Code Geass: কেবলই কী অ্যানিমে? নাকি অননুভূত অভিজ্ঞতার রূপকও?
▬▬
Code Geass সম্পর্কে লেখার আগে একবার উইকি আর MAL’এ ঢুঁ মেরেছিলাম প্রোডাকশন সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে। অতীত অভিজ্ঞতার কারণেই জেনে নেয়া দরকার ছিল কোড গিয়াস অরিজিনাল সিরিজ নাকি মাঙ্গা অ্যাডাপশন। যেহেতু কোড গিয়াসের কোন মাঙ্গা ছিল না, তাই আলাদা কোন মানদণ্ড নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
—
Ichirō Ōkouchi এবং Gorō Taniguchi’র প্রশংসা করতে হবে। গোপন এক সংস্থা, নেপথ্যের ভিজিলান্টে নায়ক এবং গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলির মাঝে মূল্যবোধের পার্থক্য – বলা চলে সাদামাটা প্লট নিয়ে আগাচ্ছিলেন দুজন। অথচ সেই সাদামাটা প্লটকেই ব্যপক রূপ দিয়ে সিরিজকে এন্টারটেইনমেন্ট ভ্যালু তো দিয়েছেনই, সেই সাথে বিচ্ছিন্ন ভাবনার উদয় হবার সুযোগও রেখেছেন। এই লেখায় আমার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কিছু হাইপোথিসিস এবং কাউন্টার হাইপোথিসিস প্রস্তাব করব। এছাড়াও থাকবে ব্যক্তিগত ভালোলাগা মন্দলাগার কিছু টুকরো কথা।
—
Code Geass এর ঘটনাবলী অল্টারনেট টাইমলাইনের, যেখানে ব্রিটানিয়ান এম্পায়ার গোটা পৃথিবীর উপর একছত্র, একনায়কতন্ত্র কায়েমের তালে আছে। এটা স্পষ্টত যে এই ব্রিটানিয়ান এম্পায়ার আমাদের পৃথিবীতে অ্যামেরিকা; মানচিত্রে খেয়াল করলে দেখা যায়, USA এবং Latin America দুটো মিলেই ব্রিটানিয়ান এম্পায়ার। সুতরাং ব্যপারখানা দাঁড়াচ্ছে, অ্যামেরিকা ঔপনিবেশিকের ভূমিকায় আসীন এবং এক পর্যায়ে জাপান দখল করে নেয়।
—
এই দৃশ্যপটের পেছনে কিছু ব্যপার থাকতে পারে।
এক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এশিয়ানদের উজ্জ্বীবিত করতে এবং দলে টানতে সত্য-মিথ্যার মিশেলে কিছু অ্যর প্রোপাগান্ডা ছড়ায় জাপান। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, পুঁজিবাদ ছিল যার উপজীব্য বিষয় এবং ডিকটেটরশিপটুকু বাদ দিলে ব্রিটানিয়ান এম্পায়ার পুঁজিবাদী এবং ঐপনিবেশিক মনোভাবের কোন এক জাতির অর্জনের চুড়ান্তরূপ হিসেবে ধরা যায়। যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থায় যদি পরাশক্তিরা পৃথিবী ভাগের তালে থাকত তবে হয়ত এরকমই হতো। এই থিওরীর পিছে আরেকটা ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল Nagasaki Arch, সম্ভবত পঞ্চম বা ষষ্ঠ এপিসোডে ক্ষণিকের জন্য দেখানো হয়, ব্রিটানিয়ান এম্পায়ারের জাপান আক্রমণের সময়কালে। এটা সেই আর্ক যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের নাগাসাকিতে ফেলা অ্যাটমিক তাণ্ডবের মাঝেও আস্ত ছিল। কোড গিয়াস ওয়ার্ল্ডেও চারপাশে ধ্বংসলীলা নিয়ে সদর্পে টিকে আছে। সোজা কথায়, ডিফরেন্ট টাইমলাইন, অ্যামেরিকা ইনভেডার, জাপান নির্দোষ। (পয়েন্ট টু বি নোটেডঃ আমি নিউক্লিয়ার অ্যাটাককে জাস্টিফাই করছি না, ক্রাইম অনুযায়ী জাপানকে খুব বেশিরকম আর নিষ্ঠুর মূল্য দিতে হয়েছে) তবে এই থিওরীতে যে ত্রুটি নেই সে দাবী করছি না, কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান-জার্মান-ইতালি জোট হেরে গেলেও, জাপানের প্রোপাগান্ডা অনুযায়ী প্রস্তাবিত সিস্টেম (ব্রিটানিয়ান) বাস্তবে রূপ নেয়ার সুযোগ ছিল না। এটা ছিল স্রেফ দলভারী করার প্রয়াসমাত্র, নিদেনপক্ষে যুদ্ধচলাকালীন সময়ে। ওই সেন্টিমেন্ট এতদিন পর কেউ অ্যানিমেতে তুলে ধরবে বলে মনে হয়না। তাছাড়া সেসময় আরেক পরাশক্তি ছিল USSR, কোড গিয়াসের দুনিয়ায় রাশিয়ার অস্তিত্ব নেই।
দুই, একবিংশ শতাব্দীর কিছু আগে থেকে এবং তারও আগে কোল্ড অ্যর চলাকালীন সময়ে অ্যামেরিকা কাগজে কলমে সাধু সাজলেও নানা ছুতোয় বিভিন্ন দেশের অ্যাফেয়ার্সে বাগড়া দিয়েছে এবং দিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের অনেকাংশ বিভিন্ন সময়ে ইউএস সরকারের দখলে ছিল এবং এখনও আছে। সেই সাথে বন্ধু রাষ্ট্রের উপরও বড়ভাইয়ের মতো আচরণ অদৃশ্য এক কলোনিস্ট জায়ান্টের কথা মনে করিয়ে দেয়। হতে পারে Code Geass’এ এই জায়ান্টের ফিজিকাল এবং ভবিষ্যৎ এক্সট্রিম রূপ ব্রিটানিয়ান এম্পায়ার। ২০০৬ সালে নির্মিত কোড গিয়াসের প্লট সময়কাল ২০১৭ করাটা কেবলমাত্র সাইফাই রূপ দেয়নি, এই ভীতিটার খসড়া একটা রূপও প্রদান করেছে। আবারও, ডিকটেটরশীপটুকু বাদ দিয়ে। সরাসরি আঙ্গুল তোলা থেকে বিরত থাকতে এবং সাইফাই/ফ্যান্টাসি রূপদানে গিয়াস পাওয়ার আর একনায়কতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন ছিল।
অ্যানিমে সিরিজ কম দেখা হলেও অ্যানিমে মুভি দেখা হয়েছে বেশ, এবং আনুপাতিক হারে দেখলে এমন সুপ্ত কোন প্লট থাকার সম্ভাবনা খুব কম হলেও একেবারে বাদ দেয়া যায় না। এমনকি জিবলি স্টুডিও এর বাইরে নয়। গেলো বছর দুয়েক আগে, জাপানিজ এয়ারক্রাফট এঞ্জিনিয়ার জিরো হোরিকোশির বায়োপিক The Wind Rises এ আমরা দেখেছি তরুন এক ইঞ্জিনিয়ারের স্বপ্ন সফল করার আপ্রাণ প্রয়াস আর সেই সাথে নিখাদ দেশপ্রেম আর জাতিগত আত্মসম্মানবোধের মিশ্রণ। কিন্তু পর্দার আড়ালে এই সত্যটুকু চাপা পড়ে গেছে যে, জিরো হোরিকোশির ফাইটার প্লেনগুলো ঠিক শান্তি বজায় রাখতে যায়নি, বরং জার্মান অ্যালায়েন্সের অংশ হিসেবে জাপান আক্রমণকারীই ছিল। গ্রুপে Md Asiful Haque ভাইয়ের ব্যপক এক রিভিউ আছে এই অ্যানিমে নিয়ে।
তিন, আবারও সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড অ্যরের দারস্থ হতে হবে তবে ভিন্ন দৃষ্টিকোণে। হিটলার, তার নাৎসি সাম্রাজ্যের সাথে ব্রিটানিয়ান সম্রাট চার্লসের ব্রিটানিয়ান এম্পায়ারের সেন্টিমেন্ট প্রায় সদৃশ বলা চলে। হিটলারের আরিয়ানদের মতই ব্রিটানিয়ানরা অন্য জাতিকে অস্পৃশ্য এবং নীচু মনে করে। আরিয়ানিজমের (Aryanism) সূতিকাগার ছিল জার্মানি, ব্রিটানিয়ান এম্পায়ারও তাই। লেখক ও পরিচালক Ichirō Ōkouchi এবং Gorō Taniguchi’কী তবে কোড গিয়াসে অ্যান্টি-নাজিজম সেন্টিমেন্ট রেখেছেন? এই সেন্টিমেন্টের জন্ম কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের পক্ষে যুদ্ধ করার অপরাধবোধ থেকে? কে জানে।
আমি স্রেফ পয়েন্টগুলো উল্লেখ করলাম, গ্রহণ বা বর্জন করতে বলা আমার উদ্দেশ্য না। এগুলো হাইপোথিসিস, আগেই বলেছি। আবার অনেকটা স্বগতোক্তির মত। বাকিটা পাঠকের উপর নির্ভর করবে।
—
►দর্শক প্রতিক্রিয়া◄
এই অংশ সম্পূর্ণই অ্যানিমের স্টোরি রিলেটেড। এবং কিছু মাইল্ড স্পয়লার থাকবে, যিনি এখনও কোড গিয়াস দেখেননি, সামনে না এগোতে অনুরোধ করছি।
–**স্পয়লার অ্যালার্ট**–
কোড গিয়াস দেখতে গিয়ে এক ধরণের নতুন অনুভূতির সাথে পরিচিত হয়েছি। যখন দেখা শুরু করেছি, একের পর এক এপিসোড দেখে গিয়েছি বিরতিহীন। যখন বিরতি নিয়েছি, আবার দেখতে ইচ্ছে করেনি, একরকম অনীহা কাজ করেছে। আবার যখন দেখতে বসেছি, বিরতিহীন ভাবে দেখেছি। ইন এ সেন্স, কোড গিয়াস মাদকের মত ছিল।
সবচেয়ে যে ব্যপারটা দোলা দিয়েছে, তা হল গল্পের আনপ্রেডিক্ট্যাবিলিটি। কিছু কিছু ইভেন্ট আন্দাজ করতে পারলেও বেশীরভাগেই চমকে গিয়েছি। সুপার থ্রিলিং আর টুইস্ট ভর্তি শো’ হিসেবে কোড গিয়াস সবার শীর্ষে থাকবে কোন সন্দেহ নেই। সেই সাথে ক্যারেক্টার গুলোর তারিফ করতে হবে, এক্কেবারে নিখুঁত চিত্রায়ন। যেমন, Suzaku’কে হটাৎ করে পিষে ফেলতে চাওয়ার মত পাওয়ারফুল ইমোশন এমনি এমনি তৈরী হয়না। অথচ আইডিওলজিকালি সুজাকুর স্ট্যান্ড কোনভাবেই ফেলনা ছিল না। রক্তারক্তি থামানোই মূল ইচ্ছে ছিল সুজাকুর, তাতে সার্ভোভৌমত্ব যায় যাক। কাপুরুষত্ব? হতে পারে; কিন্তু ভুল নয়।
আচ্ছা, ভিন্ন একটা কোড গিয়াস ওয়ার্ল্ড বিবেচনা করা যাক যেখানে বর্তমান পৃথিবীর দেশসমূহের বদলে ফিকশনাল কিছু ল্যান্ড রয়েছে এবং এরিয়া ১১ শুরু থেকেই ব্রিটানিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত। তাহলে এরিয়া ১১’কে স্বাধীন করতে গড়ে ওঠা ব্লাক নাইট অর্গানাইজেশন আর জিরো আদতেই টেররিস্ট এবং সুজাকু আদতেই হিরো। স্রেফ ন্যাশনালিস্ট সেন্টিমেন্ট দর্শকের মনে সুজাকুর অবস্থান পাল্টে দিয়ে জিরোকে হিরো হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।
এই পর্যায়ে প্রশ্ন করতে হবে, জিরো আদতেই হিরো ছিল কিনা। জিরো বা ‘লুলুচ ভাই ব্রিটানিয়া’র (ধন্যবাদ ইয়ামি আপু, নামটা পছন্দ হইছে) কোন ইচ্ছেই ছিলো না পাবলিক সার্ভিস দেয়ার, তার সবগুলো মোটিভ পারসোনাল এবং পারসোনাল গেইনেই তার সব প্লান। হ্যাঁ, সেগুলো হারানো জাপানের দমিত জনসাধারণের পক্ষেই গেছে কিন্তু সেটা জিরোর উদ্দেশ্য ছিল না এটা পরিস্কার। তাই, জিরো আসলে ভিলেইন। একেবারে শেষে আত্মাহুতি দিয়ে ভিজিলান্টিজম আর জাস্টিস আপহোল্ড করার চিহ্ন হিসেবে জিরো চরিত্রকে হিরোর মর্যাদায় উঠিয়ে দিয়ে গেলেই লুলুচের ক্রাইমগুলো মাফ হয়ে যায় না। ইনফ্যাক্ট, গিয়াস ব্যবহার করাটাই ক্রাইম, সুপারপাওয়ার নয়। জিরো তাই আমার চোখে সুপারহিরো তো নয়ই, হিরোও নয়।
হিরো সুজাকুও নয়। সেও ব্যক্তিগত আবেগের বশবর্তী হয়ে আনুগত্য পাল্টেছে বারংবার। একজন ন্যাশনালিস্টের চোখে সুজাকু রাজাকার, একজন অ্যানারকিস্টের চোখে সুজাকু অ্যান্টিহিরো, একজন ইউটোপিয়ানিস্টের চোখে সুজাকু হিরো।
—
লেখক ও পরিচালকের উদ্দেশ্য ছিলো মূল দুই ক্যারেক্টারের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অন্তর্দ্বন্দ্ব তুলে ধরা।
স্যালুট দিয়ে বলতে হবে, তারা দারুণভাবে সফল।
—
তবে মেকিং এ কিছু ত্রুটি ছিল। কিছু দৃশ্যের ব্যাখ্যা না চাইতেই গরুর রচনা পেশ করা হয়েছে, কিছু দৃশ্য গ্যাপ দিয়ে দেখিয়ে দর্শকের কল্পনাশক্তির উপর ভরসা করা হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে খুঁটিনাটি বিষয়গুলি লক্ষ্য করতে পছন্দ করি – তাও আমার কাছে রোলো, ভিলেটা আর জিরোর চুক্তির ব্যপারটা ঝাপসা – কোত্থেকে হুট কী হয়ে গেল। এরকম উদাহরণ আরো দেয়া যাবে।
আবার গল্পের উত্তেজনা যখন তুঙ্গে, হটাৎ করেই কাহিনীর রেশ চেপে ধরে ধীরে ধীরে এগোনো হয়েছে। এইরকম ছন্দপতনগুলি পছন্দ করতে পারিনি। সবচেয়ে বড় উদাহরণ হবে প্রথম সিজনের শেষ এবং দ্বিতীয় সিজনের শুরুর সময়টা। এতই বিরক্ত হয়েছিলাম, কোড গিয়াস দেখা বন্ধ করে অ্যাটাক অন টাইটান দেখতে বসেছিলাম।
—
তবে এসব ট্রিভিয়াল ব্যপার ওভারলুক করতে রাজী আমি। অন্তত সম্পূর্ণ সিরিজ শেষ করার পর সেটার আফটার ইফেক্ট হিসেবে যে ঘোরের ভীতর ছিলাম, তার জন্যে হলেও। খুব বেশি মোশন পিকচার দর্শককের অবচেতনকে আপন করে নিতে পারে না। এইটুকু ক্রেডিট দিতেই হবে কোড গিয়াসকে।
—
আমার রেটিং ৮.৭/১০