – ২০০০, ছোটগল্প সংকলন; https://en.wikipedia.org/wiki/After_the_quake
[৭] কেনজি মিয়াজাওয়া – জাপানী সাহিত্যিক; https://en.wikipedia.org/wiki/Kenji_Miyazawa
[৮] টোকিও সাবওয়ে সারিন গ্যাস অ্যাটাক – ১৯৯৫; https://en.wikipedia.org/wiki/Tokyo_subway_sarin_attack
[৯] ওম শিনরিকিও – https://en.wikipedia.org/wiki/Aum_Shinrikyo
[১০] Underground – ১৯৯৭; https://en.wikipedia.org/wiki/Underground_(Murakami_book)
Shouwa Genroku-তে আত্নহত্যা, আর রাকুগোর মঞ্চায়ন — Fahim Bin Selim
[Shouwa Genroku Rakugo Shinjuu স্পয়লার সতর্কতা]
রাকুগো [落語, Rakugo] – আক্ষরিক অর্থ “পড়ন্ত শব্দ(Falling Words)”। মূলতঃ মঞ্চে বসে কেবল এক-দুটো সরঞ্জাম দিয়ে(অধিকাংশ সময়ই একটা কাগজের পাখা একটা ছোট কাপড়ের টুকরো) গল্পবর্ণনার বাচনিক শিল্পমাধ্যম। যদিও এই ধারা বেশ আগে থেকেই জাপানে চলে আসছিলো, তবে মেইজি এরাতে এসে প্রথম “রাকুগো” শব্দটার প্রচলন হয় আর শৌয়া পিরিয়ডে এসে সাধারণের বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয়তা পায়। যদিও শেষ পর্যন্ত রাকুগো একটি নিশ(Niche) বিনোদন মাধ্যমই থেকে গেছে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে। একাকীই পুরো অভিনয়টা করতে হয় বলেই রাকুগো করার জন্য প্রয়োজন বেশ বড় পরিসরের কন্ঠবৈচিত্রতা আর বডি-ফেস এক্সপ্রেশনের ছোটখাটো পরিবর্তন দিয়ে বড় ধরনের ভাব আদানের দক্ষতা। এই রাকুগো পারফর্মারদের – যাদের ডাকা হয় “Deshi” বলে – বড় থিয়েটারগুলোতে, বড় উপলক্ষগুলোতে সুযোগ পাওয়ার জন্য পার হয়ে আসতে হয় বেশ কয়েকটি ধাপ। পেতে হয় কমিটির অন্যান্য রাকুগো মাস্টারদের সমর্থন। বিভিন্ন ঘরানার রাকুগো দেখা গেলেও একে সাধারণভাবে ভাগ করা যায় কমেডি, হরর(কাইদান) আর ট্র্যাজেডিতে।
আর Shouwa Genroku-’র গল্পটাতে যে ট্র্যাজিক-ড্রামা তা প্রথম পর্বেই ভালোভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, যা লাফিয়ে বেড়ায় শৌয়া পিরিয়ডের সময়টাতেই, একই সাথে অতীত(চল্লিশের দশক) আর বর্তমানে(সত্তরের দশক)। গল্পের শুরুটা উদীয়মান রাকুগো “অভিনেতা” ইয়োতারোকে দিয়ে ‘৭০ এ হলেও, অন্তত অ্যানিমের প্রথম সিজনের অধিকাংশ সময়টাই তার গুরু কিকুহিকোর সাথে কাটানো, ‘৪০ এর যুদ্ধকালীন আর যুদ্ধপরবর্তী জাপানে। Shouwa Genroku-’র প্রথম পর্বটা, যেটা আগে বেরোনো দুটো OAD-’র পুনর্বণনা আর ৪০ মিনিটেরও বেশি দীর্ঘ, একটা আদর্শ “পাইলট” এপিসোড, পুরো অ্যানিমেটারই একটা খন্ডচিত্র; তা এসথেটিক দিক দিয়েও, গল্পের মেজাজ আর গতির দিক দিয়েও। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এর সমাপ্তী, যা আগে থেকেই বলে দেওয়া; বারবার শোনা কোন রাকুগোর মত যেন। আর একারণেই Shouwa Genroku-’র মূল বিশেষত্ব “কী হবে” তাতে নয়, বরং “কীভাবে হবে”-তে আবদ্ধ। মাঙ্গার প্যানেল-বাই-প্যানেল থেকে বেরিয়ে অ্যানিমেশন/সিনেমা মাধ্যমে গল্পের মঞ্চায়নে পরিচালকের নিজস্বতার শুরুটা এখান থেকেই। অনেকটা পার্থক্য তুলে ধরার চেষ্টাতেই যেন, “ভার্বাল স্টোরিটেলিং”-কে কেন্দ্র করে আবর্তিত এক গল্পে তার চরিত্ররা প্রথম থেকেই ভাব প্রদানে ব্যবহার করেছে খুবই কম শব্দ। রহস্য আর নাটকীয় মুহূর্তে সংলাপগুলোকে দমিয়ে দিয়ে বরং মনোযোগ দেওয়া হয়েছে ভিজুয়াল স্টোরিটেলিং আর নুয়ান্সের উপর।
পিরিয়ড ড্রামা হিসেবে Shouwa Genroku-’র অর্ধেক আকর্ষন যুগ পরিবর্তনের সাথে সময় রাকুগোর টিকে থাকা, তার সাথে জড়িত মানুষদের টিকে থাকার গল্প; প্রতিভা, সাফল্য, ব্যর্থতা, ভালোবাসা, তাদের টানাপোড়েনের গল্প। আগের থেকেই জনপ্রিয়তা নিয়ে ধুঁকতে থাকা এই মাধ্যম বড় একটা ধাক্কা খায় টেলিভিশন, রেডিও আর সিনেমার মত নতুন বিনোদন মাধ্যমগুলোর আবির্ভাবে। আরও একটা বড় কারণ সম্ভবত এর ঐতিহ্য আর প্রচলিত ধারার বাইরে যাওয়ার বিপক্ষে একগুঁয়েমি। অ্যানিমের পুরোটা জুড়েই শিল্পের এই চিরচেনা অন্তর্দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। দুই মূলচরিত্র সুকেরেকু আর কিকুহিকোর রাকুগো পরিবেশনার বৈপরীত্যটা সামগ্রিক রাকুগো জগতের অবস্থার সাথেই সমান্তরাল টানার চেষ্টা। কিকুহিকো, একজন সহজাত অভিনেতা; সূক্ষ্ণ আর নিখুঁত, ক্রিটিকালি অ্যাক্লেইমড, পিয়ার(peer)-দের ঈর্ষা আর অগ্রজদের প্রশংসার পাত্র; কিন্তু দর্শকদের সাথে তার সংযোগটা, যেটা আর যেকোনো মঞ্চপ্রদর্শনের মতই রাকুগো পারফর্মেন্সের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কখনোই তার কাছে সহজাত ছিলো না। সুকেরেকুর অবস্থানটা পুরো বিপরীত। তাকে বলা যায় জনগণের রাকুগো পারফর্মার। কমেডি ধারাতেই তার বিচরণ, আর দর্শকদের বিনোদনের জন্য, তাদের সখ্যতা পাওয়ার জন্য কমেডির চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে! কিন্তু প্রতিভা থাকলেও তা টিকিয়ে রাখার চাপ সামলাতে সুকেরেকু বারবার ব্যর্থ হয়।
Shouwa Genroku বেশ বড় একটা সময় মঞ্চের বাইরের জীবনের নাটকীয়তা নিয়ে কাটালেও, এর বাকি সময়টা কেবলই মঞ্চের রাকুগো নিয়ে। রাকুগো, এমন একটা শিল্পমাধ্যম যা ধৈর্য্যের পরীক্ষা নেয় বেশ ভালোভাবেই – তা যেমন তার পারফর্মারের, তেমনি এর শ্রোতারও। আর Shouwa Genroku প্রথম থেকেই আমাদের থিয়েটারের ভেতর বসিয়ে দেয়, বেশ কয়েকটি রাকুগো পারফর্মেন্সের পুরোটা দেখিয়ে, যার সবচেয়ে বড়টি প্রায় ১৫ মিনিট।
গঠনগতভাবে, রাকুগো শুরুটা হয় বড় একটা বিল্ডআপের নিয়ে, আর তার শেষটা হয় হঠাৎ কোন সমাপ্তী নিয়ে – কমেডির ক্ষেত্রে কোন রানিং জোক অথবা ওয়ার্ডপ্লে আর ট্র্যাজেডির ক্ষেত্রে পতনের অনিবার্যতার নিয়ে। বিল্ড-আপের মূহুর্তটা ধীরে ধীরে শ্রোতাকে গল্পের ভেতর টেনে আনার প্রচেষ্টা। বক্তা, কেবল শব্দের মাধ্যমেই যে কিনা সকল শ্রোতার কল্পনাশক্তিকে একসাথে চালিত করে ইনডিভিজুয়াল কনশাসনেসকে ছড়িয়ে দিবে সবার মাঝে। Shouwa Genroku-’র পারফর্মেন্সের দৃশ্যগুলোকে এক্ষেত্রে নিখুঁতই।
পারফর্মেন্সগুলো আমরা দেখতে পাই বক্তা-শ্রোতা দুই পরিপ্রেক্ষিত থেকেই। রাকুগো পারফর্মারকে দূর থেকে দেখা যায়, দর্শকের চোখ দিয়ে, আসন গেড়ে বসা, বিচলিত অথবা আত্নবিশ্বাসী, স্পটলাইটের কেন্দ্রবিন্দুতে। দর্শকের দেখা যায়, বক্তার চোখ দিয়ে, অনিশ্চয়তা অথবা আগ্রহ নিয়ে তাকানো, আধো আলো-ছায়ায়। কিন্তু যতই গল্প এগোতে থাকে, আর যতই গল্পের আবহ আচ্ছন্ন করা শুরু করে, ততই বাস্তবতা বিলীন হয় আর প্রবেশ ঘটে পরাবাস্তবতার জগতে। আমাদের চোখের সামনেই দর্শকরা হারিয়ে যায় অন্ধকারে। অথবা বক্তার নিয়মিত বদলে যাওয়া গলা আর বৈচিত্র্যতা থাকা অঙ্গভঙ্গিগুলো প্রাণ নিয়ে যেন মঞ্চে হাজির হ্য় আলাদা আলাদা সব চরিত্র হিসেবে। শৌয়া পিরিয়ডের টোকিওর কোন থিয়েটারের মঞ্চ রুপান্তরিত হয় এডোর কোন পতিতালয়ের ঘরে। আমরা শ্বাসবন্ধ করে বসে থাকি, দর্শকদের সাথেই, তার যখন হঠাৎ কোন কৌতুকে হেসে ঊঠে তখন আমরাও হাসি। অথবা আঁতকে উঠি শিনিগামির আগমনে।
কিন্তু কেবল রাকুগোর নিখুঁত মঞ্চায়নই না, তার চেয়েও বেশি কিছু, Shouwa Genroku এক অনবদ্য সিনেমাও। সামনে থেকে না দেখতে পাওয়া পারফর্মারের দেহের অঙ্গভঙ্গিগুলো আমরা দেখি, পারফর্মারের পাশে বসে, আসলেই মিশে একাকার হই, শুধু রাকুগোগুলোর গল্পের সাথেই না, তার পেছনের মানুষটার গল্পগুলোতেও। কোন মোনোলোগ না, কোন আলাদা সংলাপ না – কিন্তু পারফর্মারের মনের ভেতর ঢুকে যেতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। হয়তো ছোট একটা শট-ফ্রেমিং – পায়ের আড়ষ্টতা বা ঠোটের কোনের সূক্ষ্ণ হাসি – Shouwa Genroku-’র ছোট ছোট দৃশ্যগুলোই হাজার শব্দের একটা ভাব বহন করে।
Shouwa Genroku-’র মূল গল্পের পুরোটাতেও আমরা বসে থাকি অধীর আগ্রহে, এর অনিবার্য ট্র্যাজেডির জন্য। তার চিরচেনা ভাব-গাম্ভীর্য নিয়েই কিকুহিকো যখন বলে যায় আত্নহত্যা অথবা পতনের গল্প – সুকেরেকু, মিয়োকিচি আর…রাকুগোর।
Cat Soup-এ মৃত্যু-ভাবনাঃ ভালোবাসা এবং অনিবার্যতা — Fahim Bin Selim
মানুষের জ়ীবনের সবচেয়ে বড় ভয়গুলোর মধ্যে একটা সম্ভবত পরিবর্তন; চেনা-পরিচিত জগৎটার পালটে যাওয়া। তা পরিস্থিতির বদলে হতে পারে, স্থান-কালের বদলে হতে পারে, হতে পারে পাত্রের বদলে; কিংবা অনুপস্থিতিতে। এক্ষেত্রে পরিবারের কথাই কি সবার আগে মাথায় আসে না, যেখানে মোটামুটি পরিবারকে ঘিরেই পরিচিত জগৎ-টার শুরু, এবং বড় একটা সময় জুড়ে সেটাই পুরো জগৎ হয়ে থাকে? শিশুদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরো বেশি।
নিয়াত্তার যুদ্ধটা এই পরিবর্তনের বিপক্ষে – পরিণতি আর অনিবার্যতার বিপক্ষে। স্রষ্টা-সর্বপরিচালকের বিপক্ষেও কি না? Cat Soup-এর শুরুটা মাসাকি ইউয়াসার[১] ট্রেডমার্কড পারস্পেকটিভ শট দিয়ে। ক্যামেরা বাথটাবের ভিতর পরে থাকা, তার উপরে জলের আবরণ – স্থির – আপাত পরিস্থিতির মত। কিন্তু এরপরই নিয়াত্তার আগমন, খেলনা নিয়ে পানির ভেতর হাত ডুবিয়ে খেলতে থাকা, অতঃপর তাতে উপুড় হয়ে পরে যাওয়া, জলের আবরণে আন্দোলন এবং হ্যালুশিনেশনের শুরু। পরাবাস্তবতারও।
একটা মরা পোকার খোলস দেখা যায়, দেখা যায় বাইরের ঘরে শুয়ে থাকা অসুস্থ নিয়াকোকে। এবারের পারস্পেকটিভ শটটা তার চোখ দিয়ে দেখা – উপরের সিলিং, ক্রমশ জট পাকিয়ে যাওয়া, বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া, ক্রমশ অন্ধকার হয়ে যাওয়া দৃষ্টি। বারান্দায় মৃত্যু দেবতার আগমন। কাছাকাছি দুটি মৃত্যু এবং মহাবৈশ্বিক চিন্তাভাবনায় কোনটাই কোনটার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। নিয়াত্তার যুদ্ধটা এখান থেকেই শুরু। সে মৃত্যু দেবতার হাত থেকে নিজের বোনের আত্নাকে একরকম টানাটানি করেই ফিরিয়ে আনে। তারপর তার মৃতদেহের ভেতর তা পুরে দেয় – আর জাদুর মত তার বোনও মৃত্যুর কোল থেকে ফিরে আসে! জাদুবাস্তবতা অথবা শিশুমনের অলীক কামনা। কিন্তু এভাবেই তাদের অভিযাত্রার সূত্রপাট।
তাদের প্রথম বিরতি এক রঙ্গমঞ্চে – দ্য বিগ হোয়াইট সার্কাস। আরো ভালোভাবে বলতে গেলে স্রষ্টা -‘র সার্কাসে। সবার সামনে একটা মেয়েকে কেটে টুকরো টুকরো করা হয় এবং তার হাতের ছোঁয়ায় তারপর ভোঁজ়বাজির মত তা আবার জুড়েও দেওয়া হয়! দর্শকদের মধ্য থেকে এবার অনুরোধ নেওয়া পালা, প্রথমে চেয়ার, তারপর মাছ, এবং সবশেষে এক হাতি – এবং আর্শ্চর্যজনকভাবে এবারও জাদুর মত সে শুধু বলে – এবং তা হয়ে যায়! তবে দর্শকদের মনোরঞ্জনের পর্ব শেষ হলে স্রষ্টা-‘রটা শুরু। এক প্রবল স্রোতের বন্যায় সবার ভেসে যাওয়া, “নোয়া’হ ফ্লাড” যেন। চারিদিক যতদুর চোখ যায় কেবল পানি আর পানি, কিন্তু নিয়াত্তা আর নিয়াকোর “আর্ক”-এ প্রাণীকূলের প্রতিনিধি হিসেবে কেবল তারা ভাইবোন দুজন বিড়াল আর তাদের “প্রিয়” পোষ্য শুকর(Cat Soup Original দ্রষ্টব্য)। লৌহ-পাখার এক প্রজাপতি উড়ে যায়। নিয়াত্তা আবারো বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকায় তার বোনের পরিচর্যা করা শুরু করে, তাকে খাইয়ে দেয়, এমনকি পোষ্য শুকরের ক্ষতি করে হলেও – নৈতিকতা আর ভাবাদর্শ চুলোয় যাক(আক্ষরিকভাবেই!), পরিবারই সবার আগে অবশ্যই!
এই নৌকায়ই নিয়াত্তার দেখা পানিতে ভাসতে থাকা মৃত পশুর জীবনচক্র – তার মৃতদেহের পাখিদের পেটে যাওয়া, শিশুপাখির মল হিসেবে পানি-বাতাস পেরিয়ে আবার ভুপৃষ্ঠে ফিরে আসা, অতঃপর পুষ্টি হিসেবে কাজ করে গাছের ডালে ফুল হিসেবে ফোটা। “Adventure Time” কার্টুন সিরিজের মাসাকি ইউয়াসা পরিচালিত পর্ব Foodchain-এ এই থিম পরবর্তীতে আরো বিশেষভাবে ব্যক্ত হয়েছে।
গড-এর হাত থেকে পরে যাওয়া খাবারের টুকরো ঘড়ির কল-কব্জা আটকে দেয়। আটকে যায় সময়ও। নিয়াত্তার নিজের বোনকে ফিরিয়ে আনার যুদ্ধটা যতটাই স্রষ্টা-‘র বিপক্ষে হোক না কেন, এক্ষেত্রে তাঁর ভ্রুক্ষেপ নেই বললেই চলে – পুরোটাই তার উপভোগের বিষয়, এখানে কেউ তাঁর সহযোগী নয়, কেউ তার শত্রু নয়। আটকে থাকা সময়ে নিয়াত্তা ঘুরে বেড়ায় পৃথিবীর বুকে। তার দেখা হয় আপাতত সময়ে আটকে থাকা, শীঘ্রই ট্রেনের নিচে চাপা পরে মরতে যাওয়া এক নারীর সাথে। নিয়াত্তা তার চোখে লেগে থাকা শক্ত হয়ে যাওয়া দুঃখ মুঁচড়ে খুলে নেয় এবং নিচে আছড়ে ফেলে। তা ভেঙ্গে চুরমার হয়। জীবনের সব সৌন্দর্য আর ভালোলাগার দেখা পাওয়ার জন্য কষ্টগুলো পার হওয়া খুবই তুচ্ছ। যাত্রাটা দুর্গম কিন্তু অসম্ভব নয়। লজ্জা, অপমান, ব্যর্থতা – সবকিছুর কষ্ট সহ্য করে হলেও কি বেঁচে থাকাটাই গুরুত্বপূর্ণ না?
ঘড়ির কাঁটা সামনে এবং তারপর পিছে আগায়। এবার একগাদা অসংযুক্ত ভিনিয়েট পর্দায় খেলা করে। Mind Game[৩]-এর অনুরূপ! বিড়াল-সহোদর সময়ের চক্রে বুড়ো হয়ে যায়, আবার ফিরে আসে। মানুষেরা পেছনে দুপায়ে হাঁটতে হাঁটতে আদি-বানরের চারপায়ে নেমে আসে, সরীসৃপেরা ডাঙ্গা ছেড়ে নেমে যায় প্রাগৈতিহাসিক জলে। ডাইনোসরদের নির্বংশ করা উল্কাপিন্ড তার অধিবৃত্ত পথে অভিকর্ষ ত্যাগ করে ফিরে যায় মহাকাশে। “উন্নত” মানুষের হিংস্রতার খন্ডচিত্র দেখা যায় – মানুষ মারা যায়; যুদ্ধের মিসাইলে, বন্দুকের গুলিতে, দালানের ধ্বসে, গাড়ি দূর্ঘটনায়। আর এ সবকিছুই হয় নিস্পৃহ স্রষ্টা-‘র ভোজনামোদের অংশ। বিড়াল-সহোদর আবার তাদের নৌকায় ফিরে আসে। কর্দমাক্ত নোংরা জলে যান্ত্রিক মানুষের দেখা মেলে। পুনরাগমন ঘটে লৌহ-ডানার প্রজাপতির। ভাইবোনকে সে পথ দেখায়। আর দেখা মেলে সেই ফুলের, চক্রশেষে যার জন্ম হয়েছিল তাদের থেকেই। নিয়াকো তার প্রাণ ফিরে পায়। সুখী সমাপ্তী!
অথবা শিশুমনের অলীক কামনা। নিয়াত্তার জীবনের সুখের স্মৃতিগুলো হারাতে থাকে একেক করে – তার বাবা, তার মা, সব শেষে তার বোন। এমনকি সে নিজেও হারিয়ে যায়। মৃত্যুর পর সবই সমান। অন্ধকার।
তাই প্রতিটি মূহুর্তই গুরুত্বপূর্ণ। জীবনে টিকে থাকা, তা যত কষ্ট সহ্য করেই হোক, সবসময়ই তা বিলিয়ে দেওয়ার চেয়ে সুন্দর। কারণ জীবনের প্রতিটি স্মৃতিই, প্রতিটি মূহুর্তই গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের অংশ হও। তা এমনকি ছোটবেলায় পরিবারসহ সৈকতে গিয়ে তোলা কোন ছবিতে হলেও
।
[১] – [https://en.wikipedia.org/wiki/Masaaki_Yuasa]
[২] – [http://kisscartoon.me/Cartoon/Adventure-Time-with-Finn-Jake-Season-06/Episode-007-008?id=3768]
FLAG!(2009) রিভিউ — Fahim Bin Selim
FLAG!(2009)
★★★★☆
[ইংলিশ ডাব]
অরিজিনাল নেট অ্যানিমেশন
জনরাঃ ওয়ার ড্রামা, মিলিটারী
প্রযোজকঃ দ্য অ্যান্সার স্টুডিও (Garden of Words, Golgo 13)
মূল ও পরিচালনাঃ রিওস্কে তাকাহাশি (Gasaraki, The Cockpit)
সেন্সরঃ সরাসরি ভায়োলেন্স অনুপস্থিত
মাইঅ্যানিমেলিস্ট রেটিংঃ ৭.৩৬(#২০২৬)
গৃহযুদ্ধ-বিদ্ধস্ত উদিয়ানা(Uddyana). একে অনেকটা মধ্যপ্রাচ্য আর দক্ষিণ এশিয়ার সংকর বলা যায়। একপাশে দিগন্ত বিস্তৃত মরুভূমি আর বেদুঈনদের বাস, আরেকদিকে চারিদিক ঘেরা সুউচ্চ পাহাড়ের খাঁজে গড়ে ওঠা এর প্রধান শহর সুবাশি(Subasci) – আর তার মানুষ – সনাতন আর বৌদ্ধ ধর্মের মিশেলে এক ধর্মের অনুসারী যারা, আর তাদের প্রার্থণার বড় একটা অংশ জুড়েই হয়তো বা ছিলো চলমান যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে রেহাই পাওয়ার ব্যগ্র কামনা।
সায়াকো শিরাসু – জাপানী অনুসন্ধানী চিত্র-সাংবাদিক – তরুণী। যুদ্ধের কারণেই উদিয়ানায় পা রাখা তার, জ্যেষ্ঠ আর অভিজ্ঞ কেইচি আকাগির সাথে।তারপর হঠাৎ যখন বিক্ষোভের উত্তাল এক মূহুর্তে তার তোলা বিপ্লবীদের হাতে উড়ন্ত UNF(জাতিসংঘ)-এর পতাকার এক ছবি হয়ে দাঁড়ালো উদিয়ানার শান্তিচুক্তির শক্ত হাতিয়ার, পুরো জাতির আশার প্রতীক, তখন খুব দ্রুতই শিরাসুর জীবনের মোড় ঘুড়ে গেল। সে পেয়ে গেল নায়োকোচিত(নায়িকাচিত?) সংবর্ধনা, আর আন্তর্জাতিক খ্যাতি। কিন্তু চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার আগেই অপহৃত হলো সেই বিখ্যাত পতাকা। UNF থেকে তৈরি করা হল গোপন এক মিলিটারী ইউনিট, একমাত্র লক্ষ্য – শান্তিচুক্তির আগেই সেই পতাকা পুনোরুদ্ধার। আর সেই পতাকার সাথে তার যোগসূত্র থাকায়, অনেকটা মাসকট হিসেবেই শিরাসুকে জুড়ে নেওয়া হল এই দলে। তার সু্যোগ মিললো পুরো অপারেশনটা ক্যামেরাবন্দী করার। আর চিরদিনের জন্য একটি জাতির কিংবদন্তীর অংশ হওয়ার।
পলিটিক্যাল ড্রামা অ্যানিমে তুলনামূলক কম হলেও, একেবারে কম না। কিন্তু এক্ষেত্রে FLAG এর বিশেষত্ব হচ্ছে তার গল্পের প্রেক্ষাপট, বাস্তব-বিশ্বের সাথে রিলেটেবলিটি আর অবশ্যই এর গল্পবর্ণনার পারস্পেরক্টিভ। আর এখানে এর কৌশলগত বিশেষত্বও। FLAG-এর পুরোটাই তার দুই মূল চরিত্র সাংবাদিকের চোখ দিয়ে দেখানো, এবং সেটা আক্ষরিক অর্থেই – FLAG হলো (সম্ভবত) প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র “Found Footage” টিভি অ্যানিমে। অ্যানিমেশনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য এক কীর্তি বলেই মনে হবে! কিন্তু সত্যি সত্যি-ই, FLAG-এর ২০ মিনিট ব্যপ্তীর পুরো ১৩ পর্ব ধরে দেখানো প্রতিটি মূহুর্ত হয় তার চরিত্রদের তোলাঃ স্থিরচিত্র বা ভিডিও অথবা কম্পিউটার পর্দায় চলা কোন ফাইল অথবা হেলিকপ্টার, সমরযন্ত্রের ভেতর-বাইরের ক্যামেরায় বন্দী হওয়া দৃশ্য – যেগুলো কখনো কখনো কেবলই একগাঁদা স্থিরচিত্রের মনটাজ, কখনো বা সম্মুখসমরে চলা রুদ্ধশ্বাস কোন দৃশ্য, আবার কখনো বা দুপুরের ব্যস্ততার সময়টায় মিলিটারী ক্যাম্পের রাঁধুনীর একান্ত সাক্ষাৎকার।
“Found Footage” কায়দাটা “সত্যিকারের” ক্যামেরায় কাজে লাগানো যতটা সহজ, অ্যানিমেশনে ততটাই কঠিন, যেহেতু অ্যানিমেশন বানাতে কোন ক্যামেরা লাগেনা। সাধারন ক্ষেত্রে ক্যামেরার বিভিন্ন বিষয়গুলো খুব দ্রুত এবং সহাজাতভাবেই হয়, সেখানে অ্যানিমেটরদের তা প্রতিটি ফ্রেমেই আলাদাভাবে ফুটিয়ে তুলতে হয়েছে। এটেনশন টু ডিটেইলস হাঁ করে দেওয়ার মত। FLAG-এর “পাওয়া ফুটেজ”-গুলো কেবল এক কোনায় “REC” আর আরেক কোনায় সময়-তারিখ দিয়েই শেষ হয়ে যায়নি, এর ক্যামেরাগুলো গল্পের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখানে ক্যামেরাগুলো হঠাৎ সূর্যের আলোতে তাক করলে পর্দা অন্ধকার হয়, জুম-ইন আর জুম-আউটের সময় ঘোলাটে হয়ে যায়, বাহকদের কাঁপা কাঁপা হাতের সাথে তারাও নড়তে থাকে। অধিকাংশ সময়ই ফার্স্ট পারসন ভিউ থেকে দেখানো, শটগুলোও অনেক সময় দীর্ঘ আর আনকাট। আর একারণেই গল্পের দুই মূলচরিত্র শিরাসু আর কেইচির স্ক্রিনটাইম খুবই নগন্য। আমরা তাদের হাতে ধরা ক্যামেরার সাথেই পুরো উদিয়ানা চষে বেড়াই।
FLAG এর গল্প দুটো – সমান্তরালে চলা – শিরাসু আর কেইচির। শিরাসুর উপস্থিতি মিলিটারী ক্যাম্পের ভেতরে, যা আপাত নিরস, নির্মোহ সৈন্যদেরও – যাদের কাজই হচ্ছে মানুষের প্রাণ নেওয়া, সেটা সন্ত্রাসবাদ রুখতে কোন পরিকল্পিত আক্রমনের বলী চরমপন্থীই হোক, বা কোন “অঘটনে্র শিকার” সাধারণ মানুষে – মানবীয় দিক উপস্থাপনের প্রয়াস। আমরা শিরাসুর সাথে ঘুরে বেড়াই মিলিটারী ক্যাম্পের ব্যারাক, তার রান্নাঘর, তার পরিকল্পনা রুমে – আমরা তার সাথে হেলিকপ্টারে চড়ি, বেদুঈনদের সাথে দিন কাটাই, মধ্যরাতের রোমাঞ্চকর সব মিশনের সঙ্গী হই। আবার যুদ্ধ-রাজনীতির বিশাল বিস্তৃত সাদা-কালো ঘর করা ছকে ধীরে ধীরে সৈন্য শ্রেনীর গুঁটি হিসেবে আটকা পরি, আর বাকিদের মত।
শিরাসু যেখানে বাইরের বিশ্ব থেকে বিযুক্ত, সেখানে কেইচি বরং সুবাশিতে আমাদের ভ্রমণসঙ্গী। আমরা তার সাথে পৌছাই বেজমেন্টের এক ক্যাফেতে যেখানে সব ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকদের আসর বসে, অথবা জ্যোৎস্না রাতে দেখে আসি উদিয়ানার শতাব্দী প্রাচীন এক ধর্মীয় আচার, কিংবা হতবিহবল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি সদ্য বোমা-বিদ্ধস্ত এক নগরীর ধ্বংসস্তুপে। কেইচি আমাদের ন্যারেটর। সে উদিয়ানার ইতিহাস সম্পর্কে জানায়, তার ঐতিহ্য সম্পর্কে জানায় – আর আমরা যখন উদিয়ানার এই সমৃদ্ধ ইতিহাস আর তার প্রাণবন্ত ঐতিহ্য সম্পর্কে জানি – তা কোন অংশেই “ফিকশনাল” মনে হয় না। যেন পৃথিবীর মানচিত্র ফুঁড়ে বের হওয়া জীবন্ত কোন দেশ। উদিয়ানার বারুদের গন্ধ ভেসে বেড়ানো বাতাস আর এর রক্তভেজা পাহাড়, চারিদিক ছড়িয়ে থাকা এর মিথোলজি আর তার মানুষের জীবন-দর্শন, তাদের অনিশ্চয়তায় ঘেরা বর্তমান আর আশায় বুক ভরা ভবিষ্যতের সাথে আমরা একাকার হই।
“Now we are out of place in our own home,” কেইচি সেইসব মানুষের ছবি তুলে, তাদের গল্প শুনে। “You take our pictures and go home. But we have to stay here and live through all of this. Because this is the only place we can stay.” তাদের মুখে লেগে থাকা স্মিত হাসির গভীরে দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়। লুকিয়ে রাখা সেইসব ক্ষত জট পাকিয়ে বেরিয়ে আসে, দুই পাহাড়ের মাঝখানে অস্ত যাওয়ার সূর্যের ক্ষনিক আভায় দ্যুতি ছড়ায়। কেইচির ক্যামেরায় আটকা পরে যুদ্ধের রেখে যাওয়া ধ্বংসলীলা।
ইংলিশ ডাবের ভয়েস অ্যাক্টিং সহজাত। আর্ট আর অ্যানিমেশন চমৎকার। এমনকি থ্রিডি অ্যানিমেশনও আর বেশিরভাগ অ্যানিমের চেয়ে ভালো। আর সবকিছুর মতই এর ক্যারেক্টার আর মেকা ডিজাইনও বাস্তবস্মত। যুদ্ধযন্ত্রগুলো এক লাফে দশ ফুট উঠে যায় না, আকাশে ভেসে বেড়ায় না। বরং যখন নতুন তাতে নতুন এক রাইফেল লাগানোর পরিকল্পনা করা হয়, তখন বেশ কঠিন অংক কষেই তার পরিমার্জন করা হয়। তাদেরও দূর্বলতা, সীমাবদ্ধতা আছে। তারা পদার্থবিজ্ঞানে সূত্র মেনেই চলে। মেকা অ্যাকশন দৃশ্য হাতে গোনা এবং সাধারণ, বরং এর ক্যারেক্টার ড্রামাই গল্পের মূল আকর্ষন।
এর চরিত্ররদের মুভমেন্ট, ফেস এক্সপ্রেশন বাস্তবসম্মত না হয়েও বাস্তবসম্মত – সর্বদাই ক্যামেরা সামনে থাকায়, সেলফ-অ্যাওয়ার হওয়ায়, আলাদা একটা অস্বস্তি, জড়তা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আর এখানেই মূলত FLAG ভালো লাগা, না-লাগার ব্যাপারটা এসে যায়। এর গল্প যতই আকর্ষনীয় হোক, ন্যারেটিভ স্টাইলকে কোনভাবেই অগ্রাহ্য করা যায় না। তার চরিত্রগুলোর মতই ক্যামেরার উপস্থিতি সবসময়ই আমাদের চোখে লেগে থাকে। তার সাথে মানিয়ে নিতে না পারলে ১৩ পর্ব ধরে বসে থাকার মত ধৈর্য্য হওয়ার কথা না। FLAG-এর পেসিং ধীরগতির না হলেও, তখন সেটা “বোরিং” লাগাই স্বাভাবিক।
FLAG অনুসন্ধানী-সাংবাদিকতার প্রতি প্রেমপত্র। একে অ্যানিমেটেড স্যুডো-ডকুমেন্টারি বলা যায়, অথবা তার চেয়েও বেশি বলা যায় কোন ভবিষ্যৎ ডকুমেন্টারি বানানোর পেছনের গল্প – তার কাঁচামাল ইমেজ আর ভিডিওর সমাহার মাত্র। সেই ডকুমেন্টারি আদৌ বের হয় কিনা আমাদের জানা সম্ভব না। কারণ FLAG-এর কাহিনী অসমাপ্তই থেকে যায়। পৃথিবীর বুকে চলতে থাকা বর্তমান সব যুদ্ধের মতই কি না?