শুরু করি কবির ভাষায়,
কবি বলেছেন :
“যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই,
পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন”
এনিমের এই বিশাল দুনিয়াকে একটা ছাইয়ের গাদার সাথে তুলনা করা যেতেই পারে। এনিমের এই গাদায় ছাই (পড়ুন আজেবাজে এনিমে) অনেক থাকলেও ‘রত্ন’ খুব কমই আছে যা আমাদের বেশিরভাগরই দৃষ্টিগোচর থাকে। ঠিক তেমনই একটি রত্ন ‘আওই বুঙ্গাকু’।

এনিমে: আওই বুঙ্গাকু সিরিজ (Aoi Bungaku Series)
জনরা: ড্রামা, সাইকোলজিকাল, সেইনেন, হিস্টোরিকাল, থ্রিলার
পর্ব: ১২
স্টুডিও: ম্যাডহাউস
Synopsis: জাপানের ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা ছয়টি উপন্যাস/গল্পের অ্যাডাপ্টেশন নিয়ে তৈরি এই এনিমে সিরিজ। গল্পগুলো হলো: ওসামু দাজাইয়ের ‘নো লংগার হিউম্যান’ ও ‘রান!মেলস’, আঙ্গো সাকাগুচির ‘আন্ডার চেরিস ইন ফুল ব্লুম’, নাতসুমে সোসেকির ‘কোকোরো’ এবং আকুতাগাওয়া রিওন্নোসুকের ‘ দ্য স্পাইডারস থ্রেড’ ও ‘হেল স্ক্রিন’।প্রতিটি গল্প ভিন্ন এবং ভিন্ন ভিন্ন দিক তুলে ধরে।
স্টোরি ডেভেলপমেন্ট:
সাইকোলজিকাল এনিমে মানেই যে ‘মাথার তিন হাত উপর দিয়ে যাওয়া ‘ স্টোরি বা ভুরি ভুরি গোর সিন ওয়ালা সিরিয়ালকিলিং সাইকোপ্যাথদের কাহিনী না, তার উৎকৃষ্ট উদাহরন হলো ‘আওই বুঙ্গাকু’। এ সিরিজে তুলে ধরা হয়েছে বাস্তব জীবনের বিভিন্ন পর্যায় আর এ পর্যায়কালীন সময়ে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো।এর স্টোরিগুলো এতটাই ক্যাচি আর থ্রিলিং যে দেখতে দেখতে কখন যে সিরিজের চরিত্রগুলোর সাথে এক হয়ে যাবেন আর তাদের সুখ-দুঃখ,কষ্ট,বেদনা আপনার সুখ- দুঃখ হয়ে গেছে বুঝতেও পারবেন না।

প্রতিটি স্টোরি একে অপর থেকে আলাদা। তাই প্রতিটি স্টোরির আলাদা আলাদা ইনসাইট/রিভিউ তুলে ধরলাম:
নো লংগার হিউম্যান:
সিরিজের প্রথম এবং সবচেয়ে বড় গল্প। লেখক ওসামু দাজাইয়ের অনবদ্য এই সৃষ্টি অনেকটা অটোবায়োগ্রাফি ই বলা যেতে পারে কেননা লেখক প্রায় নিজের জীবনের কথায় কাল্পনিক চরিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। চার এপিসোডের এ গল্পে দেখানো হয়েছে ধনী,হতাশাগ্রস্থ ও প্রত্যাশার ভারে পিষ্ট এক তরুনের সমাজে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা।কোনো মানুষের জীবন যে এতটা দুঃখজনক আর ডিপ্রেসিং হতে পারে তা নো লংগার হিউম্যান না দেখলে জানা সম্ভব না। চিরকাল মনে দাগ কাটার মত ক্ষমতা রাখা এ গল্পটি কেন জাপানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিক্রিত ও সর্বাধিক পঠিত গল্প/উপন্যাস তা দেখলেই জানতে পারবেন।
আন্ডার চেরিস ইন ফুল ব্লুম:
সিরিজের সবচেয়ে টুইস্টেড স্টোরি আর বড় ফ্ল বলা যায়। ফ্ল বলার কারণ হলো এর খারাপ অ্যাডাপ্টেশন। কারন বইয়ে যেখানে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একধরনের ইন্টেসিটি ছিল এনিমেতে তা অনুপস্থিত।সেই সাথে প্রেজেন্টেশনও হতাশাজনক ছিল।
কোকোরো:
নাতসুমে সোসেকির অসাধারন সৃষ্টি এবং জাপানের সর্বোচ্চ বিক্রিত উপন্যাস। দুই এপিসোডের এ গল্পতে একটি ত্রিভুজ প্রেম দেখানো হয়েছে।কিন্তু নতুনত্ব হলো, এখানে দুই ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে আলাদা আলাদাভাবে গল্পটিকে দেখানো হয়েছে। আমাদের মধ্যে একজনের দৃষ্টিকোণ অন্যজন থেকে কতটা ভিন্ন হতে পারে তাই তুলে ধরা হয়েছে।আর নামের সার্থকতা রক্ষার স্বার্থেই কিনা এটি আপনার ‘কোকোরো’ নিয়ে খেলবে এবং তা চুরমার করবে। কিছু ভুলত্রুটি থাকলেও এটি সিরিজের সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং গল্প।
রান!মেলস:
সিরিজেরএকমাত্র প্যাঁচগোছহীন গল্প। Damon and Pythias নামক এক গ্রিক লেজেন্ড দিয়ে তৈরি নাটিকার সাথে তুলনা করে দুই বন্ধুর বন্ধুত্বের গল্প বলা হয়েছে। হার্টওয়ার্মিং একটা গল্প।
দ্য স্পাইডারস থ্রেড:
‘ডুবন্ত মানুষ খড়কুঁটো ধরেও বেঁচে থাকতে চায়’ কথাটির জাপানিজ সংস্করণ হলো দ্য স্পাইডারস থ্রেড। পার্থক্য শুধু খড়কুটোর বদলে এখানে মাকড়শার সুতাকে দেখানো হয়েছে।একজন মৃত্যুভয়হীন গুপ্তঘাতক যখন মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে এসে পৌছায় তখন তার মধ্যে জেগে উঠা বেঁচে থাকার অদম্য চেষ্টাকে এ গল্পে তুলে ধরা হয়েছে। আকুতাগাওয়া রিওন্নোসুকের লেখা এ ছোট গল্পটি মূলত বাচ্চাদের জন্য লেখা হলেও এনিমেতে ম্যাচিউর দর্শকদের উপযোগী করে তুলে ধরা হয়েছে। এর মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো ভালো ছিল।
হেল স্ক্রিন :
আকুতাগাওয়া রিওন্নোসুকের এ ছোটগল্পকে দুটি শব্দে প্রকাশ করা যায় এবং সেটি হলো ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’। এতে দেখানো হয়েছে এক সৎ চিত্রশিল্পী ও তার মেয়ের কথা এবং তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর গল্প। এটির গল্প যেমন আপনার রক্ত হিম করে দিবে ঠিক তেমনি এর সৌন্দর্যে আপনি অস্ফুটে বলে উঠবেন ‘অসাধারন!’। অসাধারন একটি অ্যাডাপ্টেশন। আমার পার্সোনাল ফেভারিট।
আরেকটা কথা না বললেই নয়, প্রতি গল্পের শুরুতে সে গল্পের লেখক সম্পর্কিত টীকাগুলো অসাধারন ছিল।

আর্ট ও অ্যানিমেশন:
প্রথমে আসি অ্যানিমেশনে,আমার দেখা স্টুডিও ম্যাডহাউসের কাজগুলোর মধ্যে বেস্ট। গল্পের ভাব বুঝে কালার আর অ্যানিমেশনের এত সুন্দর প্রেজেন্টেশন আর কোনো এনিমেতে দেখিনি। মন খারাপ করা পরিবেশ থেকে রঙে পরিপূর্ণ পরিবেশের পরিবর্তনগুলো(আন্ডার চেরিস ইন ফুল ব্লুম বাদে) অসাধারন লেগেছে।
আর্ট অসাধারন। বিখ্যাত মাঙ্গাকারা আর্ট করেছেন তাই অসাধারন হওয়াটাই স্বাভাবিক।এনিমের পোস্টারে বসে থাকা ক্যারেক্টারকে দেখে অনেকেরই মনে হতে পারে, “আরে! ইয়াগামি লাইট না!!” এর কারন হলো এ এনিমের পোস্টার এবং দুটি গল্প নো লংগার হিউম্যান আর কোকোরো এর জন্য আর্ট করেছেন মাঙ্গাকা ‘তাকেশি ওবাতা'(ডেথনোট,বাকুমান,প্লাটিনা এন্ড)।এছাড়া আন্ডার চেরিস ইন ফুল ব্লুম, দ্য স্পাইডারস থ্রেড, হেল স্ক্রিনের আর্ট করেছেন ‘টিটে কুবো'( ব্লিচ)। রান মেলসের জন্য আর্ট করেছেন ‘তাকেশি কোনোমি'( প্রিন্স অফ টেনিস)।

সাউন্ড ও মিউজিক:
এনিমের দূর্বল জায়গা বলা যায়। সিরিজে কোনো ওপেনিং সং ছিল না আর এন্ডিংটা আমার শোনা সবচেয়ে বাজে এন্ডিং সংয়ের মধ্যে একটা। তবে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক মোটামুটি ভালো ছিল।
এন্জয়মেন্ট:
একটি এনিমের এন্জয়মেন্ট বড় একটি বিষয় কেননা দিনশেষে এনিমেটি এন্জয় করেছি কিনা সেটাই মূখ্য। এক্ষেত্রে আওই বুঙ্গাকুর এন্জয়মেন্টকে অনেকটা মরুভূমি ভ্রমনের সাথে তুলনা করা যায়। মরূভুমির মতো এনিমেটিরও পুরো পথ পাড়ি দিতে অনেক কষ্ট হতে পারে, এ পথ হয়ত মাঝেপথেই শেষ করতে চাইবেন।কিন্তু ধৈর্য্য ধরে যদি পথটি শেষ করতে পারেন তবে এটি হতে পারে আপনার সেরা ভ্রমনের একটি। তাই দেরী না করে দেখে ফেলুন জাপানী সাহিত্যেকে অসাধারনভাবে ফুঁটিয়ে তোলা মারাত্মকরকমের সুন্দর এবং দূর্দান্ত এই এনিমেটি।
My Animelist Rating: 7.92
Personal Rating: 9
