এন্ডলেস এইট আর মেলানকলি অফ ইউকি নাগাতো — Fahim Bin Selim

[The Melancholy of Haruhi Suzumiya এবং The Disappearance of Haruhi Suzumiya স্পয়লার সতর্কতা]
 
1
“কিওন-কুন, দেনওয়া!”
“ইউওয়ারেনদেমো, ওয়াকাত্তেইরু।”
Endless Eight-এর প্রথম দৃশ্য।
 
হারুহির ফোন, কিন্তু কিওনের মনে হয় আগে থেকেই সে জানতো তা আসবে। কীভাবে? আবার সুইমিং পুলে যখন সবার সাথে দেখা হয় – হারুহি কিছু বলার আগেই শব্দগুলো চলতে থাকে মাথায়, যেন সেগুলো অনেকবার শোনা। দেজা-ভ্যুঁ! কোইযুমি কী বলতে নিয়ে বলে না? পানির ধারে একাকী বসে থাকা নাগাতোর চেহারায় কি রাজ্যের হতাশা ভর করা? না একঘেয়েমি? ক্যাফেতে হারুহি লিস্ট করতে বসে গ্রীষ্মের ছুটির বাকি দুই সপ্তাহে যা যা করা হবে – ঘুরঘুরে পোকা ধরার প্রতিযোগিতা, খন্ডকালীন চাকরি, আকাশ পর্যবেক্ষণ, বেসবল প্র্যাকটিস, আতশবাজি উৎসব, সাহসের পরীক্ষা, চলচ্চিত্র দেখতে যাওয়া, সমুদ্রে সাঁতার কাটা, বোওলিং আর ক্যারাওকে! আর কিছু? আসাহিনা বলে, তার গোল্ডফিশ স্কুপিং-এর খুব শখ। নতুন আরেকটা যোগ হলো তাহলে – কিনগিও-সুকুই, সাথে কোনো ও-বোন উৎসবও ঘুরা হয়ে যাবে তাহলে!
সবাই যখন বাড়ির পথে হাঁটা ধরে, কিওন আবার লক্ষ করে নাগাতোকে। পেছন থেকে ডেকে জিজ্ঞাস করে সব ঠিক আছে কিনা। অভিব্যক্তিহীন চেহারায় এক শব্দের জবাব, গেনকি। আসলেই কি? গত কয়েক মাস ধরে যা কিছু সে সয়ে গেছে – কিওনের ত্রাণকর্তা হয়ে বারবার আবির্ভাব হয়ে।
 
 
2
“কিওন-কুন, দেনওয়া!”
 
লাইট নভেল ভলিউম ১ পুরোটা, আর ৩, ৫, ৬ এর অংশবিশেষ নিয়ে, ভলিউম ১ এর নামানুসারেই ২০০৬ সালে The Melancholy of Haruhi Suzumiya টিভি অ্যানিমের প্রথম সিজন প্রচারিত হয়। হয়তো ভাবা হয়েছিলো এক সিজনেই শেষ হয়ে যাবে, তাই ৬ পর্বের প্রথম আর্কের পর বাকি ৮ পর্ব মোটামুটি খন্ড কাহিনী নিয়েই তৈরি। মোট ১৪ পর্ব। কিন্তু জনপ্রিয়তার কারণে ২০০৯ সালে আবার ফিরে আসে, দ্বিতীয় সিজন নিয়ে। গতানুগতিক ধারায় দ্বিতীয় সিজন অবশ্য ঠিক বলা যায় না। নতুন আরো ১৪টি পর্ব, কিন্তু আগের ১৪ পর্বের সাথে আগে-পরে মিল করে একসাথে প্রচার করা হয় টিভিতে। মূল উপন্যাসগুলোয় কালক্রম অনুসরণ না করা হলেও, এখানে তা করা হয় – বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত – হাইস্কুলের প্রথম বর্ষ। এপ্রিলে স্কুল শুরুর দিন থেকে নভেম্বর-শেষে যখন শীত জাঁকিয়ে বসা শুরু করছে।
আরেকটা বড় পরিবর্তন – ভলিউম ৫ The Rampage of Haruhi Suzumiya-’র মাত্র একটি চ্যাপ্টার যেখানে Endless Eight, সেখানে টিভি অ্যানিমেতে তা দেখানো হলো আসলেই ৮ পর্ব ধরে! সিরিজের সবচেয়ে বড় আর্ক! উপন্যাস সবগুলোই লেখা কিওনের বর্ণনায়, সেখানে এটা যুক্তিসম্মতই যে কিওন আটকে থাকা সময়চক্রের কেবল শেষবারের কথাই মনে করতে পারবে। আর তার গ্রীষ্মের ছুটির শেষ দুই সপ্তাহের বর্ণনাও তাই হবে কেবল একবারের। তাহলে ৮ পর্ব ধরে বারবার একই জিনিস দেখানোর কী অর্থ? এই ৮টি পর্বের কারণেই যেখানে এই অ্যানিমের এত কুখ্যাতি!
প্রথমত, অবশ্যই তা কম খরচে টেলিভিশনের বেশি এয়ারটাইম দখলের জন্য না। কারণ প্রত্যেকটি পর্বের কাহিনী এক হলেও, তার প্রত্যেকটি আলাদা করে অ্যানিমেট করা। শুধু প্রথম আর শেষ পর্ব বাদে(মিৎসুহিরো ইওনেদা) বাকি সব পর্বের পর্ব-পরিচালক আলাদা। কোন দুই পর্বের একই সীনের মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমনকি প্রত্যেক পর্বের অ্যানিমেশন কিংবা ন্যারেটিভ স্টাইল একটা আরেকটার চেয়ে ভিন্ন। দ্বিতীয় পর্ব Endless Eight II যেমন আর বাকি সব পর্বের চেয়ে স্বতন্ত্র তার অতিউজ্জ্বল কালার কম্পোজিশনের জন্য, এই পর্বে আবার অনেক বেশি ফ্যানসার্ভিসও দেওয়া(পর্ব-পরিচালক তোমোয়ে আরাতানি)। তবে আমার সবচেয়ে প্রিয় পঞ্চম পর্ব Endless Eight V, যার পর্ব-পরিচালক সিরিজের নির্মাতা নিজেই – তাৎসুইয়া ইশিহারা(Hibike, Clannad, Kanon, Nichijou, Air)। এই পর্বে কিছু কিছু জিনিস আলাদাভাবে দেখানো, যা আর বাকি কোন পর্বে হয় না। এটা শুধু এই আর্কই নয় পুরো সিরিজেরই অন্যতম সেরা পর্ব। আগষ্ট ৩১-এর রাতে সময় যখন ১২টার দিকে আগায় তখন একই সাথে ক্যামেরাটাও ঘুরতে থাকে; বিছানায় থাকা কিওন আর ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটাটার মধ্যে পর্যায়ক্রমে বদলাতে থাকে দৃশ্য, যতক্ষণ না পর্যন্ত তিনটি কাটা মিলিত হয় একসাথে – সিরিজের অন্যতম সেরা দৃশ্যও এই পর্বে!
দ্বিতীয়ত,…
 
3
“কিওন-কুন, দেনওয়া!”
 
হারুহির ফোনে সকাল সকাল কিওনের ঘুম ভাঙ্গে। ও-বোন উৎসবে সবাই মিলে ইউকাতা পরে না গেলে গ্রীষ্মের ছুটি পূর্ণ হবে কী করে! হারুহি আর আসাহিনা গোল্ডফিশ স্কুপিং-এ যায়। কিওন ইউকিকে প্রথমে খাবার কিনে দিতে চায়, পরে আবার ইউকি মুখোশ কিনতে গেলে, তার টাকা দিতে চায়। ইউকি দুবারই না করে দেয়, ইই। দোকান থেকে আলট্রাম্যান-এর একটা মুখোশ কিনে নেয় ইউকি। আলট্রাম্যান – যে মানুষের দেহে স্থান নেওয়া প্রযুক্তিগত অত্যুন্নত ভিনগ্রহবাসী! আর কার মত যেন?
আতশবাজি ফাটানোর সময় কিওন প্রথম অযাচিত প্রসঙ্গটা তুলে। ছুটিতে মজা করে বেড়ানো ভালো, হ্যাঁ, কিন্তু এত যে বাড়ির কাজ বাকি তা কবে শেষ করবে সবাই! হারুহি জানায় সে তো তার গুলো আগেই শেষ করে ফেলেছে। কিন্তু বাকিদের কী হবে? পরদিন সারাদিন লাগিয়ে ঘুরঘুরে পোকাগুলো বাক্সে ধরে আবার দিনশেষে ছেড়ে দেওয়ার সময় কিওনের নিজেকে প্যান্ডোরা বলে মনে হয়। কিন্তু বাক্সটা সে তো খুলেছে আগেরদিন রাতেই।
 
 
4
“কিওন-কুন, দেনওয়া!”
 
২০০৬ আর ২০০৯ দু্টো সিরিজেরই শেষ পর্ব Someday in the Rain. নভেম্বর-শেষের কোনো এক দিন। কিওনের বাজারে যাওয়া প্রয়োজন। ঢালটা বেয়ে নামতে হবে, তারপর ট্রেনে আসা-যাওয়া, আবার ঢালটা বেয়ে উঠতে হবে। এই শীতল দিনে! হারুহির বাকপটুতার খাতিরে দোকান থেকে পটিয়ে পাওয়া বিনামূল্যের একটা হিটার নিয়ে আসার জন্য। আর নাগাতো বই পড়ে একা দিনটা কাটায় ক্লাবঘরে, যখন বাকি তিনজন ব্যস্ত আসাহিনার ফটোশ্যুট নিয়ে। বৃষ্টি পড়ার সম্ভাবনা ১০%। কিন্তু ফেরার পথেই তার শিকার হয় কিওন। ক্লান্ত আর কিছুটা কি বিরক্ত কিওন ক্লাবঘরে এসে ঘুমিয়ে পড়ে। সাথে উপস্থিত একমাত্র নাগাতো।
 
 
5
কিওন-কুন, দেনওয়া!
 
আসাহিনার ফোনে মধ্যরাতে ঘুম ভাঙ্গে কিওনের। মস্ত গোলযোগ! ভবিষ্যতে আর ফেরত যাওয়া যাচ্ছে না। আসলে ভবিষ্যতে বলেই তো আর কিছু নেই, যেখানে সময় এক চক্রের মধ্যে আটকে আছে। কোইজুমি ব্যখ্যা করে কিওনকে:
– We are currently looping through the same period of time over and over again.
– What?
– We are currently looping through the same period of time over and over again.
-…
– We are currently looping- (Endless Eight III, পর্ব-পরিচালক ইয়োশি কিগামি)
নির্দিষ্ট করে বললে আগষ্ট ১৭ থেকে আগষ্ট ৩১। গ্রীষ্মে ছুটির শেষ দুই সপ্তাহ। একই ১৪ দিন। বারবার। এর কারণেই তো বারবার দেজা-ভ্যুঁর অনুভূতি হচ্ছিলো! আগের চক্রগুলোর অবশিষ্ট স্মৃতি। বাকিদের স্মৃতি বারবার পুনর্লিখিত হলেও একজন কিন্তু প্রত্যেকটি ১৪ দিন একইভাবে মনে রেখেছে, স্থান-কালের বাধা থেকে যে মুক্ত।
কতবার এই চক্রর ভেতর দিয়ে গেছে নাগাতো?
১৫,৪৯৮ বার।
১৫,৪৯৯ বার।
১৫,৫১৩ বার।
১৫,৫২১ বার।
১৫,৫২৪ বার।
১৫,৫২৭ বার।
১৫,৫৩২ বার।
পেছনে দায়টা কার?
কোইযুমি জানায়, হারুহি।
 
 
6
“কিওন-কুন, দেনওয়া!”
 
২০১০-এর মুক্তি পেল ভলিউম ৪ নিয়ে পুরো একটা মুভি The Disappearance of Haruhi Suzumiya, ২ ঘন্টা ৪২ মিনিট, মোটামুটি হিসেব করলে ৮ টিভি পর্বের সমান!
এসওএস ব্রিগেডের বড়দিনের পার্টির ঠিক এক সপ্তাহ আগে, ১৮ আগষ্ট সকাল। কিওন ঘুম থেকে উঠে আবিষ্কার করে পুরো জগৎটা পালটে গেছে। হারুহি এখন আর তার স্কুলে পড়ে না, কোইযুমিও। আসাহিনা কেবলই উপর ক্লাসের একজন সিনিয়র। নাগাতো, লিটারেচার ক্লাবের একমাত্র সদস্য। কেউ এসপার না, টাইম ট্রাভেলার না, ইন্টেগ্রেটেড ডেটা এনটিটির ইনটারফেস না! সাধারণ মানুষ। কিওনের সাধারণ, চাঞ্চল্যহীন জীবনে।
প্রথম পর্বে ক্লাস শুরুর আগে কিওনের মনোলোগে যখন শোনা যায় – “Deep in my heart, I wished that aliens, time travelers, ghost, demons, espers or evil organizations might pop up in front of me. But reality is rather cruel.”, সেই বাস্তবতা ৯ মাস পর এসে নির্মমতার রূপ ধরলো? সেই সাদাকালো প্রোলোগের দৃশ্য, যা হঠাৎ করেই রঙিন হয়ে যায় যখন হারুহি ঘোষণা দেয়, “…Haruhi Suzumiya. I have no interest in ordinary humans. If there are any aliens, time travelers, sliders, or espers, come join me.”
হারুহির অগোচরেই যে এতদিন আসাকুরা এসে খুন করার চেষ্টা করলো কিওনকে, একের পর এক তৈরী হল ক্লোজড স্পেস, তারপর সময়চক্র; বেসবল ব্যাট থেকে ছুটলো হোমরানের ফোয়ারা, শরৎকালে সাকুরা গাছে ফুলে ভরে গেলো, লাল পায়রারা সাদা বেশ ধরলো, আসাহিনার লেন্স থেকে লেজার এসে আঘাত করতে নিলো কিওনকে। জগত ধ্বংসের কাছাকাছি চলে গেলো কয়েকবার।
এতদিন পর এসে কি কিওন হারুহির অত্যাচারে ক্লান্ত, বিরক্ত?
 
 
7
“কিওন-কুন, দেনওয়া!”
 
আকাশ পর্যবেক্ষণের রাত। নাগাতোর এপার্ট্মেন্টের ছাদে। কোইজুমির নিয়ে আসা টেলিস্কোপ। হারুহি বলে, এর চেয়ে ইউএফও খুঁজে বের করা মজার। কিওনকে জিজ্ঞেস করে সে ভিনগ্রহবাসীতে বিশ্বাস করে কিনা। নাগাতোর চোখ রাখা টেলিস্কোপে। বেসবল প্র্যাকটিস কিংবা সাহস পরীক্ষার সময়(Endless Eight V) কিওন ইউকিকে জিজ্ঞেস করে, সে কেন সময়চক্রের কথা আগে থেকেই তাদের বলেনি। নাগাতো জানায় অংশগ্রহণ করা তার কাজ না, সে কেবল একজন দর্শক।
কিন্তু আসাকুরার আক্রমণ, আসাহিনার লেজাররশ্মি, ক্লোজড স্পেসে ঝিঁঝিঁ পোকার আক্রমণ, কিংবা হারুহির সাথে আটকে পড়ার সময় কম্পিউটারে দিয়ে দেওয়া হিন্ট – বারবারই তো হস্তক্ষেপ করেছে ইউকি! আবির্ভাব হয়েছে ত্রানকর্তা হিসেবে! কিওনের।
বারবার চক্রে আটকে থেকেও তা মেনে নিয়েছে, কিওনের হোমওয়ার্ক যে এখনো করা হয়নি! নাগাতোর থাকার কথা ছিলো নীরব দর্শক। নিরপেক্ষ, অনুভূতিশূন্য। কিন্তু ইন্টেগ্রেটেড ডেটা এন্টিটির তৈরি হিউম্যানয়েড ইন্টারফেসেরও অনুভূতি জন্মাতে শুরু করলো।
 
 
“কিওন-কুন, আসাদায়ো, ওকিতে!”
 
…দ্বিতীয়ত, Endless Eight আর Disappearance-এর সমাপ্তীর সম্পূর্ণ গভীরতা উপলব্ধির জন্য Endless Eight-এর আটটি পর্বের মধ্যে দিয়ে যাওয়া এক রাইট অফ প্যাসেজ। Disappearance-এর কিওনের মনোলোগের মাঝে নিজের মাথায় পা রাখার দৃশ্যটা যেখানে পুরো সিরিজের সবচেয়ে আইকনিক দৃশ্য হিসেবে ধরা হয়, তখন আরো দুটো দৃশ্যের কথা ভুলে যাওয়া রীতিমত অপরাধই।
Endless Eight-এর শেষ পর্বের অবশেষে ক্যাফেতে বসে কিওন শেষবারের মত যখন চিন্তা করে আর কী করা বাকি আছে, তখন আগের ১৫,৪৩১ পুনরাবৃত্তির স্মৃতি তার মাথায় এসে হানা দেয়, আমাদেরও, অন্তত আগের ৭ বারের, হানাবি, সমুদ্রের ডাক, তারাভরা আকাশ, আর হাতে ফেরত আসা ঘুরঘুরে পোকা; ৭০ সেকেন্ডের মনোলোগের পর কিওনের ঘোষনা, “I HAVEN’T FINISHED MY HOMEWORK YET.”
প্যান্ডোরার বাক্স বন্ধ হলো। কিন্তু তার সবটুকুর জন্যই তো Endless Eight পার করে আসা দরকার ছিলো।
Disappearance-এর শুরুর কারণটা বুঝার জন্যও। এক আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের অনুভূতি জন্মানোর জন্য কী প্রয়োজন? এতদিন পর এসে হারুহির অত্যাচারে ক্লান্ত, বিরক্ত হওয়ার জন্য? তাকে বিষাদ গ্রাস করার জন্য? নীরব দর্শক থেকে সম্পূর্ণ জগতটাই পালটে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার মত অবস্থায় পৌছানোর জন্য? এর চেয়ে বেশি অংশগ্রহণ তো আর সম্ভবও না!
আসাকুরা, আসাহিনা কিংবা ঝিঁঝিঁপোকার আক্রমণ, সবকিছুই অনুঘটক কিন্তু তার চেয়েও বেশি ১৫,৪৩২ বারের সময়চক্রে আটকে থাকা; ১৫,৪৩২ বার, ২ সপ্তাহ করে, ২১৭,৪৪৮ দিন, ৭,১৪৮ মাস…প্রায় ৫৯৫ বছর। হারুহি কিংবা কিওনের খেয়ালের কারণে। হাসপাতালের ছাদে কিওন আর নাগাতো…ইউকির কথোপকথনের সময় তো কেবল আগের আড়াই ঘন্টার কাহিনীই না, Endless Eight-এর প্রতিটি মুহূর্ত তুষারপাতের মত এসে স্মৃতিতে জমা হয়। এত কিছুর পর এবার Great Goddess ইউকিরই তো এক ত্রানকর্তার দরকার ছিলো। আর কিছু না হোক, কেবল একটি কথা বললেই হবে-
 

মিলেনিয়াম একট্রেস ও একটি জাতির পুনর্জন্ম — Fahim Bin Selim

[সহযোগ
কন আর্ট – স্বপ্ন, বিভ্রম আর চলচ্চিত্রের প্রতি প্রেমপত্র: http://www.animeloversbd.com/satoshi-kon-fahim-bin-selim/]
 
তাইওয়ানিয় চলচ্চিত্র নির্মাতা এডওয়ার্ড ইয়াং-এর ২০০০ সালের চলচ্চিত্র Yi Yi-এর এক পর্যায়ে এর অন্যতম চরিত্র পাঙ্গজি বলে, “[…]we live three times as long since man invented movies.”
চিয়োকো ফুজিওয়ারা বেঁচে থাকলো এক সহস্রাব্দ – জীবন, স্মৃতি আর চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে – সেনগোকু কাল থেকে দূর ভবিষ্যৎ পর্যন্ত; যে সময়টায়, চন্দ্রমাসের চতুর্দশ দিন হোক আর পঞ্চদশ, চাঁদের পুরোটা জুড়েই মানুষের পদচারণা, আর অসীম মহাকাশের দিকে যাত্রা শুরুর জন্য তার উপর তৈরি পদ্মাকৃতির ঘাঁটি।
কোনো কোনো পদ্মফুল বেঁচে থাকতে পারে হাজার বছর। ঠিক যেমনটা জাপানিরা বিশ্বাস করে লালচাঁদি বা মাঞ্চুরিয়ান সারসের ক্ষেত্রে। তাই তো সারস নকশার কিমোনো জড়িয়ে জন্ম চিয়োকোর, ১৯২৩-এর বৃহৎ কান্টো ভূমিকম্পের সময়। ভূমিকম্পের সাথে জাপান আর চিয়োকোর যোগসূত্র চিরকালের। তার বাবার মৃত্যুও এসময়টায়। চিয়োকো বলে, একজনের জীবনের পরিবর্তে যেন আরেকজনের জন্ম।
 
 
চিয়োকোর তখনো বাইরের বিশ্বের সাথে সংযোগ হয়নি। ম্যাগাজিনের পাতায় নায়ক-নায়িকাদের ছবি দেখে অপার মুগ্ধতায় ডুবে থাকে। এই কৈশোরেই তার সাথে পরিচয় মুখে-ক্ষতওয়ালা একজন সেনার কিংবা একটি রাস্ট্রের, মাথায় টুপি-পড়া নাম-না-জানা একজন বিদ্রোহীর কিংবা একটি আদর্শের; আর প্রথম ভালোবাসার। তবে জাপান সাম্রাজ্যের কাছে তখন ভালোবাসার একমাত্র সংঙ্গা জাতীয়বাদ। আর তার একমাত্র লক্ষ্য সম্প্রসারণ। তারই প্রেক্ষিতে ১৯৩১-এ চীনের শাসনাধীন মাঞ্চুরিয়া দখল করে বসানো হলো মাঞ্চুকুয়ো পুতুল রাস্ট্র। শুরু হলো দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধ। কোরীয় উপদ্বীপ আর দক্ষিণ মাঞ্চুরিয়ার রেল-এলাকা আগে থেকেই তাদের দখলে ছিলো। মাঞ্চুরিয়ার সাধারণ মানুষের উপর চালানো হলো নিপীড়ন; ভাগ্য ভালো থাকলে তাদের জোরপূর্বক শ্রমে কাজে লাগানো হবে, ভাগ্য খারাপ থাকলে হতে হবে জৈব-রাসায়নিক গবেষণার বস্তু। এখানেই বসানো হলো মাঞ্চুকুয়ো ফিল্ম এসোসিয়েশন, আর তার অধীনে নির্মিত হতে শুরু করলো সব প্রোপাগান্ডা চলচ্চিত্র। জাতীয়তাবাদের সুরায় তখনও নেশাগ্রস্থ সাধারণ জাপানিরা।
 
 
ভালোবাসার আশায় সেখানেই পদার্পণ চিয়োকোর। সময়ে সময়ে তার অভিনীত চলচ্চিত্র, স্মৃতিতে থাকা মাঞ্চুরিয়ার জীবন আর গেনিয়ার কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকার – তিন স্তরের আখ্যান যেন একসাথে মিশে যায়। বিদ্রোহীর খোঁজে উত্তরের রেলযাত্রায় চিয়োকোর প্রথম দেখা মিলে প্রতিরোধশক্তির – দেশরক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়া চৈনিক সৈন্যদল। “জাতীয়তাবাদী নাকি সাম্যবাদী?” একজন যাত্রী জিজ্ঞেস করে। জীবনমরণের প্রশ্নে সেটায় কীইবা তফাত! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে সময়। নানকিং, ওকিনাওয়া কিংবা হিরোশিমা-নাগাসাকি তখনো লাশের ভাগাড়ে পরিণত হয়নি।
 
সবশেষে পড়ে রইলো একটি বিধ্বস্ত বিশ্ব। আর একটি বিধ্বস্ত জাতি। সেই জাতির ফিরে আসার অবলম্বন হলো চলচ্চিত্র। গেনিয়ার স্বগোতক্তি,পঞ্চাশের দশক চিয়োকোর সেরা সময়। জাপানের চলচ্চিত্রেরও তো স্বর্ণযুগ এটাই। যুদ্ধপরবর্তী বাস্তবতায় একদল তরূণ আর মাঝবয়সী লোক নেমে পড়লো ক্যামেরা হাতে – কেঞ্জি মিযোগুচি, মাসাকি কোবায়াশি, আকিরা কুরোসাওয়া, মিকিও নারুসে, ইয়াসুজিরো ওযু – জাপানের বর্তমান আর অতীত সেলুলয়েডে তুলে ধরতে। তা যত তিক্তমধুরই হোক। একটি জাতির টিকে থাকার আশা-আকাঙ্খা, অনুভূতি আর অনুতাপের সাথে বহির্বিশ্বের পূনর্পরিচয় হলো কুরোসাওয়া আর কোবায়াশিদের প্রতিটি শট, প্রতিটি ফ্রেমে। আর এই নতুন জাপানি চলচ্চিত্রের মুখপাত্র হলো অদম্য কিছু নারী চরিত্র। চিয়োকো তো বেঁচে রইলো তাদের মাঝেই।
 
সঙ্গী হয়ে আকিরা কুরোসাওয়ার সাথে যাত্রায় প্রাচীন জাপানে। কখনো সে যেন ইসুযু ইয়ামাদা, তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় এক প্রেতাত্মা। আর দেওয়ালের রক্তের ছোপ। প্রতিশোধ আর প্রতিহিংসার। সে অবলোকন করে অন্ধবিশ্বাস আর ঔদ্ধত্য, বিশ্বাসঘাতকতা আর পতন। কখনোবা মিসা উয়েহারার মত ঘোড়সওয়ার হয়ে তার খুঁজে বেড়ানো বিদ্রোহীর, আর পেছনে সবসময় লেগে থাকা মুখে-ক্ষতওয়ালা সেই ব্যক্তির; ভিন্ন বেশে, ভিন্ন সময়ে, সবসময়। সেনগোকু, এদো, মেইজি – প্রেতাত্মার অথবা সময়ের চরকার অনবরত ঘূর্ণন, আর বারবার ফিরে আসা একই জায়গায়। যুদ্ধ-বিগ্রহ, ক্ষমতালোভ, আর রক্তের ধারা। যুগে যুগে শান্তির এক নিরন্তর খোঁজ।
 
আকিরা কুরোসাওয়ার Throne of Blood

 

 

লেডি আসাজি চরিত্রে ইসুযু ইয়ামাদা; আকিরা কুরোসাওয়ার Throne of Blood

 

 

প্রিন্সেস ইউকি চরিত্রে মিসা উয়েহারা; আকিরা কুরোসাওয়ার The Hidden Fortress

 

মিকিও নারুসের দৃষ্টিপাত বরং নিকট অতীত আর বর্তমানে – যুদ্ধ-পূর্ববর্তী এক গ্রামীন স্কুল কিংবা যুদ্ধ-শেষে টোকিওর ধ্বংসস্তুপ। যুদ্ধের ভয়াবহতা যে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে দেশের ভিতরেও চলে এসেছিলো। আকাশে ভেসে বেড়ানো কালো মেঘের ভেতর থেকে বর্ষণ হলো গুলি-বোমা। তা বিদায় নিলে আবার হাজির দূর্ভিক্ষ, বাস্তুহরণ আর বেকারত্ব। আর নিজভূমে থেকেও পরাধীনতার স্বাদ পাওয়া প্রথমবারের মত। রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো আমেরিকান সেনারা জানান দেয় সেই নতুন বাস্তবতার। সে সময়টায় চিয়োকো মাথায় জড়ায় হিদেকো তাকামিনের স্কার্ফ। ভাঙ্গা কাঠ আর জঞ্জালের নিচে হাতড়ে ফিরে স্মৃতি আর স্বপ্ন। গলায় তখনো ঝুলতে থাকে সেই আরাধ্য চাবি।

ওইশি-সেনসেই চরিত্রে হিদেকো তাকামিনে; মিকিও নারুসের Twenty-four Eyes

 

 

ইউকিকো কোদা চরিত্রে হিদেকো তাকামিনে; মিকিও নারুসের Floating Clouds

 

কারণ তবুও তো জীবন থেমে থাকে না। ইয়াসুজিরো ওযু তাই আসন গাড়েন মেঝেতে, ক্যামেরা সাজান এমনভাবে যাতে ধরা পড়ে পুরো ঘর আর তাতে থাকা সব মানুষ। বাইরের সব কোলাহলমুক্ত, অন্তত ব্যক্তিগত এই জায়গা-ই তো শেষ সম্বল। অতীতকে পাশে রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্রণা দেন। সেৎসুকো হারার হাসি জায়গা নেয় চিয়োকোর ঠোঁটে। নাকি তার পুরোটাই দখল করে নেয়! তাই কি ষাটের দশকের মাঝ থেকে দুজনেই হারিয়ে গেলো লোকচক্ষুর আড়ালে?

নোরিকো চরিত্রে সেৎসুকো হারা; ইয়াসুজিরো ওযুর Late Spring

 

সে-ও তো অনেক বছর আগের কথা। সবার স্মৃতিতেই কিছুটা মরচে পড়েছে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে কীভাবে! চিয়োকো যে পান করেছে অমরত্বের সুধা। ফিল্মের ফিতা আর গেনিয়ার মুগ্ধতায় চিয়োকোর প্রতিটি সংলাপ আর অভিব্যক্তি টিকে আছে আগের মতই। তাই গেনিয়া হাজির হলো চাবি নিয়ে। ধুলোর আস্তরণ সরিয়ে খুলে বসলো বাক্সটা আবার। চিয়োকো, জাপান, সাতোশি কনের নিজের কিংবা আমাদের স্মৃতির। মুখে-ক্ষতওয়ালা লোকটা এখনো বিদ্যমান; নতুন চরিত্র নিয়ে, নতুন জায়গায় দখলদারিত্ব আর সাম্রাজ্যবিস্তারের সেই পুরনো নাটকের মঞ্চায়ন।

তাই চিয়োকো বাড়ির পশ্চাতে জন্মায় তার অতিপ্রিয় পদ্মফুল। কর্দমাক্ত মাটিতে শিকড় গেড়েও সেগুলো যখন পানির উপর ভেসে উঠে তখন থাকে শ্বেতশুভ্র। শত ঘাত-প্রতিঘাতের পরও আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হওয়ার দর্শন নিয়ে প্রস্ফুটিত যেন: মানবসভ্যতার অন্ধরূপের সাথে সাক্ষাতের পরও তার উপর আশা না হারানোর প্রতিজ্ঞা, মাঝেমাঝেই সেই আশা দুরাশা বলে সাব্যস্ত হলেও; জীবন আর মৃত্যুর অনন্ত চক্রে বিদ্রোহীর খোঁজে সময় আর কাল পাড়ি দেওয়ার সংকল্প, তার চেহারা এখন বিস্মৃত হলেও। মাঞ্চুরিয়া কিংবা দূর মহাকাশে। শান্তির খোঁজে। ভালোবাসার খোঁজে। পথচলাটাই মুখ্য।
আর সেই পুনর্জন্ম কিংবা নির্বাণের যাত্রায় চলচ্চিত্রের চেয়ে ভালো মাধ্যম আর কী হতে পারে?

তাতামি গ্যালাক্সিতে কিয়োটো — Fahim Bin Selim

তাতামি গ্যালাক্সি দেখতে গেলে প্রিয় চরিত্র খুঁজতে বেগ পেতে হবে না। ওয়াতাশি আর আকাশি তো প্রত্যাশিতই। ওয়াতাশির দুই বছরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের টানাপোড়েনে আমরা পরিচিত হই ওযু, আর হিগুচি-সেনসেই, বা তাদের সাথে জুড়ে যাওয়া জৌগাসাকি আর হানুকির সাথে। একেক পর্বে একেক জনের সাথে কাটাই। তাদের সাথে পরিচিত হই দূর বা কাছ থেকে, নিজের চোখে আর মানুষের বর্ণনায়, ভিন্ন দৃষ্টিকোণ নিয়ে। শুধু পর্দায় থাকা কোন ছবি না, সম্পূর্ণ গভীরতা নিয়ে;স্ব স্ব আকাঙ্ক্ষা আর হতাশা থাকা, ভালো আর খারাপের মিশেলে, ত্রিমাত্রিক মানুষ হিসেবে। এমনকি স্বল্প সময়ে পর্দায় থাকলেও সবসময়ই নেকো রামেন বিক্রেতা, জ্যোতিষী বৃদ্ধা কিংবা কোহিনাতার উপস্থিতিও অনুভব করা যায়। তবে এই সবগুলো চরিত্রকে একসাথে জুড়ে আনার ক্ষেত্রে যেটার অবদান, অ্যানিমের মূল উপন্যাসের লেখক তোমিহিকো মোরিমির বাকি কাজেও(যেমন- উচুতেন কাযোকু) যেটার প্রভাব লক্ষণীয়, সেটা কোনো রক্তমাংসের মানুষও না – সব ঘটন আর অঘটনের মঞ্চ, একই সাথে আধুনিক আর পুরাণের জাপান যেখানে একত্রিত হয়, সেই কিয়োটো শহর!

কিয়োটোর একাংশ

ওয়াতাশির সাড়ে চার তাতামির ঘরটার কথাই চিন্তা করা যাক, এর অবস্থান শিমোগামো ইউসুইসৌ বোর্ডিং হাউজে। ওয়াতাশি যেটার তুলনা করে হংকং এর কোওলুন ওয়ালড সিটির সাথে। ১৯৯৩-এ ধ্বংসের আগে কোওলুন ওয়ালড সিটি তো ছিলো এরকম এক ঘিঞ্জি এলাকাই – আলো-বাতাসের প্রবেশ এখানে সীমিত, রঙচটা আর নোটিশ-বিজ্ঞাপনে ঢাকা দেওয়াল, আগোছালো আধোয়া জামাকাপড়ের স্তুপ, এবং তার মাঝে পরজীবী বিড়াল, তেলাপোকা আর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের বসবাস।

এইযান দেমাচিইয়ানাগি স্টেশন

 

ওয়াতাশির ঘরের জানালার কাঁপন আর ভেসে আসা শব্দে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিয়ে যায় এইযান দেমাচিইয়ানাগি স্টেশনের আগত আর বিদায়ী ট্রেনেরা। কামো নদীর পূর্ব পাড়ের এইযান দেমাচিইয়ানাগি স্টেশনের নাম হয়েছে এপাশে ইয়ানাগি আর পশ্চিমে দেমাচি এলাকার নাম জুড়ে দিয়ে। এই স্টেশনের ভূতলে চলে কেইহান রেলওয়ে; বয়স আর অবস্থানে তার উচ্চাসনে এইযান ইলেকট্রিক রেলওয়ে। ১৯২৫ সালে বসানো এই এইযান ইলেক্ট্রিক রেলওয়ের যাত্রাপথ অবশ্য কেবল কিয়োটোর সাকিও ওয়ার্ডের ভিতরেই বিদ্যমান; দেমাচিইয়ানাগি থেকে উত্তরে গিয়ে তাকারাগাইকেতে দুইভাগে ভাগ হয়ে – পূর্বে ইয়াসে-হেইযানগুচি আর পশ্চিমে কুরামা স্টেশন – সর্বসাকুল্যে ১৪.৫ কিলোমিটার এর মধ্যে। ট্রেনেদের আনাগোনাও তাই খুব নিয়মিত।

শিমোগামো ইউসুইসৌ বোর্ডিং হাউজের আরেক বাসিন্দা আট বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরে থাকা হিগুচি। কখনো বাড়ির পাশের রাস্তায়, কখনো বা দেমাচিইয়ানাগি স্টেশন থেকে ১০ মিনিটের হাঁটা দুরত্বে শিমোগামো মন্দিরের পাশের তাদাসু নো মোরিতে হাজির হয় রহস্যময় নেকো-রামেনের ফেরি; সেখানে সাক্ষাৎ মিলে তার। হিগুচি নিজের পরিচয় দেয় কামো তাকেৎসুনোমি হিসেবে, এই শিমোগামো মন্দিরের দেবতা। তাদাসু নো মোরি, শিমোগামো মন্দির আর কিছুটা উত্তরে তার যুগল কামিগামো মন্দিরের সাথে কিয়োটোর সম্পর্ক তো হাজার বছরের।

শিমোগামো মন্দির

 

সহস্রবর্ষী এক আদিবনের অবশেষ হিসেবে পরে আছে এই তাদাসু নো মোরি। মধ্যযুগ আর মেইজিকালের অনুশাসনের সময় এর আকৃতি কমে এলেও, কিয়োটোর সব যুদ্ধ আর ধ্বংসযজ্ঞের শিকার এবং সাক্ষী হিসেবে মানবহস্তের সাহায্য ছাড়াই বারবার পুনোরুত্থান ঘটেছে তার। এই বনের ভেতরেই ষষ্ঠ শতাব্দীতে শিমোগামো মন্দিরের সূচনা, তারও কিছুকাল পর কামিগামো মন্দিরের। এমনকি কিয়োটোও তো তখনো জাপানের প্রাচীন রাজধানী হয়ে ওঠেনি! শিমোগামো মন্দিরে এসে মানুষ অর্চনা করে দুজনের – তামাইয়োরি-হিমে আর তার পিতা দেবতা তাকেৎসুনোমির। তামাইয়োরি-হিমে আর আগুন-ও-বিদ্যুতের দেবতা হোনোইকাযুচি-নো-মিকোতোর ভালোবাসার ফসল কামো ওয়াকাইকাযুচির জন্য বিদ্যমান কামিগামো মন্দির। তামাইয়োরি-হিমে আর হোনোইকাযুচি-নো-মিকোতোর মিলনের এই পুরাকথার রেশ ধরেই রোজ পাণিপ্রার্থীদের আগমন শিমোগামো মন্দিরে।

তাদাসু নো মোরি
 
ভালোবাসার লাল বন্ধন জোড়া লাগাতে এমনকি অযাচিত সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটাতে হলেও হাজির হওয়া যায় ইয়াসুই কনপিরাগু মন্দিরে, যার অবস্থান কিছুটা দক্ষিণে হিগাশিইয়ামা ওয়ার্ডের গিওন কর্ণারে। অন্যান্য মন্দিরে যেখানে এমা আকৃতির ফলকে নিজের মনোবাসনা লিখে ঝুলিয়ে দিতে হয়, সেখানে এই মন্দিরে আছে এমা আকৃতির বিশাল আকারের একটি এনমুসুবি(সম্পর্ক জোড়া লাগানো) পাথরই। সাদা কাগজে নিজের বাসনা লিখে এই পাথরের ভেতরে গর্ত দিয়ে একবার ঢুকে আবার বেরোতে হয়, তারপর আরো হাজার হাজার কাগজের পাশে নিজেরটা জুড়ে দিতে হয় পাথরের গায়ে, দেবতার প্রতি আবেদন হিসেবে। এই মন্দিরের মূল উৎসব হয় অক্টোবরে, শুকি কনপিরা তাইসাই(বৃহৎ কনপিরা শরৎ উৎসব)। এর এক উল্লেখযোগ্য অংশ হলো মিকোশি নামক কাঠের তৈরি নৌকা-সদৃশ বহনীয় মন্দির নিয়ে শহরের রাস্তাগুলো প্রদক্ষিণ করা।
 
 
ইয়াসুই কনপিরাগু মন্দির

 

এই কনপিরাগু আর শিমোগামো আর কামিগামোর, সর্বজাপানেরই দেবতাদের তাদের মন্দিরগুলোতে অবশ্য পাওয়া যাবে না দশম চন্দ্রমাসে, যেটাকে বলা হয় কান্নাযুকি(দেবতাশূন্য মাস)। দেবতারা তাদের ভক্ত আর উপাসকদের সকল ইচ্ছা-আকাঙ্খা-কামনা-বাসনা-আর্জি নিয়ে হাজির হয় ইযুমো শহরের ইযুমো-তাইশা মন্দিরে। পরবর্তী বছরের জন্ম-মৃত্যু আর বিয়ের ভাগ্য লিখন নিয়ে দেবতাদের সম্মেলন বসে সেখানে। সে শহরের অবশ্য এই মাসেরই নাম আবার কামিআরিযুকি(দেবতাদের মাস)। সম্পর্ক জুড়তে চাইলে এটাই তো সময়!

কিন্তু বারবার যে ভজকট পাকিয়ে ফেলে ওয়াতাশি! আকাশির সাথে কচ্ছপ-মাজনী খুঁজতে ঘুরে বেড়ায় কাওয়ারামাচিতে। শিমানামি বাইকরেস চলার মাঝে তাদের দেখা হয় কেয়াগে ঢালের পাশের রাস্তায়। আবার কখনো ওযুর ফাঁদে পরে, কখনো বা সত্যি সত্যিই চেরী সাইকেল ক্লিনার কর্পসের নেতা হিসেবে এখানেই ধরা পরে যায় আকাশির হাতে। মজার ব্যাপার হলো কেয়াগে ঢাল ঘুরতে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময় হলো বসন্তকাল, যখন এই ৫৮২ মিটার দীর্ঘ আর উপর থেকে নিচে ৩৬ মিটার উঁচু ঢাল দিয়ে হেঁটে গেলে দেখা মিলবে সারি বেধে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের ডালে ডালে ফুটতে থাকা চেরী ফুলের। ঢালটির উপর দিয়ে চলে গেছে রেললাইন, যাতে করে একসময় নিচে বিওয়া হ্রদের ক্যানেল থেকে উপরে কেয়াগে স্টেশন পর্যন্ত জলযান উঠানো নামানোর হতো। সেই পানিপথ অনেক কাল যাবত বন্ধ দেখেই কিনা বার্ডম্যান সঙ্ঘের উড়োজাহাজ চুরি করে নিয়ে যাওয়ার কাজে চেরী সাইকেল ক্লিনার্স কর্প সেটা ব্যবহার করা শুরু করলো! ঢাল বেয়ে নামতে নামতে উড্ডয়ন হলো ওয়াতাশির…তারপরই তো আবার পানিতে মুখ থুবড়ে পড়া।

কেয়াগে ঢাল
 
দুই বছরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তে দগ্ধ ওয়াতাশিকে তাই বারবার ফিরে আসতে দেখি কিয়ামাচি সরণিতে। এক পাশে তাকাসে আর আরেক পাশে কামো নদীকে আলাদা করে রেখেছে এ সড়কটিই। তবে তার সকল সমস্যার সমাধানটাও বাতলে দেয় জ্যোতিষী বৃদ্ধা।
কিয়ামাচি সড়ক

 

কামো ওওহাশি ব্রিজ ও কামোগাওয়া ডেল্টা
 
চোখের সামনে দুলতে থাকা সুযোগটা হাত বাড়িয়ে নিতে হবে। তারপর পদক্ষেপ নিয়ে নদীকে পাশে রেখে সামনে এগিয়ে গেলেই তো হয়। সেখানেই তো – এই যে দেমাচিইয়ানাগির পাশেই কামোগাওয়া ডেল্টা; সাকিও ওয়ার্ড আর কামিগিয়ো ওয়ার্ডের মেলবন্ধন করতে এখানেই কোন এমার মত ঝুলে আছে কামো ওওহাশি ব্রিজ। হিগুচির গান কিংবা জীবন সম্পর্কিত গভীর বয়ান শুনতে হলে এখানেই ফিরে আসতে হবে চক্র পূরণ করে। গোজান উৎসবের রাতে পাঁচ-পাহাড়ে জ্বলা অগ্নি প্রতীক দেখতে শহরের মানুষজনও হামলে পড়বে এখানেই। আর নিচ দিয়ে কামো নদী বইতে বইতে তাদাসু নো মোরিকে সাক্ষী হিসেবে রেখে মিলিত হবে তাকাসে নদীর সাথে, তাকেৎসুনোমির আশীর্বাদেই কি?
হাতে মোচিগুমান নিয়ে আকাশির সাথে সাক্ষাতের জন্যও তো তাই আসা চাই এখানেই।
 

Hibike! Euphonium:নো-ওয়েইস্টেড-শট! — Fahim Bin Selim

 

hibike__euphonium_wallpaper_hd_by_corphish2-d8ngduu

একটা ভালো অ্যাডাপ্টেশন হওয়ার জন্য কী প্রয়োজন? অনেক বেশি সংখ্যক অ্যানিমে ফ্যান, এবং সামগ্রিকভাবেই ভিজুয়াল ফিকশনের ফ্যানরাই ভালো অ্যাডাপ্টেশন বলতে সম্ভবত বুঝে তার সোর্স ম্যাটেরিয়ালকে পুরোপুরিভাবে অনুসরণ করাকে। কিন্তু সেটা কি তার গল্প বলায় একটা সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করে না? কারণ শেষ পর্যন্ত, “অ্যাডাপ্টেশন” মানেই তো নতুন পরিস্থীতি, নতুন মাধ্যমের সাথে মানিয়ে নেওয়া – গল্পের বিন্যাস, কাঠামো আর বর্ণনা পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে হলেও। কারণ, অবশ্যই, বইয়ের পাতার লেখার মাধ্যমে গল্প বলা, আর টেলিভিশন, সিনেমার পর্দায় ছবি আর শব্দের মিলনে তা বলার মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য আছে। একই সাথে পার্থক্য আছে, আসলেই গল্প “বলাতে”, এবং তা  কেবল “দেখানো”-র মাঝেও। ছবি আর শব্দের মেলবন্ধন – আর তা যদি ভালোভাবে ব্যবহার করা যায়, অ্যানিমেশনের সম্ভাবনা অসীম, তৈরি হয় আসলেই ত্রিমাত্রিক অনুভূতির এক জগৎ। কিন্তু অবশ্যই এক্ষেত্রে গল্প বলার ক্ষেত্রে পরিচালকের কল্পনাশক্তির প্রাচুর্য্য থাকা জরুরী, যেহেতু  ছবি এবং শব্দের উপস্থিতি দর্শকদের নিজেদের কল্পনাশক্তি ব্যবহারের সুযোগ অনেকাংশে কেড়ে নিচ্ছে। এবং এটা আরো বিশেষভাবে, যখন একটা উপন্যাসকে অ্যাডাপ্ট করা হয়। কারণ এখানে মাঙ্গার মত আর চরিত্রদের চেহারা, তাদের অঙ্গভঙ্গি কিংবা তাদের আশেপাশের জায়গাগুলোর টেমপ্লেট আগে থেকেই দেওয়া থাকেনা। পুরোপুরিই পরিচালকের নিজের ইন্টারপ্রেটেশনের উপর নির্ভর করে। একজন পরিচালকের প্রতিভার পরিচায়ক তো কেবল সুন্দর কোন গল্প বলাতে নয়, কোন গল্পকে সুন্দরভাবে বলাতেই!

vlcsnap-2016-11-05-01h07m20s868

এখানে আর বাকি সব কিয়োঅ্যানির অ্যানিমের মত সুন্দর অ্যানিমেশন আর ভিজুয়াল উপস্থিত, হয়তো মাঝে মাঝে তুলনামূলক কম ভালোও। কিন্তু Hibike-’র শক্তি বরং এর গল্পবর্ণনায়। এর মূল গল্প বড় এক নভেল সিরিজ থেকে নেওয়া, একারণে গল্প আর চরিত্র – উভয়ের গভীরতাই তুলনামূলক বেশি। কিন্তু এই কারণেই বরং তার পুরোটা টিভির পর্দায় ফুটিয়ে তোলা আরো অনেক, অনেক বেশি কঠিন! কিয়োঅ্যানির ফ্ল্যাগশিপ পরিচালক তাৎসুইয়া ইশিদার কাছ থেকে আসায় যদিও এর সাফল্য নিয়ে আশাবাদী হওয়াটা যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু তার পরও, ইশিদার বাকি সব অ্যানিমের চেয়ে Hibike আলাদা। Air, Clannad, Haruhi -‘র মত Hibike-তে বড় এনসাম্বলের কাস্ট থাকলেও, এর গল্প অনেক বেশি কানেক্টেড, কমপ্যাক্ট…বাস্তবিক! ফ্যান্টাসি জনরা গায়ে না লেগে থাকা একটা বড় কারণ, কিন্তু এটা বাদ দিলেও Hibike-’র প্রতিযোগীতা, সাফল্য আর ব্যর্থতার গল্প পরিচিত। গল্পবর্ণতাতে আছে আলাদা একটা নিজস্বতা। কেবল “দেখানো”-তেই সীমাবদ্ধ না, Hibike তার গল্পের বড় একটা অংশ “বলে” তার ভিজুয়াল দিয়ে।

“ক্যামেরা”-’র ব্যবহারটাই চিন্তা করা যাক, Hibike-তে ফোকাসিংকে কাজে লাগানো হয়েছে শিল্পের পর্যায়ে। পুরোটা সময় ঘোলাটে ব্যাকগ্রাউন্ড আর চরিত্রদের চেহারার উপর পূর্ণাঙ্গ ফোকাসই বলে দিবে মনোযোগটা কোথায় রাখা জরুরী। কিয়োঅ্যানিমের আর বাকি সব অ্যানিমে থেকেও তো একে এই এক বিষয় দিয়ে আলাদা করা যায়! কুমিকো গল্পের ন্যারেটর, তার স্বগোক্তিতেই সব বলা, প্রতি পর্ব শুরু আর শেষও তা দিয়ে। তার মাথার ভেতর, বিক্ষিপ্ত চিন্তাভাবনা আর স্মৃতি, কুইক-কাট ট্রানজিশনে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে নিয়ে যায়। কুমিকো যদিও বেশিরভাগ সময়ই আশেপাশে চলমান ঘটনার পার্শ্বচরিত্র; প্রভাবক, নীরব দর্শক আর গুপ্ততথ্যের রক্ষক। She sees everything and she understands. একজন ওয়ালফ্লাওয়ার! যার জন্য উপন্যাসের পাতা ভর্তি লেখা প্রয়োজন, তার জন্য এখানে একটি শব্দেরও প্রয়োজন হয় না; চরিত্রদের মুখের অভিব্যক্তি আর প্রতিক্রিয়া অনুসরণ করলেই হবে। নো-ওয়েইস্টেড-শট!

vlcsnap-2016-11-05-01h07m20s868

দ্বিতীয় সিজনের তৃতীয় পর্ব এর একটি ভালো উদাহরণ। এই পর্বের শুরুটা কুমিকোর মনোলোগ দিয়ে, কানসাই কম্পিটিশনের আগে শেষ প্রস্ততি পর্ব। কুমিকো আর আসুকার ছোট কথোপকথনের পরবর্তী ৩ঃ১৬-৩ঃ১৬ এ তিন সেকেন্ডের ট্রানজিশন, আর তার সাথে সাথে কুমিকোর এক্সপ্রেশন, সম্পূর্ণ ভিন্ন দুইটি সময় আর জায়গার মধ্যে সংযুক্তি। কোন এবরাপ্ট কাট না যেটা গল্পের গতি নষ্ট করে দিবে, অথবা কোন দীর্ঘায়িত অপ্রয়োজনীয় শট না, বরং দুটো একত্রে মিলিয়ে দেওয়া, গল্পের প্রবাহ বজায় রাখার জন্য! অথবা তার পরবর্তী দৃশ্য, আসল পারফর্মেন্সের আগে শেষবারের মত সব পারফর্মারদের একসাথে থাকা শেষ দৃশ্য। নিয়ামা আর হাশিমোতো-সেনসেই এর বিদায়ী ভাষন, উপদেশ। ক্যামেরা একজনের থেকে আরেকজনের পারস্পেকটিভে বদলাতে থাকে অনবরত, কার কোন কোন দূর্বলতা জানান দেয়, এবং তার সাথে সাথে পারফর্মারদের প্রতিক্রিয়া। কুমিকোর চেহারার অবিশ্বাস, আনন্দ, ভয় এবং একই সাথে অস্থিরতা ইউফোনিয়াম সোলোর অংশ হওয়ার খবর পাওয়ায়, রেইনার সন্তুষ্টির অভিব্যক্তি। কিংবা ইয়োরোইযুকার চোখে হাতের ওবোর দিকে স্থির, রোবোটিক দৃষ্টি, যখন হাশিমোতো তাকে যান্ত্রিকভাবে বাজানো বাদ দিয়ে আরো বেশি “এক্সপ্রেসিভ” হওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু তার জন্য তো “এক্সপ্রেস” করা সব সময়ই কষ্টকর ছিলো, সংগীত কিংবা শব্দ দিয়েও। তা তার গতবাঁধা জবাবেই আটকানো, “I’ll try to do better.” ব্যাকগ্রাউন্ড ফোকাসে ইউকোর চেহারায় অনিশ্চয়তা! প্রিয় মানুষের জন্য!

vlcsnap-2016-11-08-11h43m53s360  vlcsnap-2016-11-08-11h44m53s455vlcsnap-2016-11-05-01h13m11s868

গল্পটা কুমিকোর মাথার ভেতরে, তাই তো সবকিছু সামনে থেকে দেখা হয় না। রেইনা যখন তাকি-সেনসেইকে নিয়ামা-সেনসেইয়ের সাথে তার সম্পর্কের কথা জানতে চেয়ে প্রশ্ন করে, আগুনের অপর পাশে। তাদের কথা শোনা যায় না, পর্দায় কেবল দূর থেকে রেইনা আর তাকির শব্দহীন অভিব্যক্তি। কিন্তু অবশ্যই Hibike এই মুহূর্তটা অপচয় করবে না। বরং এপাশে সমান্তরালে হাশিমোতো-সেনসেইয়ের সাথে কুমিকোর কথোপকথন চলতে থাকে। তাকি-সেনসেই এরই অতীত নিয়ে! একই সাথে শব্দ আর ছবি দিয়ে দুটো আলাদা গল্প বলা! কনসার্টেশনে, কোনভাবেই ইনফরমেশনের ওভারফ্লো না, ইকোনমিক! কিংবা আসুকাকে আঁকড়ে ধরা নস্টালজিয়ার প্রতিটি মুহূর্ত, হাইস্কুলের শেষ বছরে এসে। যদিও তা মুখ ফুটে কেবল বেরোয় না সরাসরি। ক্লাবকে আগলে রাখার প্রতিটি চেষ্টায়, প্রতিটি ধাপ পেরোনোর আনন্দের বিহবল হওয়ার পরবর্তী নীরবতায়, অবশ্যম্ভাবী বিদায়ের কথা মনে পড়ায়, গ্রাস করা বিষাদ ঠিকড়ে বেরোয় তার হাসির পেছন থেকে, আর যখন সে বলে,  “I wish this summer would never end”।

vlcsnap-2016-11-05-01h34m13s058 vlcsnap-2016-11-05-01h31m48s174

কিন্তু সবচেয়ে বড় উদাহরণ অবশ্যই এর পারফর্মেন্সের দৃশ্যগুলো! মিউজিক অ্যানিমের সাফল্যের জন্য তো অসাধারণ সঙ্গীতেরই দরকার সবার আগে! Hibike এইক্ষেত্রে বরং Showa Genroku-’র সাথে তুলনীয়। Hibike-’র সঙ্গীতের বিচারক দর্শক নিজেরাই! কোন শর্টকাট না, এমনকি ৮ মিনিটের লম্বা পারফর্মেন্সেও! প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি বিট অ্যানিমেটেড। আর মনে রাখার মত ব্যাপার, অন্যান্য আর বেশিরভাগ অ্যানিমের মত Hibike-’র সঙ্গীত একক পরিবেশনা না, দলীয়! কন্ডাকটরের হাতের নির্দেশনা, প্রতিটি পারফর্মারের চলমান হাত অথবা মুখ, অথবা দুটোই, সঙ্গীতের সাথে মূর্ছনায়; নড়তে থাকা, সামনে, ব্যাকগ্রাউন্ডে একসাথে; ট্রামবোন, ট্রামপেট, টিউবা, ক্ল্যারিনেট, হর্ন, ট্রিমপানি, চাইম, টামবুরিন, ওবো, ফ্লুট, বেস, ইউফোনিয়াম! একসাথে চলতে থাকা! কোন স্ট্যাটিক শট না! আবার যখন রেইনার সোলোর দৃশ্য আসে, তখন পর্দায় রেইনার কল্পনায় ভেসে স্টেজ আর পাহাড়ের কিনারায় মিশে এক হয় কুমিকোর সাথে ফেস্টিভালের সেই রাতের দৃশ্য, কারণ এই পারফর্মেন্স তো তার জন্যই! অথবা ইয়োরোইযুকার কল্পনায় নোজোমি। কাওশিমার সামনে রাখা স্ট্যান্ডে বন্ধুদের সাথে তার ছবি। তাকি-সেনসেইয়ের সামনে তার স্ত্রীর। সবারই আলাদা আলাদা গল্প!

vlcsnap-2016-11-13-02h22m50s007

সামনে বসে থাকা দর্শকরা ফোকাসের বাইরে, পেছনে ব্যাকস্ট্যাজে বন্ধুদের বিচলিত পায়ের নড়াচড়া কেবল। আর এই দূর্দান্ত পরিবেশনার পরের দৃশ্যটাই কী? প্রথমে সবার হাঁপাতে থাকা চেহারা, বন্ধুদের কান্নার দৃশ্য, আর সবার শেষে দর্শকদের করতালি। আর তা ক্ষীন হতে হতে সরাসরি এন্ড ক্রেডিট। কারণ শেষ পর্যন্ত এটা তো তা-ই ছিলো, যা উপন্যাসের পাতায় কখনোই বোঝানো সম্ভব না, পাতার পর পাতা বাক্য দিয়ে ভরে ফেললেও, একইসাথে শব্দ আর চিত্রের পরিবেশনায়ঃ শ্বাসরুদ্ধ, চিত্তসম্মোহিত আর হতবিহবল করা।

নো-ওয়েইস্টেড-শট!

91 Days (2016) রিভিউ — Fahim Bin Selim

91 Days(২০১৬)
★★★★☆
পরিচালনাঃ কাবুরাকি হিরো(Tonari no Kaibitsu-kun, Kimi ni Todoke, Hoozuki no Reitetsu)
মৌলিক গল্প
পর্ব সংখ্যাঃ ১২
জনরাঃ অ্যাকশন, ড্রামা, হিস্টোরিকাল
প্রযোজনাঃ স্টুডিও শুকা(Durarara x2, Natsume Go)

flkmycp

 

১৯২০; আমেরিকায় প্রোহিবিশন এরার শুরু। ১৮তম সংশোধনীর প্রেক্ষিতে “ড্রাই ক্রুসেডার”-দের নেতৃত্বে দেশজুড়ে অ্যালকোহলিক পানীয়ের তৈরি, আমদানী, পরিবহন কিংবা বিক্রি নিষিদ্ধ করে দেওয়া হলো। পন্য খোলাবাজারে নিষিদ্ধ হওয়া মানে স্বভাবতই তার জায়গা হলো কালোবাজারে। আর তখন পর্যন্ত মাফিয়াদের মূল ব্যবসা পতিতালয় আর জুয়াড় আসরকে ফেলে প্রথম স্থান দখল করলো মদ্যপানের চালান। যার কাছে যত স্থায়ী, শক্তিশালী পানীয়ের মজুত, তাদের হাতেই শহরের দায়িত্ব!

ল’লেস, ইলিনয়। নামের স্বার্থকতা রক্ষার্থেই তাতে আইনের কোন বাধা ধরা নেই, অন্তত প্রচলিত অর্থে। বরং এখানকার আইনের বিধানকর্তা তার মাফিয়া পরিবারগুলো – ভানেত্তি আর অর্কো। তার ব্যাত্যয় ঘটলেই লাশ পরা সুনিশ্চিত; দিন-রাতে, খোলা রাস্তায়, পাব, নিজের ঘরে। ‘পরিবার’-কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই পরিবারের জন্যই ভানেত্তি পরিবারের অংশ অ্যাঞ্জেলো লাগুসা ছোটবেলায় বাবাকে খুন হতে দেখলো তার বাবার নিজের বন্ধু ভিনসেন্ট ভানেত্তির হাতে। সাথে তার মা আর ছোটভাইকেও – পুরো পরিবার একসাথে! ভাগ্যক্রমে একমাত্র বেঁচে যাওয়া অ্যাঞ্জেলো সাতবছর পর ফিরে আসলো ল’লেস-এ। প্রতিশোধের নেশায়, ব্রুনো আভিলিও ছদ্মনামে। এই ভানেত্তি পরিবারের ঢুকে যেতে। ভেতর থেকে একে একে খুন করতে, তালিকা ধরে, যারা খুন করেছিলো তার পরিবারকে। তার প্রবেশপত্র? ল’লেস হেভেন, শহরের সেরা মদ। যার প্রস্তুতকারক তার বাল্যকালের বন্ধু কর্তেও।
৭ বছর অপেক্ষার পর অ্যাঞ্জেলোর – আভিলিওর…৯১ দিনের শীতল প্রতিশোধ পরিবেশনের গল্প!

আমেরিকা আর ত্রিশের দশক, মাফিয়া, প্রতিশোধ গল্প – কোন অ্যানিমের আগে বরং স্করসেসি[১] কিংবা কোপোলার[২] চলচ্চিত্রের কথাই মাথায় আসার কথা সবার আগে! এবং তারপর যখন দ্বিতীয় পর্বে শিকাগোর গালাসিয়া পরিবারের রোনালদোর সাথে ভিনসেন্টের মেয়ে ফিও ভানেত্তির বিয়ের অনুষ্ঠানে অ্যাঞ্জেলো উপস্থিত হয়, নাচের দৃশ্য আর ভেতর অন্ধকার রুমে বসে থাকা ভিনসেন্ট ভানেত্তিকে দেখে ডন কর্লেওনি(Godfather[৩]) ভেবে ভুল হওয়া অস্বাভাবিক না। অথবা টাইটল স্ক্রিনের লোগোটার কথাই ধরা যাক। হেনরি হিলের(Goodfellas[৪]) মত সিসেরোর…না, না, কস্টিগানের(The Departed[৫]) মত কস্তেওদের সাথে অ্যাঞ্জেলোর মিশে যাওয়া! 91 Days এর অনুপ্রেরণা তো কোপোলা আর স্করসেসিতেই। এবং গল্পবর্ণনাতেও এই প্রভাব লক্ষনীয়। পর্বে পর্বে ক্লিফহ্যাঙ্গার আর একের পর এক অননুমেয় গল্প উপাদান, টিভি সিরিজের তুলনায় বরং সাড়ে চার ঘন্টার একটার মুভির সাথেই একে তুলনা করা যায়।

আর অ্যাঞ্জেলোর যাত্রাটা শুধু ক থেকে চন্দ্রবিন্দুতে গিয়েই শেষ না, নিজের অজান্তেই ল’লেস-এর অন্ধকার মাফিয়া জগতের মাকড়সার জালে ধীরে ধীরে পেঁচিয়ে যাওয়ায়। লম্বা সময় ধরে মিথ্যা অভিনয় করতে থাকো, সেটা একসময় বাস্তবতা হয়ে দাঁড়াবে। অ্যাঞ্জেলোর রেইসন দে’ত(Raison d’etre), বেঁচে থাকার একমাত্র অনুপ্রেরণা এই প্রতিশোধই, আর সেটা ছাড়া সে যেন এক অন্তস্বারশুন্য খোলের মত। সেও অংশ হয়ে যায় ল’লেস-এর মাফিয়া যুদ্ধে। লাল পানি আর রক্তের খেলায় – প্রতিশোধ সেখানে মধ্যবিরতির আকর্ষন কেবল। কাটা পরতে থাকে তালিকার বাইরের অনেক নামও।

গল্পের মূলচরিত্র, কিন্তু অ্যাঞ্জেলোর মাথার ভেতরে কখনো আমরা ঢুকতে পারি না, তার মনোলোগের অংশ হই না, কিংবা জানিনা তার পরবর্তী পরিকল্পনা কী। প্লেহাউসের উপর তলায় বসে কোন অপেরার মত অ্যাঞ্জেলোর এই অভিনয় আমরা দেখি বাইরে থেকে। গল্পের মূলচরিত্র, কিন্তু কোন পর্যায়েই অ্যাঞ্জেলো গল্পের ‘নায়ক’ না, বরং ফিল্ম-নয়ারের নিয়ম মেনে আর বাকিসব চরিত্রের মতই অ্যাঞ্জেলোর বিবেকবিচার আর কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ। এটাই গল্পের অননুমেয়তা আর বিষ্মিত করার প্রধান অস্ত্র। কস্টিগানের মত অ্যাঞ্জেলোর এই অভিনয় ‘খেলার’ পেছনে কোন ‘গ্রেটার গুড’ নীহিত নেই। তার পুরো যাত্রাটাই ব্যক্তিগত, স্বার্থপরতার। একাকীত্বের।

কস্টিগান – অ্যাঞ্জেলোর এই প্রতিশোধ চক্রের ব্যাসের অপর পাশেও একজন কলিন আছে – নেরো ভানেত্তি, ভিনসেন্টের ছেলে। নেরো বরং অ্যাঞ্জেলোর চেয়ে আরো বেশি জীবন্ত এক চরিত্র। অ্যাঞ্জেলোর প্রতিশোধ তালিকায় কাটা যেতে থাকা নামের সংখ্যা বাড়তে থাকার মানে হলো তার পরিচিতদের মৃত্যুর তালিকা ক্রমাগত বড় হওয়া। তবে এই তিনমাসের গল্প নেরোর জীবনটা উল্টেপাল্টে যাওয়ার, অ্যাঞ্জেলোর সাপের মত আষ্টেপৃষ্ঠে ধরা পরিকল্পনার কেন্দ্রে তো সে নিজেই! তার ছলচাতুরির ফাঁদে পরা সবচেয়ে বড় শিকার। তার দাবার গুটির শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখা স্যাক্রিফাইসিং পন। বরং নেরোকেই গল্পের ট্র্যাজিক হিরোর উপাধি দেওয়া যায়। তার অভিনয়টা অবশ্য তিনমাসের জন্য না, সারাজীবন ধরে চলা। বারুদ আর রক্তের গন্ধ। বিশ্বাসঘাতকতা আর অবিশ্বাসের এক জগতে। পরিবারের সাথে মিশে যাওয়ার…টিকে থাকার জন্য। পরিবারের জন্য। তার যাত্রাটা সম্পূর্ণ বিপরীত – আত্নবিসর্জনের। তবে একাকীত্বেরও!

স্করসেসির মাফিয়াদের মত অ্যাঞ্জেলোর জীবনটা অবশ্য অতটা অবশ্য জাঁকজমকের না, অনেক বেশি গ্রাউন্ডেড। তার পতনটা যে অনিবার্যতায় ঘেরা। 91 Days-এর পরিবেশনাও সাধারণ। বেশিরভাগ সময় আবহসঙ্গীতবিহীন, জ্যাজ আর অর্কেস্ট্রা সেখানে প্রবেশ করে কদাচিৎ। বরং তার স্থানে জায়গা করে নেওয়া বাইরের যান-বাহন আর কোলাহলের শব্দ ল’লেস-এর মাফিয়াদের বাইরেরও আলাদা সাধারণ জীবনটা সম্পর্কে জানান দেয়। রক্তপাত, বিশ্বাসঘাতকতা আর ছলচাতুরিবিহীন, আসলেই পরিবারের সাথে একসাথে থাকা এক জীবন।

কিন্তু উপরতলার বিধান কর্তাদের সেখানে প্রবেশ করা নিষেধ। প্রতিশোধের নেশায় পাগল হওয়া মানুষদেরও।

91-days-poster-promo-imagem-destaque

১ – [https://en.wikipedia.org/wiki/Martin_Scorsese]
২ – [https://en.wikipedia.org/wiki/Ford_coppola ]
৩ – [https://en.wikipedia.org/wiki/The_Godfather]
৪ – [https://en.wikipedia.org/wiki/The_Departed]
৫ – [https://en.wikipedia.org/wiki/Goodfellas]

আসানো ইনিও – মাঙ্গায় সাহিত্য-বাস্তবতা — Fahim Bin Selim

সাধারণভাবে কমিকবই অথবা মাঙ্গাকে সম্ভবত সবসময়ই হালকা শিল্প হিসেবে ধরা হয়ে এসেছে। একই সাথে সাহিত্য আর চিত্রকর্মের সংযোগ, কিন্তু কোনটাই পুরোপুরি না। লেখা ও ছবি দুটোই ব্যবহার করায়, কমে যাওয়া পাঠকের উপর অর্পিত ভাবনা আর কল্পনার সুযোগও। আমেরিকার সুপারহিরো কিংবা জাপানের কিশোর-নায়ক – বরং প্রচলিত কমিকবই, মাঙ্গার সাথে টেলিভিশন সিরিজ অথবা ম্যাগাজিনের ধারাবাহিক গল্পের তুলনাটা বেশি যুক্তিযুক্ত; নির্দিষ্ট কিস্তিতে অনেক সময় ধরে প্রকাশ হয় বলে বাজারে কাটতি ধরে রাখা অপরিহার্য ব্যাপার যেখানে, শিল্পের পাশাপাশি টিকে থাকার জন্য ব্যবসায়িকও চিন্তাটাও। বাস্তবতা থেকে টেনে নিয়ে বিমোহিত করা ফ্যান্টাসি গল্প, কিংবা পাতার পর পাতা লোমখাঁড়া করা অ্যাকশন দৃশ্য – এমনকি ভালোবাসা, বেড়ে ওঠা আর জীবন সংগ্রাম নিয়ে স্লাইস-অফ-লাইফ গল্পের ঘাটতিও জাপানের কখনো ছিলো না। কিন্তু আসানো ইনিওর রীতি ভাঙ্গার চেষ্টাটা তার গল্পের জনরাতেও না, গল্পের ধরনেও না — তা আরো সুক্ষ্ণ — গল্প বর্ণনায়, তার চরিত্রের উপস্থাপনায় লুকানো।

ইনিওর মাঙ্গায় বারবার ঘুরে ফিরে আসে পুরোপুরি কালো প্যানেলে কেবল ন্যারেশন কিংবা মোনোলোগ, সাহিত্যের কাছাকাছি যাওয়া সবসময়ই হয়তো তার চেষ্টা ছিলো। শুরুটাও সাহিত্যিকদের মত ছোট ব্যপ্তীতে, কতগুলো ওয়ান-শট মাঙ্গা দিয়ে। ধীরে ধীরে হাত শানিয়ে নেওয়া, নিজের জীবন থেকে টেনে আনা গল্পতে। এই সময় ইনিও মাত্র বিশের ঘরে পা রাখা যুবক। বেশিরভাগ গল্পতেই তাই স্লাইস-অফ-লাইফ, সেইনেন, এই দুই জনরা উপস্থিত। প্রথম দিকের ধারাবাহিক মাঙ্গা Solanin(২০০৫-২০০৬) আর Hikari no Machi[City of Lights](২০০৪)-তে আধুনিক শহুরে জীবনকে কাছ থেকে তুলে আনার চেষ্টা। ঘটনাকেন্দ্রিক না হয়ে ইনিওর মূল দৃষ্টি বরং তার চরিত্রদের উপর, চ্যাপ্টার ভেদে গল্প-বর্ণনার পয়েন্ট-অফ-ভিউ পরিবর্তিত হওয়া, ওমনিবাস ন্যারেটিভে হালকাভাবে সংযুক্ত অনেকগুলো সুতো দিয়ে ধীরে ধীরে মাকড়সার জালের মত শক্ত একটা গল্প-কাঠামো তৈরিতে।

005

Solanin-এর মূলচরিত্র মেইকো যেমন জীবনের যান্ত্রিকতা থেকে মুক্তি পেতে দুই বছরের চাকরি ছেড়ে দেওয়া ২৪ বছরের এক যুবতী, ইনিওর বয়সটাও এসময় ২৪-ই। কৈশোর আর তারুণ্যের নদী পেরিয়ে জীবনসমুদ্রের অথৈজলে প্রথম অভিগমনের অভিজ্ঞতা এ মাঙ্গার পাতায় পাতায় — ভালোবাসা আর জীবন নিয়ে উদ্বেগ আর আশংকা, যখন প্রথমবারের মত নৌকাটার দাঁড়টা নিজের হাতেই, আর তার প্রতিটি টানের পরিণামও। নিজের স্বপ্ন আর সামর্থ্য নিয়ে চিরন্তন অন্তর্দ্বন্দ্বে আটকা থাকা। “Freedom without purpose feels a whole lot like a burden” – কালো প্যানেলের ন্যারেশনে মেইকোর স্বগতোক্তি আঁকা থাকে। মেইকোর সাথে সাথে হয়তো ইনিওর নিজেরও। শিল্পী হওয়ার চেষ্টাটা যখন সবসময়ই অনিশ্চয়তার এক পথ। “Maybe what you really want is something dreamy and unreal, and you are hesitating because of that.”

সাহিত্য-বাস্তবতা নিয়ে কাজ করলেও এই ড্রিমী এবং আনরিয়েল সুরা আর পরাবাস্তবতার ইনিওর গল্পে প্রবেশ করেছে হরহামেশাই। তার অ্যাবসার্ডিস্ট কমেডির হাত ধরে। Subarashi Sekai![What a Wonderful World!](২০০২-২০০৪) আর Sekai no Owari to Yokomae[Before Sunset and the End of the World](২০০৫-২০০৮), তার দুই গল্প-সংকলন, এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। প্রতি চ্যাপ্টারে আলাদা আলাদা চরিত্র আর তাদের গল্প। সদ্য মৃত্যু বরণ করা উড়ে বেড়ানো কোন আত্নার নতুন চোখে জীবনকে দেখা। কিংবা স্কুলে যাওয়ার পথে কাকের সাথে কোন মেয়ের কথোপকথন। আবার কোন তরূণীর বৃষ্টিস্নাত তন্দ্রায় এসে হাজির হয় মুরাকামির ব্যাঙ। ব্যর্থ এক মাঙ্গাকার অনেক বছর পর স্কুলের পূণর্মিলনীতে গিয়ে দেখা হয় ছোটবেলার প্রথম ভালোবাসার সাথে, এখন যখন সে অন্য এক বন্ধুর স্ত্রী।

007

“Sometimes I think if I open my eyes, I’ll be a kid again and none of this will have happened.
But this has happened. And this is the only me there is,” গ্রাস করা অনুশোচনা অথবা হতাশা।
জীবন কখন ছকে বাঁধা ছিলো? অথবা অনুমিত?
ইনিওর গল্প থেকে ঠিকরে বেড়োয় স্মৃতিকাতরতা। কৈশোরের বন্ধুত্ব আর প্রেম নিয়ে।

Umibe no Onnanoko[A Girl on the Shore](২০০৯-২০১৩)-র মত হয়তো তা কেবলই দৈহিক। র’ আর অনেস্ট। ভেঙ্গে পড়া মানুষের মাথার ভেতর ঢুকে যাওয়া। ভালোবাসার সংঙ্গাটাকে পুনর্নির্ধারনের চেষ্টায়। সোফিয়া কোপোলার Lost in Translation এর প্রাপ্তবয়স্ক হ্যারিস আর শার্লটের নিষ্পাপ ভালোবাসার সাথে বৈপরিত্য টানতেই যেন তখন ইনিওর হাতের কলম এঁকে বেড়ায় কৌশরে পা রাখা ইসোবে আর সাতৌর ব্যক্তিগত সব মূহুর্তে; Kafka on the Shore-এর কাফকা তামুরার মত সেক্সুয়ালিটি নিয়ে কৌশোরের দূর্নিবার কৌতুহলে। তাদের একাকীত্ব আর অবসন্নতায় ভর করা কোন দুপুরে, কানের হেডফোনে যখন বাজতে থাকে Kaze wo Atsumette.
Nijigahara Holograph(২০০৩-২০০৫)-এ সেটা আবার সাইকোলজিক্যাল হররে রূপ নেওয়া। নিষিদ্ধ কোন সম্পর্কে। আপাত সাধারণ জীবনের মাঝে হঠাৎ মাটি খুঁড়ে বের হওয়া কোন পুরনো, লুকানো, স্মৃতি। যেন সাদা কালো কালিতে আঁকা ডেভিড লিঞ্চের কোন ফিল্ম। টুইস্টেড আর আননার্ভিং। কিন্তু বাস্তব আর জীবন্ত।

dass

Oyasumi Punpun[Goodnight Punpun](২০০৭-২০১৩)-এ পুনপুন আর আইকোর ভালোবাসাটা শৈশবের শুভ্র সাদা কাপড়ে মোড়ানো, সহজ এবং সরল। তাদের প্রথম শপথের মত, “Punpun, if you ever betray me, I’ll kill you.” এবং পুনপুনেই প্রথমবারের মত “সাহিত্যিক” ইনিওর বড় গল্পের পথে পা বাড়ানো। ১৪৭ চ্যাপ্টার আর ১৩ ভলিউমে, পুনপুন তো একটা উপন্যাসই! Oyasumi Punpun পুনপুনের জীবনের পিছে ঘুরে বেড়ায় একেবারে শৈশব থেকে। কোন রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে নভোচারী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা জন্মানোর মূহুর্তে, স্কুলে নতুন বদলি হয়ে আসা কোন বালিকার প্রেমে পরে যাওয়াতে, অথবা বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বেড়োনো কোন সন্ধ্যায় পরিত্যক্ত এক দালানের ছাদে অতিপ্রাকৃতের মুখোমুখি হওয়ায়। আবারো কালো প্যানেলে ন্যারেশন লেখা উঠে, কিন্তু কখনো পুনপুনকে আমরা কথা বলতে দেখি না, অথবা দেখি না তার আসল চেহারা। পুনপুনের ভাবনাগুলো জানতে পারি মধ্যম পুরুষে। পুনপুনের বুলিতে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় আফ্রো চুলের জাপানী এক ঈশ্বর! হয়তো অনির্ভরযোগ্য সত্যতায়। পুনপুনই যেখানে চুপচাপ, লাজুক এক ওয়ালফ্লাওয়ার, তখন সেটাই তো স্বাভাবিক! মাঙ্গাতে উত্তর-আধুনিক আখ্যানের আবির্ভাব!

ইনিও অনুসরণ করে পুনপুনের স্বপ্নগুলোকেও। ছোটোবেলার নভোচারী হওয়া থেকে যা কৈশোরে বদলে যাওয়া মাঙ্গাকা হওয়ার ইচ্ছায়। অথবা আরো পরে, যখন চোখে অগুণিত সম্ভাবনার স্বপ্নালুতার বদলে জায়গা করে নিয়েছে ব্যর্থতার শূন্যতা। থাকে পুনপুনের ভাঙন ধরা পরিবার, হারানো ভালোবাসা আর আলগা হওয়া বন্ধুত্বের গল্পে।
বেড়ে ওঠা কখন সহজ ছিলো? অথবা নিখুঁত?
এবং পুনপুন বেড়ে ওঠার গল্প, কামিং-অফ-এজ এর অনবদ্য উদাহরণ; শুধু মাঙ্গা না, সাহিত্য…শিল্পের যেকোন মাধ্যমেই অন্যতম সেরা।

oyasumi-punpun-239358

ইনিও তার চরিত্রদের চিন্তাভাবনার ব্যবচ্ছেদ করে। পাঠকদেরও। তার গল্পগুলো কখনোই এসকেপিস্ট ফ্যান্টাসী না। ব্যাকগ্রাউন্ডে ব্যবহার করা তার নিজের ক্যামেরায় তোলা আসল রাস্তাঘাট আর ঘরবাড়ির ছবিগুলো বারবার বাস্তবতায় টেনে আনবে। সব উদ্ভট রসিকতা আর সুরা-পরা-বাস্তবতার আড়ালে ইনিওর চরিত্ররা চিন্তা করে সত্যিকারের মানুষের মত, কথা বলে সত্যিকারের মানুষের মত। তাদের সংগ্রামগুলোও সত্যিকারের মানুষের। মেইকো, ইসোবে অথবা পুনপুনের জীবনে – তাদের বেড়ে ওঠায়, বেড়ে ওঠার পর পেছনে ফিরে তাকানোয়, অথবা অনিশ্চয়তায় ঘেরা ভবিষ্যতে; স্কুলের টিফিনে বন্ধুদের আড্ডায়, প্রথম প্রেমে পরায়, অথবা তারূণ্যের জটিলতায়; বন্ধুত্বের ভাঙ্গা-গড়ায়, অনেক কাছের মানুষকে ভুলতে শেখায়; স্বপ্ন দেখায়, তা ভাঙতে জানায়, নতুন স্বপ্নে বিভোর হওয়ায়; মন্ত্র পড়ে ঈশ্বরকে ডাকার চেষ্টায়, পৃথিবীর সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কামনায়; ছোটবেলায় বড় হওয়ার বাসনায়, বড় হয়ে স্মৃতিকাতরতায় ভোগায়; মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখায়, নতুন জীবনের সাথে পরিচিত হওয়ায় – নিজেদের খুঁজে না পাওয়াটা দুষ্কর।

এবং তারপর তার ব্ল্যাক-কমেডি, অ্যাবসার্ডিসিজম আর সিনিসিজমের ভেতরে ইনিও যখন মাঙ্গার পাতায় জীবনের গল্প বলে আদি-অকৃত্রিমতায়, তার আঁকায় তুলে আনে সাধারণে লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্য্য, অথবা সাধারণে লুকিয়ে থাকা অন্ধকার, হতাশ করে, বিদ্ধ করে বাস্তবতার ছুড়ি দিয়ে, বলে মানুষের ব্যর্থতা আর সীমাবদ্ধতা নিয়ে, আবার শেষ পাতায় এসে লিখে যায়, “As long as you are alive, something good is bound to happen”, আমাদের আটকে ফেলে পুনপুনের পাখির অবয়বে, আইকোর সাথে ভালোবাসায় অথবা আরো পরে সাচির সাথে সাক্ষাতে, কিংবা মেইকোর সাথে অনেক দিন আগে ফেলে রাখা গিটার তুলে নেওয়ায়, আর তা যখন ভাবতে শেখায় – নতুন জিনিস এবং পুরনো জিনিস নতুন করে, আর মনে গেঁথে থাকে, চিরদিনের জন্য গেঁথে থাকে, একই সাথে লেখা আর আঁকার ভাষায় – তখন তা সাহিত্য…শিল্প, উঁচুদরের শিল্পই।

Chapter121pg7

 

 

[১] Lost in Translation: https://en.wikipedia.org/wiki/Lost_in_Translation_(film)

[২] Kaze wo Atsumette: https://www.youtube.com/watch?v=k2SPeEeCj3I

[৩] Kafka on the Shore: https://en.wikipedia.org/wiki/Kafka_on_the_Shore

Penguindrum-এ ট্রেনযাত্রাঃ হারানো দশক অথবা টোকিওর ত্রানকর্তা — Fahim Bin Selim

mawaru-penguindrum-large-end-card-characters-2091613238 (1)

Mawaru Penguindrum-এর অজনপ্রিয়তা সম্পর্কে সবচেয়ে বড় কারণ ধরা হয় এর দূর্বোধ্যতাকে – রূপক আর সাহিত্য-ঐতিহাসিক ঘটনার যোগসূত্র ব্যবহারে কুনিহিকো ইকুহারার স্বেচ্ছাচার। এক্ষেত্রে আপাত দৃষ্টিতে ব্যাপারটাকে ইডিওসিনক্রেসির কাতারে ফেলা যায়। যা একই সাথে এই অ্যানিমের সবচেয়ে বড় সমালোচনাগুলোর একটি। কিন্তু ইকুহারার Revolutionery Girl Utena-তেও তো রূপকের ছড়াছড়ি ছিলো, তারপরও কেন সেটাকে অবিসংবাদিতভাবে ধ্রুপদী অ্যনিমের কাতারে ফেলা হয়, Penguindrum-এর ক্ষেত্রে যা কেবল কাল্ট স্ট্যাটাসেই সীমাবদ্ধ? সম্ভবত পশ্চিম, তথা জাপানের বাইরের অ্যানিমে দর্শকদের আপ্রোচটাই ভুল। বার্থেসের “ডেথ অফ দ্য অথর”-এর অনুসারে বলা যায়, “একটি লেখার সঙ্গতি তার উৎসের – লেখকের উপর নির্ভর করে না, বরং তা নির্ভর করে তার গন্তব্য – পাঠকের উপর।” Mawaru Penguindrum কোন বৈশ্বিক গল্প না, তা পুরোপুরি জাপানের ইতিহাসের উপর ভর করা, এর মানুষ আর তাদের অতীত, তাদের পরিস্থিতি, তাদের দূর্দশার মনোসমীক্ষণ। Utena-তে থাকা ধর্ম, পরিবার, বেড়ে ওঠা, জেন্ডার-রোল নিয়ে দেওয়া সামাজিক-ভাষ্য এখানেও উপস্থিত, কিন্তু কনটেক্সটটা সেটার মত জেনারালাইজড না। স্থান, কাল আর পাত্রে সুনির্দিষ্ট।

grimripper_revolutionary_girl_utena_ep34_remastered_r2j_dual_audio_9f960d6f-mkv_snapshot_03-22_2014-02-08_18-10-15

Penguindrum-এর ট্রেন যাত্রায় সঙ্গী হতে হলে আপনার যাত্রা শুরুর প্রথম স্টেশন হবে ১৯৮০-এর শেষ ভাগের জাপান। বিশ্বযুদ্ধ যখন প্রায় ভুলে যাওয়া এক স্মৃতি, চার দশক পেছনে। জাপান দাঁড়িয়ে গেছে শক্তিশালী এক ভিত্তির উপর; সামাজিক, সংষ্কৃতিক আর অর্থনৈতিক – সব দিক থেকেই জাপানের বিস্তৃতি হতে লাগলো ক্রমাগত ফুলাতে থাকা এক বুদুবুদের মত। মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়তে থাকলো, তাদের চাহিদা বাড়তে থাকলো, সেই সাথে ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋনও। এবং এক্ষেত্রে যা হওয়া স্বাভাবিক, পুরোটাই ঘটলো অদূরদর্শী পরিকল্পনায়। এর পরের ব্যাপারটা হয়তো অর্থনীতিতে বিশেষজ্ঞ কেউ ভালো বুঝাতে পারবে, কিন্তু সাহিত্য আর রূপকের ব্যবহারে বলা যায় জাপানের অর্থনীতির বুদবুদটা, আর সব বুদবুদের অনিবার্য সমাপ্তীর সাথে মিলিত হলো। আর সেই বুদবুদের ভেতর থাকা মানুষেরা নতুন এক বাস্তবতার সম্মুক্ষীন হল। পরিণামটা হলো ভয়াবহ। পরিবর্তনটা হল বিপরীত। চাকরীর সংখ্যা কমলো, মানুষের আয় কমে গেলো, ইয়েনের দাম গেলো তলানিতে – কিন্তু নির্দিষ্ট একটা জীবন-ধাঁচের সাথে পরিচিত হয়ে যাওয়া মানুষেগুলোর চাহিদা কমলো না, তাদের প্রত্যাশাও। এক্ষেত্রে সরাসরি প্রথম আঘাতটা লাগলো সামাজিকভাবে – পরিবারে।

gg_mawaru_penguindrum_-_01_b8c345e7-mkv_snapshot_06-34_2011-07-11_17-16-19

প্রথম যাত্রাবিরতি বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে – জাপানের ক্ষেত্রে এই সময়টার জন্য বেশ গালভরা একটা নাম আছে – লস্ট ডেকেইড, হারানো দশক। ঐতিহাসিকভাবে জাপানের পারিবারিক কাঠামোটা বেশ শক্ত গাঁথুনির ছিলো, একসাথে কয়েক প্রজন্মের বসবাস ছিলো প্রথাগত। আশির শেষ আর নব্বইয়ের শুরুতে এই প্রথায় ভাঙন ধরতে শুরু করলো, পারিবারিক সম্পর্কগুলোতেও। আর্থিক সামর্থ্য বজায় রাখার চেষ্টায় মা-বাবারা উভয়ই কর্মক্ষেত্রে যাওয়া শুরু করলো। এবং অনুমিতভাবেই পশ্চিমের অনুরূপ জাপানে পরিবার বিচ্ছেদের সংখ্যাটাও হঠাৎ করেই বেড়ে গেলো(অগিনোমে পরিবার)। সন্তানেরা শৈশব থেকেই অপরিচিত, একাকী একটা পরিবেশে বেড়ে উঠতে লাগলো। “সফল” হওয়ার একটা চাপ তাদের উপরে বর্তালো। মা-বাবার অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণ করার চাপও(তাবুকি, ইউরি পরিবার) – তা নিজেদেরটা বিসর্জন দিয়ে হলেও। ডানা কেটে দেওয়ার পাখির মত, সাঁতার না পারা মাছের মত – অথবা দুটোই – স্থলে আটকে পড়া পেঙ্গুইনের মত! আর এই ধারণাটাকে এগিয়ে নিতে পরিবারের সাথে জোট বাঁধলো সমাজের নিষ্ক্রিয়তা আর ঘুনে ধরা এক শিক্ষাব্যবস্থা। ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রবিহীন, যান্ত্রিক একটা জীবন। চাইল্ড ব্রয়লার!

ch

কিন্তু পরিবারের নিঃস্বার্থ ভালোবাসার সম্পর্কে যখন শর্ত জুড়ে দেওয়া হলো, তখন পরিবারের সংজ্ঞা নিয়ে নতুন করে ভাবার একটা সময় এসে পড়াটা স্বাভাবিক। জাপানের পদার্পন পোস্ট-মডার্নিস্ট এক জগতে। আর পোস্ট মডার্নিজমের কথা বলতে গেলে ট্রেনে নতুন এক যাত্রীর আসাটা জরুরী। হারুকি মুরাকামি।

দ্বিতীয় স্টেশন – জানুয়ারী, ১৯৯৫। জাপানে আঘাত হানলো ৬.৯ মাত্রার এক ভূমিকম্প – দ্য গ্রেট হানশিন আর্থকোয়াক। জাপানীদের মনোবলের ভিতটা নড়ে গেলো। আর মুরাকামি লিখলেন তার “after the quake” ছোটগল্প সংকলনের কালজয়ী গল্প “Super Frog Saves Tokyo”. গল্পের শুরুতেই আমরা মূলচরিত্র কাতাগিরিকে দেখি একদিন কাজ থেকে ফিরে নিজের ঘরে এক বিশাল বড় ব্যাঙকে আবিষ্কার করতে। “আমাকে ব্যাঙ বলবেন”, ব্যাঙটা বলে নিস্পৃহভাবে, ম্যাজিক রিয়ালিজমের ব্যাকরণ মেনে। কাতাগিরির উপর দায়িত্ব বর্তায় টোকিওকে রক্ষা করার। কাতাগিরি সারাজীবনই নিঃস্বার্থভাবে দায়িত্ব পালন করে গেছে। তার পরিবারের বাকিদের জন্য নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়েছে, চাকরীর কঠিন দায়িত্ব নির্দ্বিধায় পালন করেছে। কিন্তু বদলে সে কখনোই কোন স্বীকৃতি পায়নি, তদ্বিপরীত, কাতাগিরির জীবনটা বরং একাকীত্বের। এখানেই যুক্তির ফাটল ধরে। পরিবার যদি তার সদস্যদের অসম্পূর্ণতাকে মেনে নিতে ব্যর্থ হয়, আব্র একই সাথে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতার পায়ে শিকল পরিয়ে দেয়, তাহলে তার কার্যকারিতা কোথায়? কেবলই রক্তের সম্পর্কে? আপনি কী জন্য আরেকজন ব্যক্তির জন্য নিজের ভালোকে বিসর্জন দিবেন? জৈবিক তাড়নায়, পার্থিব উন্নতির লক্ষ্যে? নাকি পুরো ব্যাপারটাতেই ঐশ্বরিক পুরষ্কারের আকাঙ্ক্ষা নিহিত?

Penguindrum-এ ইকুহারা এই ধারণাটাকে আমূল বদলে দিলেন। কাতাগিরির পরিবারের সম্পূর্ণ বিপরীত, আমরা তাকাকুরা পরিবারের তিন ভাই-বোনের সাথে পরিচিত হই, যারা প্রকৃতপক্ষে কেউ কারো সাথে সরাসরি রক্ত-সম্পর্কিত না! কিন্তু তাদের সম্পর্কের গভীরতা একটি “আসল পরিবার”-এর তুলনায় কোন অংশেই কম না। একজন আরেকজনের জন্য জীবন বাজি রাখতে প্রস্তুত!

vlcsnap-2016-06-08-14h28m50s130

ট্রেনের কামরায় নতুন একজনের অতিথির আগমন – কেনজি মিয়াজাওয়া। কেনজি মিয়াজাওয়া তার “Night on the Galactic Railroad” গল্পে এই আত্নত্যাগের বিষয়টা বারবার ফিরিয়ে এনেছেন। মিয়াজাওয়ার মতে জীবনের সব গুলো ঘটনাই সম্পর্কযুক্ত, তা যত ছোটই হোক না কেন। নিয়তির বিচারে সব অংকের যোগফল শুন্য। এবং আপনি কেবল বড় একটা নাটকের অংশ মাত্র, যার চিত্রনাট্য আপনার হাতে নেই; তার লাল-সুতায় সবাই বাঁধা, এবং এর থেকে মুক্ত হওয়ারও কোন উপায় নেই। ভালো সবসময়ই থাকবে, খারাপ সবসময়ই থাকবে। বৃশ্চিক হওয়ার নিয়তি যদি অনিবার্যও হয়, কিন্তু তার প্রক্রিয়া আর কার্যকারণ আপনার হাতে, তা কুয়োয় পরে জীবন হারাবেন, নাকি আকাশে নক্ষত্রমন্ডল হয়ে জ্বলতে থাকবেন। জীবনের সমাপ্তী কেবল বেঁচে থাকাতেই না।

vlcsnap-2016-06-08-14h25m19s100

কাতাগিরির যেমন দায়িত্ব পরে “ওয়ার্ম”-এর হাত থেকে টোকিওকে বাঁচানোর – যাকে ব্যাঙ বর্ণনা করে, “মানুষের মনের সব অন্ধকারের সমষ্টি” হিসেবে, কিন্তু “ওয়ার্ম”-কে সরাসরি ভালো-খারাপের মানদন্দে ফেলা যায় না। “ওয়ার্ম” বরং জাপানের মানুষের সমষ্টিগত চেতনার অনুরূপ। কেউই তার জন্য দায়ী নয়, এবং একই সাথে সবাই দায়ী।

ট্রেনের চেয়ারগুলোতে কি কতগুলো খেলনা ভাল্লুক দেখা যাচ্ছে? আমাদের যাত্রার শেষ গন্তব্য ২০ মার্চ, ১৯৯৫। জাপান যখন লস্ট ডেকেইড পার হচ্ছিল, তখন তার ছায়ায় বেড়ে উঠেছে এক ভয়ংকর টেরোরিস্ট সংগঠন – ওম শিনরিকিও(পিং গ্রুপ!)। ওম শিনরিকিওর শুরুটা বুদ্ধিজম আর হিন্দুইজমের যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টায়। কিন্তু এক পর্যায়ে সেটা হয়ে গেল তাদের নেতা শোকো আসাহারার ব্যক্তিগত এক কাল্ট, যখন সে নিজেকে দাবি করলো “ক্রাইস্ট” হিসেবে। এ ধরনের পাগলাটে সংগঠনে যোগ দেওয়ার মত বোকামি কে করবে! কিন্তু সেটা করলো জাপানের সেরা, সেরা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা, শিক্ষকরা, শিক্ষিত ব্যক্তিরাই! তাদের মতে জাপানকে এর যুদ্ধ-পূর্ববর্তী নির্মোহ, নির্জীব অবস্থা থেকে বাঁচাতে একটা “ধাক্কা”-’র প্রয়োজন ছিলো। ধাক্কাটা হবে টোকিওর নিচ দিয়ে চলে যাওয়া সুদীর্ঘ পাতাল-রেলপথে। হয়তো এতে অনেক মানুষ মারা যাবে – কিন্তু জাপানের সামগ্রিক “শুদ্ধির” জন্য এই বিসর্জনটা মেনে নেওয়াই যায়।

vlcsnap-2016-06-08-14h34m37s72

Penguindrum-এ ইকুহারা ওম শিনরিকিও-’র চিন্তাধারাটা বোঝার চেষ্টা করেছেন।তিন মূলচরিত্রের বাবা-মা-ই ওম শিনরিকিওর সদস্য! মুরাকামিকেও এই ব্যাপারটা ভাবিয়েছে, তিনি কেবল থট এক্সপেরিমেন্ট দিয়ে ফিকশনের “ওয়ার্ম”-এই পরে থাকেননি, সারিন গ্যাস অ্যাাটাক দ্বারা প্রভাবিত মানুষদের গল্প শুনেছেন, ওম শিনরিকিওর সদস্যদেরও। তারপর ১৯৯৭ সালে লিখলেন প্রায় শ’খানেক মানুষের সাক্ষাৎকার সম্বলিত নন-ফিকশন “Underground”. এই বইয়ের সাক্ষাৎকারগুলোতে জাপানের সেই সময়কার মানুষদের মানসিক অবস্থার একটা ধারণা পাওয়া। কেউ কেউ ছিলো যারা সকালবেলা এই দূর্ঘটনার মুখে পরেও, পরবর্তীতে কর্মস্থলে গেছে যেন কিছুই হয়নি, নির্দিষ্ট প্রোগ্রামে আটকে থাকা রোবটের মত। কারো কারো আবার জীবন বদলে গেছে, পরিবারে বিচ্ছেদ ঘটেছে, সবকিছু নতুন করে দেখতে শিখায়(“after the quake”-এর “UFO in Kushiro” পড়তে পারেন)। মানুষের মূল্যবোধকে ভেতর থেকে খাওয়া অ্যাপ্যাথেটিক এক সমাজব্যবস্থা আর সরাসরি মানুষ হত্যা করতে প্রস্তুত এক ডুম’স ডে কাল্টের মধ্যে আপনি কীভাবে তুলনা করবেন?

“And the opposite of life is not death, it’s indifference.”
― Elie Wiesel

এই কাল্ট যখন আবার সেই সমাজব্যবস্থার কারণেই বেড়ে ওঠা, সেই সমাজেরই “সব অন্ধকারের সমষ্টি”? পাতালপথের নিচে বাড়তে থাকা “ওয়ার্ম”, কাধের পেছনে ভর করা এক ভূত, একটি অভিশাপ – “সানেতোশি”। কেউই তার জন্য দায়ী নয়, এবং একই সাথে সবাই দায়ী। এর ফলাফলটাও ভোগ করবে সবাই। “ওয়ার্ম” অথবা “সানেতোশি”-’র হাত থেকে টোকিওকে বাঁচানোর দায়িত্বটাও কাতাগিরি বা মোমোকোর একার নয়, কিন্তু কাতাগিরি এবং মোমোকোরও দায়িত্ব। তার বদলে কোন স্বীকৃতি না পেলেও। একটি ব্যাঙ অথবা একটি ডাইরী বাদে কেউ তাদের বীরত্বের কথা না জানলেও। শোকো আসাহারার মত কেবল ফাঁকা বুলিতেই না, ক্রুশেও যে বিঁধতে হবে একজন “ক্রাইস্ট”-কে।

চিরস্থায়ী ভালোর আশা করাটা বোকামি, কিন্তু খারাপের বিপক্ষে ভালোর লড়াইটাও চিরস্থায়ীই। বারবার ফিরে আসা – চাক্রিক। টোকিওর পাতালপথের রেললাইনের মত! তাই তো মোমোকোর পর আবার কানবা আর শৌমার জন্ম হয়। অংকের যোগফল শুন্য হলেও তা বের করার পথটা বদলে দেওয়াই যায়।

শুধু জাদুমন্ত্রটা মনে থাকলেই হবে।

mawaru_penguindrum_24_5

[১] কুনিহিকো ইকুহারা – অ্যানিমে পরিচালক; Penguindrum, Utena, Sailor Moon S, Yuri Kuma Arashi
[২] Revolutionary Girl Utena – ১৯৯৭ https://en.wikipedia.org/wiki/Revolutionary_Girl_Utena
[৩] লস্ট ডেকেইড – https://en.wikipedia.org/wiki/Lost_Decade_(Japan)
[৪] হারুকি মুরাকামি – জাপানী সাহিত্যিক; https://en.wikipedia.org/wiki/Murakami_Haruki
[৫] দ্য গ্রেট হানশিন আর্থকোয়াক – ১৯৯৫; https://en.wikipedia.org/wiki/Great_Hanshin_earthquake
[৬] after the quake – ২০০০, ছোটগল্প সংকলন; https://en.wikipedia.org/wiki/After_the_quake
[৭] কেনজি মিয়াজাওয়া – জাপানী সাহিত্যিক; https://en.wikipedia.org/wiki/Kenji_Miyazawa
[৮] টোকিও সাবওয়ে সারিন গ্যাস অ্যাটাক – ১৯৯৫; https://en.wikipedia.org/wiki/Tokyo_subway_sarin_attack
[৯] ওম শিনরিকিও – https://en.wikipedia.org/wiki/Aum_Shinrikyo
[১০] Underground – ১৯৯৭; https://en.wikipedia.org/wiki/Underground_(Murakami_book)

Shouwa Genroku-তে আত্নহত্যা, আর রাকুগোর মঞ্চায়ন — Fahim Bin Selim

 

[Shouwa Genroku Rakugo Shinjuu স্পয়লার সতর্কতা]

ShouwaGen 2

রাকুগো [落語, Rakugo] – আক্ষরিক অর্থ “পড়ন্ত শব্দ(Falling Words)”। মূলতঃ মঞ্চে বসে কেবল এক-দুটো সরঞ্জাম দিয়ে(অধিকাংশ সময়ই একটা কাগজের পাখা একটা ছোট কাপড়ের টুকরো) গল্পবর্ণনার বাচনিক শিল্পমাধ্যম। যদিও এই ধারা বেশ আগে থেকেই জাপানে চলে আসছিলো, তবে মেইজি এরাতে এসে প্রথম “রাকুগো” শব্দটার প্রচলন হয় আর শৌয়া পিরিয়ডে এসে সাধারণের বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয়তা পায়। যদিও শেষ পর্যন্ত রাকুগো একটি নিশ(Niche) বিনোদন মাধ্যমই থেকে গেছে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে। একাকীই পুরো অভিনয়টা করতে হয় বলেই রাকুগো করার জন্য প্রয়োজন বেশ বড় পরিসরের কন্ঠবৈচিত্রতা আর বডি-ফেস এক্সপ্রেশনের ছোটখাটো পরিবর্তন দিয়ে বড় ধরনের ভাব আদানের দক্ষতা। এই রাকুগো পারফর্মারদের – যাদের ডাকা হয় “Deshi” বলে – বড় থিয়েটারগুলোতে, বড় উপলক্ষগুলোতে সুযোগ পাওয়ার জন্য পার হয়ে আসতে হয় বেশ কয়েকটি ধাপ। পেতে হয় কমিটির অন্যান্য রাকুগো মাস্টারদের সমর্থন। বিভিন্ন ঘরানার রাকুগো দেখা গেলেও একে সাধারণভাবে ভাগ করা যায় কমেডি, হরর(কাইদান) আর ট্র্যাজেডিতে।

আর Shouwa Genroku-’র গল্পটাতে যে ট্র্যাজিক-ড্রামা তা প্রথম পর্বেই ভালোভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, যা লাফিয়ে বেড়ায় শৌয়া পিরিয়ডের সময়টাতেই, একই সাথে অতীত(চল্লিশের দশক) আর বর্তমানে(সত্তরের দশক)। গল্পের শুরুটা উদীয়মান রাকুগো “অভিনেতা” ইয়োতারোকে দিয়ে ‘৭০ এ হলেও, অন্তত অ্যানিমের প্রথম সিজনের অধিকাংশ সময়টাই তার গুরু কিকুহিকোর সাথে কাটানো, ‘৪০ এর যুদ্ধকালীন আর যুদ্ধপরবর্তী জাপানে। Shouwa Genroku-’র প্রথম পর্বটা, যেটা আগে বেরোনো দুটো OAD-’র পুনর্বণনা আর ৪০ মিনিটেরও বেশি দীর্ঘ, একটা আদর্শ “পাইলট” এপিসোড, পুরো অ্যানিমেটারই একটা খন্ডচিত্র; তা এসথেটিক দিক দিয়েও, গল্পের মেজাজ আর গতির দিক দিয়েও। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এর সমাপ্তী, যা আগে থেকেই বলে দেওয়া; বারবার শোনা কোন রাকুগোর মত যেন। আর একারণেই Shouwa Genroku-’র মূল বিশেষত্ব “কী হবে” তাতে নয়, বরং “কীভাবে হবে”-তে আবদ্ধ। মাঙ্গার প্যানেল-বাই-প্যানেল থেকে বেরিয়ে অ্যানিমেশন/সিনেমা মাধ্যমে গল্পের মঞ্চায়নে পরিচালকের নিজস্বতার শুরুটা এখান থেকেই। অনেকটা পার্থক্য তুলে ধরার চেষ্টাতেই যেন, “ভার্বাল স্টোরিটেলিং”-কে কেন্দ্র করে আবর্তিত এক গল্পে তার চরিত্ররা প্রথম থেকেই ভাব প্রদানে ব্যবহার করেছে খুবই কম শব্দ। রহস্য আর নাটকীয় মুহূর্তে সংলাপগুলোকে দমিয়ে দিয়ে বরং মনোযোগ দেওয়া হয়েছে ভিজুয়াল স্টোরিটেলিং আর নুয়ান্সের উপর।

vlcsnap-2016-04-20-21h11m08s220

vlcsnap-2016-04-20-21h11m14s20

 

পিরিয়ড ড্রামা হিসেবে Shouwa Genroku-’র অর্ধেক আকর্ষন যুগ পরিবর্তনের সাথে সময় রাকুগোর টিকে থাকা, তার সাথে জড়িত মানুষদের টিকে থাকার গল্প; প্রতিভা, সাফল্য, ব্যর্থতা, ভালোবাসা, তাদের টানাপোড়েনের গল্প। আগের থেকেই জনপ্রিয়তা নিয়ে ধুঁকতে থাকা এই মাধ্যম বড় একটা ধাক্কা খায় টেলিভিশন, রেডিও আর সিনেমার মত নতুন বিনোদন মাধ্যমগুলোর আবির্ভাবে। আরও একটা বড় কারণ সম্ভবত এর ঐতিহ্য আর প্রচলিত ধারার বাইরে যাওয়ার বিপক্ষে একগুঁয়েমি। অ্যানিমের পুরোটা জুড়েই শিল্পের এই চিরচেনা অন্তর্দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। দুই মূলচরিত্র সুকেরেকু আর কিকুহিকোর রাকুগো পরিবেশনার বৈপরীত্যটা সামগ্রিক রাকুগো জগতের অবস্থার সাথেই সমান্তরাল টানার চেষ্টা। কিকুহিকো, একজন সহজাত অভিনেতা; সূক্ষ্ণ আর নিখুঁত, ক্রিটিকালি অ্যাক্লেইমড, পিয়ার(peer)-দের ঈর্ষা আর অগ্রজদের প্রশংসার পাত্র; কিন্তু দর্শকদের সাথে তার সংযোগটা, যেটা আর যেকোনো মঞ্চপ্রদর্শনের মতই রাকুগো পারফর্মেন্সের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কখনোই তার কাছে সহজাত ছিলো না। সুকেরেকুর অবস্থানটা পুরো বিপরীত। তাকে বলা যায় জনগণের রাকুগো পারফর্মার। কমেডি ধারাতেই তার বিচরণ, আর দর্শকদের বিনোদনের জন্য, তাদের সখ্যতা পাওয়ার জন্য কমেডির চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে! কিন্তু প্রতিভা থাকলেও তা টিকিয়ে রাখার চাপ সামলাতে সুকেরেকু বারবার ব্যর্থ হয়।

sho Shouwa Genroku Rakugo Shinjuu 09.mkv_snapshot_11.52_[2016.03.10_17.08.26]

Shouwa Genroku বেশ বড় একটা সময় মঞ্চের বাইরের জীবনের নাটকীয়তা নিয়ে কাটালেও, এর বাকি সময়টা কেবলই মঞ্চের রাকুগো নিয়ে। রাকুগো, এমন একটা শিল্পমাধ্যম যা ধৈর্য্যের পরীক্ষা নেয় বেশ ভালোভাবেই – তা যেমন তার পারফর্মারের, তেমনি এর শ্রোতারও। আর Shouwa Genroku প্রথম থেকেই আমাদের থিয়েটারের ভেতর বসিয়ে দেয়, বেশ কয়েকটি রাকুগো পারফর্মেন্সের পুরোটা দেখিয়ে, যার সবচেয়ে বড়টি প্রায় ১৫ মিনিট।

গঠনগতভাবে, রাকুগো শুরুটা হয় বড় একটা বিল্ডআপের নিয়ে, আর তার শেষটা হয় হঠাৎ কোন সমাপ্তী নিয়ে – কমেডির ক্ষেত্রে কোন রানিং জোক অথবা ওয়ার্ডপ্লে আর ট্র্যাজেডির ক্ষেত্রে পতনের অনিবার্যতার নিয়ে। বিল্ড-আপের মূহুর্তটা ধীরে ধীরে শ্রোতাকে গল্পের ভেতর টেনে আনার প্রচেষ্টা। বক্তা, কেবল শব্দের মাধ্যমেই যে কিনা সকল শ্রোতার কল্পনাশক্তিকে একসাথে চালিত করে ইনডিভিজুয়াল কনশাসনেসকে ছড়িয়ে দিবে সবার মাঝে। Shouwa Genroku-’র পারফর্মেন্সের দৃশ্যগুলোকে এক্ষেত্রে নিখুঁতই।

shogen

পারফর্মেন্সগুলো আমরা দেখতে পাই বক্তা-শ্রোতা দুই পরিপ্রেক্ষিত থেকেই। রাকুগো পারফর্মারকে দূর থেকে দেখা যায়, দর্শকের চোখ দিয়ে, আসন গেড়ে বসা, বিচলিত অথবা আত্নবিশ্বাসী, স্পটলাইটের কেন্দ্রবিন্দুতে। দর্শকের দেখা যায়, বক্তার চোখ দিয়ে, অনিশ্চয়তা অথবা আগ্রহ নিয়ে তাকানো, আধো আলো-ছায়ায়। কিন্তু যতই গল্প এগোতে থাকে, আর যতই গল্পের আবহ আচ্ছন্ন করা শুরু করে, ততই বাস্তবতা বিলীন হয় আর প্রবেশ ঘটে পরাবাস্তবতার জগতে। আমাদের চোখের সামনেই দর্শকরা হারিয়ে যায় অন্ধকারে। অথবা বক্তার নিয়মিত বদলে যাওয়া গলা আর বৈচিত্র্যতা থাকা অঙ্গভঙ্গিগুলো প্রাণ নিয়ে যেন মঞ্চে হাজির হ্য় আলাদা আলাদা সব চরিত্র হিসেবে। শৌয়া পিরিয়ডের টোকিওর কোন থিয়েটারের মঞ্চ রুপান্তরিত হয় এডোর কোন পতিতালয়ের ঘরে। আমরা শ্বাসবন্ধ করে বসে থাকি, দর্শকদের সাথেই, তার যখন হঠাৎ কোন কৌতুকে হেসে ঊঠে তখন আমরাও হাসি। অথবা আঁতকে উঠি শিনিগামির আগমনে।

vlcsnap-2016-04-20-21h10m34s128

কিন্তু কেবল রাকুগোর নিখুঁত মঞ্চায়নই না, তার চেয়েও বেশি কিছু, Shouwa Genroku এক অনবদ্য সিনেমাও। সামনে থেকে না দেখতে পাওয়া পারফর্মারের দেহের অঙ্গভঙ্গিগুলো আমরা দেখি, পারফর্মারের পাশে বসে, আসলেই মিশে একাকার হই, শুধু রাকুগোগুলোর গল্পের সাথেই না, তার পেছনের মানুষটার গল্পগুলোতেও। কোন মোনোলোগ না, কোন আলাদা সংলাপ না – কিন্তু পারফর্মারের মনের ভেতর ঢুকে যেতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। হয়তো ছোট একটা শট-ফ্রেমিং – পায়ের আড়ষ্টতা বা ঠোটের কোনের সূক্ষ্ণ হাসি – Shouwa Genroku-’র ছোট ছোট দৃশ্যগুলোই হাজার শব্দের একটা ভাব বহন করে।

Shouwa Genroku-’র মূল গল্পের পুরোটাতেও আমরা বসে থাকি অধীর আগ্রহে, এর অনিবার্য ট্র্যাজেডির জন্য। তার চিরচেনা ভাব-গাম্ভীর্য নিয়েই কিকুহিকো যখন বলে যায় আত্নহত্যা অথবা পতনের গল্প – সুকেরেকু, মিয়োকিচি আর…রাকুগোর।

Cat Soup-এ মৃত্যু-ভাবনাঃ ভালোবাসা এবং অনিবার্যতা — Fahim Bin Selim

মানুষের জ়ীবনের সবচেয়ে বড় ভয়গুলোর মধ্যে একটা সম্ভবত পরিবর্তন; চেনা-পরিচিত জগৎটার পালটে যাওয়া। তা পরিস্থিতির বদলে হতে পারে, স্থান-কালের বদলে হতে পারে, হতে পারে পাত্রের বদলে; কিংবা অনুপস্থিতিতে। এক্ষেত্রে পরিবারের কথাই কি সবার আগে মাথায় আসে না, যেখানে মোটামুটি পরিবারকে ঘিরেই পরিচিত জগৎ-টার শুরু, এবং বড় একটা সময় জুড়ে সেটাই পুরো জগৎ হয়ে থাকে? শিশুদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরো বেশি।

নিয়াত্তার যুদ্ধটা এই পরিবর্তনের বিপক্ষে – পরিণতি আর অনিবার্যতার বিপক্ষে। স্রষ্টা-সর্বপরিচালকের বিপক্ষেও কি না? Cat Soup-এর শুরুটা মাসাকি ইউয়াসার[১]  ট্রেডমার্কড পারস্পেকটিভ শট দিয়ে। ক্যামেরা বাথটাবের ভিতর পরে থাকা, তার উপরে জলের আবরণ – স্থির – আপাত পরিস্থিতির মত। কিন্তু এরপরই নিয়াত্তার আগমন, খেলনা নিয়ে পানির ভেতর হাত ডুবিয়ে খেলতে থাকা, অতঃপর তাতে উপুড় হয়ে পরে যাওয়া, জলের আবরণে আন্দোলন এবং হ্যালুশিনেশনের শুরু। পরাবাস্তবতারও।

vlcsnap-2016-02-21-18h04m26s131

একটা মরা পোকার খোলস দেখা যায়, দেখা যায় বাইরের ঘরে শুয়ে থাকা অসুস্থ নিয়াকোকে। এবারের পারস্পেকটিভ শটটা তার চোখ দিয়ে দেখা – উপরের সিলিং, ক্রমশ জট পাকিয়ে যাওয়া, বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া, ক্রমশ অন্ধকার হয়ে যাওয়া দৃষ্টি। বারান্দায় মৃত্যু দেবতার আগমন। কাছাকাছি দুটি মৃত্যু এবং মহাবৈশ্বিক চিন্তাভাবনায় কোনটাই কোনটার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। নিয়াত্তার যুদ্ধটা এখান থেকেই শুরু। সে মৃত্যু দেবতার হাত থেকে নিজের বোনের আত্নাকে একরকম টানাটানি করেই ফিরিয়ে আনে। তারপর তার মৃতদেহের ভেতর তা পুরে দেয় – আর জাদুর মত তার বোনও মৃত্যুর কোল থেকে ফিরে আসে! জাদুবাস্তবতা অথবা শিশুমনের অলীক কামনা। কিন্তু এভাবেই তাদের অভিযাত্রার সূত্রপাট।

তাদের প্রথম বিরতি এক রঙ্গমঞ্চে – দ্য বিগ হোয়াইট সার্কাস। আরো ভালোভাবে বলতে গেলে স্রষ্টা -‘র সার্কাসে। সবার সামনে একটা মেয়েকে কেটে টুকরো টুকরো করা হয় এবং তার হাতের ছোঁয়ায় তারপর ভোঁজ়বাজির মত তা আবার জুড়েও দেওয়া হয়! দর্শকদের মধ্য থেকে এবার অনুরোধ নেওয়া পালা, প্রথমে চেয়ার, তারপর মাছ, এবং সবশেষে এক হাতি – এবং আর্শ্চর্যজনকভাবে এবারও জাদুর মত সে শুধু বলে – এবং তা হয়ে যায়! তবে দর্শকদের মনোরঞ্জনের পর্ব শেষ হলে স্রষ্টা-‘রটা শুরু। এক প্রবল স্রোতের বন্যায় সবার ভেসে যাওয়া, “নোয়া’হ ফ্লাড” যেন। চারিদিক যতদুর চোখ যায় কেবল পানি আর পানি, কিন্তু নিয়াত্তা আর নিয়াকোর “আর্ক”-এ প্রাণীকূলের প্রতিনিধি হিসেবে কেবল তারা ভাইবোন দুজন বিড়াল আর তাদের “প্রিয়” পোষ্য শুকর(Cat Soup Original দ্রষ্টব্য)। লৌহ-পাখার এক প্রজাপতি উড়ে যায়। নিয়াত্তা আবারো বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকায় তার বোনের পরিচর্যা করা শুরু করে, তাকে খাইয়ে দেয়, এমনকি পোষ্য শুকরের ক্ষতি করে হলেও – নৈতিকতা আর ভাবাদর্শ চুলোয় যাক(আক্ষরিকভাবেই!), পরিবারই সবার আগে অবশ্যই!

Screenshot_2016-02-21-11-00-12

এই নৌকায়ই নিয়াত্তার দেখা পানিতে ভাসতে থাকা মৃত পশুর জীবনচক্র – তার মৃতদেহের পাখিদের পেটে যাওয়া, শিশুপাখির মল হিসেবে পানি-বাতাস পেরিয়ে আবার ভুপৃষ্ঠে ফিরে আসা, অতঃপর পুষ্টি হিসেবে কাজ করে গাছের ডালে ফুল হিসেবে ফোটা। “Adventure Time” কার্টুন সিরিজের মাসাকি ইউয়াসা পরিচালিত পর্ব Foodchain-এ এই থিম পরবর্তীতে আরো বিশেষভাবে ব্যক্ত হয়েছে।

Screenshot_2016-02-21-11-02-09

অনেক তো সুখের সময় গেল – এপর্যায়ে স্রষ্টা-‘র পুনরাগমন। এবং তার খাওয়ার দৃশ্য। এবং অনেকটা তার খামখেয়ালীপনার কারণেই চারিদিক পানিতে ভেসে যাওয়া জায়গাগুলোরই এখন ধুঁ ধুঁ মরুভূমি হওয়ার পালা। “নোয়া’স ফ্লাড” হয়েছে আর “জোসেফ’স ফেমাইন” হবে না? প্রথমে পোষ্য-শুকর এবং পরে মরুভুমির নিচ থেকে বের করা জল-হস্তীর মৃত্যুর পর জলের অভাবে ধুঁকতে থাকা দুই ভাইবোনের এবার আশ্রয় হয় এক স্যাডো-ম্যাসোকিস্ট বুড়োর দূর্গে। আর এখানেই মুভির অন্যতম সেরা দৃশ্যের অবতারনা। খাবার টেবিলে বুড়ো নিয়াত্তা আর নিয়াকোর জন্য আয়োজন করে রাজকীয় ভোজ়ন আর তার পূর্বের রন্ধনদৃশ্যও! মৃত্যু নিয়ে Cat Soup-এর গাঢ়-রসিকতার চূড়ান্ত প্রদর্শনী। নিশ্চিতভাবেই নিয়াত্তার জন্য তা বেশ উপভোগ্যও ছিলো। যতক্ষন পর্যন্ত না তারা নিজেই আবার এর অংশ হয়ে যায় – ক্যাটস্যুপ-এর উপকরণ হিসেবে বিড়ালই তো লাগবে সবার আগে! নিয়াত্তা আর নিয়াকো কোনমতে বেঁচে ফিরে। তবে এবার স্রষ্টা-‘র খামখেয়ালীপনার দ্বিতীয় পর্বের শুরু।
Screenshot_2016-02-21-11-10-34

গড-এর হাত থেকে পরে যাওয়া খাবারের টুকরো ঘড়ির কল-কব্জা আটকে দেয়। আটকে যায় সময়ও। নিয়াত্তার নিজের বোনকে ফিরিয়ে আনার যুদ্ধটা যতটাই স্রষ্টা-‘র বিপক্ষে হোক না কেন, এক্ষেত্রে তাঁর ভ্রুক্ষেপ নেই বললেই চলে – পুরোটাই তার উপভোগের বিষয়, এখানে কেউ তাঁর সহযোগী নয়, কেউ তার শত্রু নয়। আটকে থাকা সময়ে নিয়াত্তা ঘুরে বেড়ায় পৃথিবীর বুকে। তার দেখা হয় আপাতত সময়ে আটকে থাকা, শীঘ্রই ট্রেনের নিচে চাপা পরে মরতে যাওয়া এক নারীর সাথে। নিয়াত্তা তার চোখে লেগে থাকা শক্ত হয়ে যাওয়া দুঃখ মুঁচড়ে খুলে নেয় এবং নিচে আছড়ে ফেলে। তা ভেঙ্গে চুরমার হয়। জীবনের সব সৌন্দর্য আর ভালোলাগার দেখা পাওয়ার জন্য কষ্টগুলো পার হওয়া খুবই তুচ্ছ। যাত্রাটা দুর্গম কিন্তু অসম্ভব নয়। লজ্জা, অপমান, ব্যর্থতা – সবকিছুর কষ্ট সহ্য করে হলেও কি বেঁচে থাকাটাই গুরুত্বপূর্ণ না?

Screenshot_2016-02-21-11-12-19

ঘড়ির কাঁটা সামনে এবং তারপর পিছে আগায়। এবার একগাদা অসংযুক্ত ভিনিয়েট পর্দায় খেলা করে। Mind Game[৩]-এর অনুরূপ! বিড়াল-সহোদর সময়ের চক্রে বুড়ো হয়ে যায়, আবার ফিরে আসে। মানুষেরা পেছনে দুপায়ে হাঁটতে হাঁটতে আদি-বানরের চারপায়ে নেমে আসে, সরীসৃপেরা ডাঙ্গা ছেড়ে নেমে যায় প্রাগৈতিহাসিক জলে। ডাইনোসরদের নির্বংশ করা উল্কাপিন্ড তার অধিবৃত্ত পথে অভিকর্ষ ত্যাগ করে ফিরে যায় মহাকাশে। “উন্নত” মানুষের হিংস্রতার খন্ডচিত্র দেখা যায় – মানুষ মারা যায়; যুদ্ধের মিসাইলে, বন্দুকের গুলিতে, দালানের ধ্বসে, গাড়ি দূর্ঘটনায়। আর এ সবকিছুই হয় নিস্পৃহ স্রষ্টা-‘র ভোজনামোদের অংশ। বিড়াল-সহোদর আবার তাদের নৌকায় ফিরে আসে। কর্দমাক্ত নোংরা জলে যান্ত্রিক মানুষের দেখা মেলে। পুনরাগমন ঘটে লৌহ-ডানার প্রজাপতির। ভাইবোনকে সে পথ দেখায়। আর দেখা মেলে সেই ফুলের, চক্রশেষে যার জন্ম হয়েছিল তাদের থেকেই। নিয়াকো তার প্রাণ ফিরে পায়। সুখী সমাপ্তী!

Screenshot_2016-02-21-11-18-05

অথবা শিশুমনের অলীক কামনা। নিয়াত্তার জীবনের সুখের স্মৃতিগুলো হারাতে থাকে একেক করে – তার বাবা, তার মা, সব শেষে তার বোন। এমনকি সে নিজেও হারিয়ে যায়। মৃত্যুর পর সবই সমান। অন্ধকার।

তাই প্রতিটি মূহুর্তই গুরুত্বপূর্ণ। জীবনে টিকে থাকা, তা যত কষ্ট সহ্য করেই হোক, সবসময়ই তা বিলিয়ে দেওয়ার চেয়ে সুন্দর। কারণ জীবনের প্রতিটি স্মৃতিই, প্রতিটি মূহুর্তই গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের অংশ হও। তা এমনকি ছোটবেলায় পরিবারসহ সৈকতে গিয়ে তোলা কোন ছবিতে হলেও

vlcsnap-2016-02-21-17h47m20s104

 

 

[১] – [https://en.wikipedia.org/wiki/Masaaki_Yuasa]

[২] – [http://kisscartoon.me/Cartoon/Adventure-Time-with-Finn-Jake-Season-06/Episode-007-008?id=3768]

[৩] – [https://en.wikipedia.org/wiki/Mind_Game_(film)]

FLAG!(2009) রিভিউ — Fahim Bin Selim

FLAG!(2009)
★★★★☆

[ইংলিশ ডাব]

অরিজিনাল নেট অ্যানিমেশন

জনরাঃ ওয়ার ড্রামা, মিলিটারী
প্রযোজকঃ দ্য অ্যান্সার স্টুডিও (Garden of Words, Golgo 13)
মূল ও পরিচালনাঃ রিওস্কে তাকাহাশি (Gasaraki, The Cockpit)

সেন্সরঃ সরাসরি ভায়োলেন্স অনুপস্থিত

মাইঅ্যানিমেলিস্ট রেটিংঃ ৭.৩৬(#২০২৬)

 

FLAG

গৃহযুদ্ধ-বিদ্ধস্ত উদিয়ানা(Uddyana). একে অনেকটা মধ্যপ্রাচ্য আর দক্ষিণ এশিয়ার সংকর বলা যায়। একপাশে দিগন্ত বিস্তৃত মরুভূমি আর বেদুঈনদের বাস, আরেকদিকে চারিদিক ঘেরা সুউচ্চ পাহাড়ের খাঁজে গড়ে ওঠা এর প্রধান শহর সুবাশি(Subasci) – আর তার মানুষ – সনাতন আর বৌদ্ধ ধর্মের মিশেলে এক ধর্মের অনুসারী যারা, আর তাদের প্রার্থণার বড় একটা অংশ জুড়েই হয়তো বা ছিলো চলমান যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে রেহাই পাওয়ার ব্যগ্র কামনা।

সায়াকো শিরাসু – জাপানী অনুসন্ধানী চিত্র-সাংবাদিক – তরুণী। যুদ্ধের কারণেই উদিয়ানায় পা রাখা তার, জ্যেষ্ঠ আর অভিজ্ঞ কেইচি আকাগির সাথে।তারপর হঠাৎ যখন বিক্ষোভের উত্তাল এক মূহুর্তে  তার তোলা বিপ্লবীদের হাতে উড়ন্ত UNF(জাতিসংঘ)-এর পতাকার এক ছবি হয়ে দাঁড়ালো উদিয়ানার শান্তিচুক্তির শক্ত হাতিয়ার, পুরো জাতির আশার প্রতীক, তখন খুব দ্রুতই শিরাসুর জীবনের মোড় ঘুড়ে গেল। সে পেয়ে গেল নায়োকোচিত(নায়িকাচিত?) সংবর্ধনা, আর আন্তর্জাতিক খ্যাতি। কিন্তু চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার আগেই অপহৃত হলো সেই বিখ্যাত পতাকা। UNF থেকে তৈরি করা হল গোপন এক মিলিটারী ইউনিট, একমাত্র লক্ষ্য – শান্তিচুক্তির আগেই সেই পতাকা পুনোরুদ্ধার। আর সেই পতাকার সাথে তার যোগসূত্র থাকায়, অনেকটা মাসকট হিসেবেই শিরাসুকে জুড়ে নেওয়া হল এই দলে। তার সু্যোগ মিললো পুরো অপারেশনটা ক্যামেরাবন্দী করার। আর চিরদিনের জন্য একটি জাতির কিংবদন্তীর অংশ হওয়ার।

vlcsnap-2016-02-11-00h04m03s203

পলিটিক্যাল ড্রামা অ্যানিমে তুলনামূলক কম হলেও, একেবারে কম না। কিন্তু এক্ষেত্রে FLAG এর বিশেষত্ব হচ্ছে তার গল্পের প্রেক্ষাপট, বাস্তব-বিশ্বের সাথে রিলেটেবলিটি আর অবশ্যই এর গল্পবর্ণনার পারস্পেরক্টিভ। আর এখানে এর কৌশলগত বিশেষত্বও। FLAG-এর পুরোটাই তার দুই মূল চরিত্র সাংবাদিকের চোখ দিয়ে দেখানো, এবং সেটা আক্ষরিক অর্থেই – FLAG হলো (সম্ভবত) প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র “Found Footage” টিভি অ্যানিমে। অ্যানিমেশনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য এক কীর্তি বলেই মনে হবে! কিন্তু সত্যি সত্যি-ই, FLAG-এর ২০ মিনিট ব্যপ্তীর পুরো ১৩ পর্ব ধরে দেখানো প্রতিটি মূহুর্ত হয় তার চরিত্রদের তোলাঃ স্থিরচিত্র বা ভিডিও অথবা কম্পিউটার পর্দায় চলা কোন ফাইল অথবা হেলিকপ্টার, সমরযন্ত্রের ভেতর-বাইরের ক্যামেরায় বন্দী হওয়া দৃশ্য – যেগুলো কখনো কখনো কেবলই একগাঁদা স্থিরচিত্রের মনটাজ, কখনো বা সম্মুখসমরে চলা রুদ্ধশ্বাস কোন দৃশ্য, আবার কখনো বা দুপুরের ব্যস্ততার সময়টায় মিলিটারী ক্যাম্পের রাঁধুনীর একান্ত সাক্ষাৎকার।

vlcsnap-2016-02-12-16h31m54s196

“Found Footage” কায়দাটা “সত্যিকারের” ক্যামেরায় কাজে লাগানো যতটা সহজ, অ্যানিমেশনে ততটাই কঠিন, যেহেতু অ্যানিমেশন বানাতে কোন ক্যামেরা লাগেনা। সাধারন ক্ষেত্রে ক্যামেরার বিভিন্ন বিষয়গুলো খুব দ্রুত এবং সহাজাতভাবেই হয়, সেখানে অ্যানিমেটরদের তা প্রতিটি ফ্রেমেই আলাদাভাবে ফুটিয়ে তুলতে হয়েছে। এটেনশন টু ডিটেইলস হাঁ করে দেওয়ার মত। FLAG-এর “পাওয়া ফুটেজ”-গুলো কেবল এক কোনায় “REC” আর আরেক কোনায় সময়-তারিখ দিয়েই শেষ হয়ে যায়নি, এর ক্যামেরাগুলো গল্পের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখানে ক্যামেরাগুলো হঠাৎ সূর্যের আলোতে তাক করলে পর্দা অন্ধকার হয়, জুম-ইন আর জুম-আউটের সময় ঘোলাটে হয়ে যায়, বাহকদের কাঁপা কাঁপা হাতের সাথে তারাও নড়তে থাকে। অধিকাংশ সময়ই ফার্স্ট পারসন ভিউ থেকে দেখানো, শটগুলোও অনেক সময় দীর্ঘ আর আনকাট। আর একারণেই গল্পের দুই মূলচরিত্র শিরাসু আর কেইচির স্ক্রিনটাইম খুবই নগন্য। আমরা তাদের হাতে ধরা ক্যামেরার সাথেই পুরো উদিয়ানা চষে বেড়াই।

vlcsnap-2016-02-11-00h07m25s214

FLAG এর গল্প দুটো – সমান্তরালে চলা – শিরাসু আর কেইচির। শিরাসুর উপস্থিতি মিলিটারী ক্যাম্পের ভেতরে, যা আপাত নিরস, নির্মোহ সৈন্যদেরও – যাদের কাজই হচ্ছে মানুষের প্রাণ নেওয়া, সেটা সন্ত্রাসবাদ রুখতে কোন পরিকল্পিত আক্রমনের বলী চরমপন্থীই হোক, বা কোন “অঘটনে্র শিকার” সাধারণ মানুষে – মানবীয় দিক উপস্থাপনের প্রয়াস। আমরা শিরাসুর সাথে ঘুরে বেড়াই মিলিটারী ক্যাম্পের ব্যারাক, তার রান্নাঘর, তার পরিকল্পনা রুমে – আমরা তার সাথে হেলিকপ্টারে চড়ি, বেদুঈনদের সাথে দিন কাটাই, মধ্যরাতের রোমাঞ্চকর সব মিশনের সঙ্গী হই। আবার যুদ্ধ-রাজনীতির বিশাল বিস্তৃত সাদা-কালো ঘর করা ছকে ধীরে ধীরে সৈন্য শ্রেনীর গুঁটি হিসেবে আটকা পরি, আর বাকিদের মত।

HAVWC(team)

শিরাসু যেখানে বাইরের বিশ্ব থেকে বিযুক্ত, সেখানে কেইচি বরং সুবাশিতে আমাদের ভ্রমণসঙ্গী। আমরা তার সাথে পৌছাই বেজমেন্টের এক ক্যাফেতে যেখানে সব ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকদের আসর বসে, অথবা জ্যোৎস্না রাতে দেখে আসি উদিয়ানার শতাব্দী প্রাচীন এক ধর্মীয় আচার, কিংবা হতবিহবল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি সদ্য বোমা-বিদ্ধস্ত এক নগরীর ধ্বংসস্তুপে। কেইচি আমাদের ন্যারেটর। সে উদিয়ানার ইতিহাস সম্পর্কে জানায়, তার ঐতিহ্য সম্পর্কে জানায় – আর আমরা যখন উদিয়ানার এই সমৃদ্ধ ইতিহাস আর তার প্রাণবন্ত ঐতিহ্য সম্পর্কে জানি – তা কোন অংশেই “ফিকশনাল” মনে হয় না। যেন পৃথিবীর মানচিত্র ফুঁড়ে বের হওয়া জীবন্ত কোন দেশ। উদিয়ানার বারুদের গন্ধ ভেসে বেড়ানো বাতাস আর এর রক্তভেজা পাহাড়, চারিদিক ছড়িয়ে থাকা এর মিথোলজি আর তার মানুষের জীবন-দর্শন, তাদের  অনিশ্চয়তায় ঘেরা বর্তমান আর আশায় বুক ভরা ভবিষ্যতের সাথে আমরা একাকার হই।

vlcsnap-2016-02-11-00h05m48s18

“Now we are out of place in our own home,” কেইচি সেইসব মানুষের ছবি তুলে, তাদের গল্প শুনে।  “You take our pictures and go home. But we have to stay here and live through all of this. Because this is the only place we can stay.”  তাদের মুখে লেগে থাকা স্মিত হাসির গভীরে দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়। লুকিয়ে রাখা সেইসব ক্ষত জট পাকিয়ে বেরিয়ে আসে, দুই পাহাড়ের মাঝখানে অস্ত যাওয়ার সূর্যের ক্ষনিক আভায় দ্যুতি ছড়ায়। কেইচির ক্যামেরায় আটকা পরে যুদ্ধের রেখে যাওয়া ধ্বংসলীলা।

vlcsnap-2016-02-12-16h32m58s66

ইংলিশ ডাবের ভয়েস অ্যাক্টিং সহজাত। আর্ট আর অ্যানিমেশন চমৎকার। এমনকি থ্রিডি অ্যানিমেশনও আর বেশিরভাগ অ্যানিমের চেয়ে ভালো। আর সবকিছুর মতই এর ক্যারেক্টার আর মেকা ডিজাইনও বাস্তবস্মত। যুদ্ধযন্ত্রগুলো এক লাফে দশ ফুট উঠে যায় না, আকাশে ভেসে বেড়ায় না। বরং যখন নতুন তাতে নতুন এক রাইফেল লাগানোর পরিকল্পনা করা হয়, তখন বেশ কঠিন অংক কষেই তার পরিমার্জন করা হয়। তাদেরও দূর্বলতা, সীমাবদ্ধতা আছে। তারা পদার্থবিজ্ঞানে সূত্র মেনেই চলে। মেকা অ্যাকশন দৃশ্য হাতে গোনা এবং সাধারণ, বরং এর ক্যারেক্টার ড্রামাই গল্পের মূল আকর্ষন।

vlcsnap-2016-02-12-16h30m39s177

এর চরিত্ররদের মুভমেন্ট, ফেস এক্সপ্রেশন বাস্তবসম্মত না হয়েও বাস্তবসম্মত – সর্বদাই ক্যামেরা সামনে থাকায়, সেলফ-অ্যাওয়ার হওয়ায়, আলাদা একটা অস্বস্তি, জড়তা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আর এখানেই মূলত FLAG ভালো লাগা, না-লাগার ব্যাপারটা এসে যায়। এর গল্প যতই আকর্ষনীয় হোক, ন্যারেটিভ স্টাইলকে কোনভাবেই অগ্রাহ্য করা যায় না। তার চরিত্রগুলোর মতই ক্যামেরার উপস্থিতি সবসময়ই আমাদের চোখে লেগে থাকে। তার সাথে মানিয়ে নিতে না পারলে ১৩ পর্ব ধরে বসে থাকার মত ধৈর্য্য হওয়ার কথা না। FLAG-এর পেসিং ধীরগতির না হলেও, তখন সেটা “বোরিং” লাগাই স্বাভাবিক।

FLAG অনুসন্ধানী-সাংবাদিকতার প্রতি প্রেমপত্র। একে অ্যানিমেটেড স্যুডো-ডকুমেন্টারি বলা যায়, অথবা তার চেয়েও বেশি বলা যায় কোন ভবিষ্যৎ ডকুমেন্টারি বানানোর পেছনের গল্প – তার কাঁচামাল ইমেজ আর ভিডিওর সমাহার মাত্র। সেই ডকুমেন্টারি আদৌ বের হয় কিনা আমাদের জানা সম্ভব না। কারণ FLAG-এর কাহিনী অসমাপ্তই থেকে যায়। পৃথিবীর বুকে চলতে থাকা বর্তমান সব যুদ্ধের মতই কি না?