FLAG!(2009)
★★★★☆
[ইংলিশ ডাব]
অরিজিনাল নেট অ্যানিমেশন
জনরাঃ ওয়ার ড্রামা, মিলিটারী
প্রযোজকঃ দ্য অ্যান্সার স্টুডিও (Garden of Words, Golgo 13)
মূল ও পরিচালনাঃ রিওস্কে তাকাহাশি (Gasaraki, The Cockpit)
সেন্সরঃ সরাসরি ভায়োলেন্স অনুপস্থিত
মাইঅ্যানিমেলিস্ট রেটিংঃ ৭.৩৬(#২০২৬)
গৃহযুদ্ধ-বিদ্ধস্ত উদিয়ানা(Uddyana). একে অনেকটা মধ্যপ্রাচ্য আর দক্ষিণ এশিয়ার সংকর বলা যায়। একপাশে দিগন্ত বিস্তৃত মরুভূমি আর বেদুঈনদের বাস, আরেকদিকে চারিদিক ঘেরা সুউচ্চ পাহাড়ের খাঁজে গড়ে ওঠা এর প্রধান শহর সুবাশি(Subasci) – আর তার মানুষ – সনাতন আর বৌদ্ধ ধর্মের মিশেলে এক ধর্মের অনুসারী যারা, আর তাদের প্রার্থণার বড় একটা অংশ জুড়েই হয়তো বা ছিলো চলমান যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে রেহাই পাওয়ার ব্যগ্র কামনা।
সায়াকো শিরাসু – জাপানী অনুসন্ধানী চিত্র-সাংবাদিক – তরুণী। যুদ্ধের কারণেই উদিয়ানায় পা রাখা তার, জ্যেষ্ঠ আর অভিজ্ঞ কেইচি আকাগির সাথে।তারপর হঠাৎ যখন বিক্ষোভের উত্তাল এক মূহুর্তে তার তোলা বিপ্লবীদের হাতে উড়ন্ত UNF(জাতিসংঘ)-এর পতাকার এক ছবি হয়ে দাঁড়ালো উদিয়ানার শান্তিচুক্তির শক্ত হাতিয়ার, পুরো জাতির আশার প্রতীক, তখন খুব দ্রুতই শিরাসুর জীবনের মোড় ঘুড়ে গেল। সে পেয়ে গেল নায়োকোচিত(নায়িকাচিত?) সংবর্ধনা, আর আন্তর্জাতিক খ্যাতি। কিন্তু চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার আগেই অপহৃত হলো সেই বিখ্যাত পতাকা। UNF থেকে তৈরি করা হল গোপন এক মিলিটারী ইউনিট, একমাত্র লক্ষ্য – শান্তিচুক্তির আগেই সেই পতাকা পুনোরুদ্ধার। আর সেই পতাকার সাথে তার যোগসূত্র থাকায়, অনেকটা মাসকট হিসেবেই শিরাসুকে জুড়ে নেওয়া হল এই দলে। তার সু্যোগ মিললো পুরো অপারেশনটা ক্যামেরাবন্দী করার। আর চিরদিনের জন্য একটি জাতির কিংবদন্তীর অংশ হওয়ার।
পলিটিক্যাল ড্রামা অ্যানিমে তুলনামূলক কম হলেও, একেবারে কম না। কিন্তু এক্ষেত্রে FLAG এর বিশেষত্ব হচ্ছে তার গল্পের প্রেক্ষাপট, বাস্তব-বিশ্বের সাথে রিলেটেবলিটি আর অবশ্যই এর গল্পবর্ণনার পারস্পেরক্টিভ। আর এখানে এর কৌশলগত বিশেষত্বও। FLAG-এর পুরোটাই তার দুই মূল চরিত্র সাংবাদিকের চোখ দিয়ে দেখানো, এবং সেটা আক্ষরিক অর্থেই – FLAG হলো (সম্ভবত) প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র “Found Footage” টিভি অ্যানিমে। অ্যানিমেশনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য এক কীর্তি বলেই মনে হবে! কিন্তু সত্যি সত্যি-ই, FLAG-এর ২০ মিনিট ব্যপ্তীর পুরো ১৩ পর্ব ধরে দেখানো প্রতিটি মূহুর্ত হয় তার চরিত্রদের তোলাঃ স্থিরচিত্র বা ভিডিও অথবা কম্পিউটার পর্দায় চলা কোন ফাইল অথবা হেলিকপ্টার, সমরযন্ত্রের ভেতর-বাইরের ক্যামেরায় বন্দী হওয়া দৃশ্য – যেগুলো কখনো কখনো কেবলই একগাঁদা স্থিরচিত্রের মনটাজ, কখনো বা সম্মুখসমরে চলা রুদ্ধশ্বাস কোন দৃশ্য, আবার কখনো বা দুপুরের ব্যস্ততার সময়টায় মিলিটারী ক্যাম্পের রাঁধুনীর একান্ত সাক্ষাৎকার।
“Found Footage” কায়দাটা “সত্যিকারের” ক্যামেরায় কাজে লাগানো যতটা সহজ, অ্যানিমেশনে ততটাই কঠিন, যেহেতু অ্যানিমেশন বানাতে কোন ক্যামেরা লাগেনা। সাধারন ক্ষেত্রে ক্যামেরার বিভিন্ন বিষয়গুলো খুব দ্রুত এবং সহাজাতভাবেই হয়, সেখানে অ্যানিমেটরদের তা প্রতিটি ফ্রেমেই আলাদাভাবে ফুটিয়ে তুলতে হয়েছে। এটেনশন টু ডিটেইলস হাঁ করে দেওয়ার মত। FLAG-এর “পাওয়া ফুটেজ”-গুলো কেবল এক কোনায় “REC” আর আরেক কোনায় সময়-তারিখ দিয়েই শেষ হয়ে যায়নি, এর ক্যামেরাগুলো গল্পের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখানে ক্যামেরাগুলো হঠাৎ সূর্যের আলোতে তাক করলে পর্দা অন্ধকার হয়, জুম-ইন আর জুম-আউটের সময় ঘোলাটে হয়ে যায়, বাহকদের কাঁপা কাঁপা হাতের সাথে তারাও নড়তে থাকে। অধিকাংশ সময়ই ফার্স্ট পারসন ভিউ থেকে দেখানো, শটগুলোও অনেক সময় দীর্ঘ আর আনকাট। আর একারণেই গল্পের দুই মূলচরিত্র শিরাসু আর কেইচির স্ক্রিনটাইম খুবই নগন্য। আমরা তাদের হাতে ধরা ক্যামেরার সাথেই পুরো উদিয়ানা চষে বেড়াই।
FLAG এর গল্প দুটো – সমান্তরালে চলা – শিরাসু আর কেইচির। শিরাসুর উপস্থিতি মিলিটারী ক্যাম্পের ভেতরে, যা আপাত নিরস, নির্মোহ সৈন্যদেরও – যাদের কাজই হচ্ছে মানুষের প্রাণ নেওয়া, সেটা সন্ত্রাসবাদ রুখতে কোন পরিকল্পিত আক্রমনের বলী চরমপন্থীই হোক, বা কোন “অঘটনে্র শিকার” সাধারণ মানুষে – মানবীয় দিক উপস্থাপনের প্রয়াস। আমরা শিরাসুর সাথে ঘুরে বেড়াই মিলিটারী ক্যাম্পের ব্যারাক, তার রান্নাঘর, তার পরিকল্পনা রুমে – আমরা তার সাথে হেলিকপ্টারে চড়ি, বেদুঈনদের সাথে দিন কাটাই, মধ্যরাতের রোমাঞ্চকর সব মিশনের সঙ্গী হই। আবার যুদ্ধ-রাজনীতির বিশাল বিস্তৃত সাদা-কালো ঘর করা ছকে ধীরে ধীরে সৈন্য শ্রেনীর গুঁটি হিসেবে আটকা পরি, আর বাকিদের মত।
শিরাসু যেখানে বাইরের বিশ্ব থেকে বিযুক্ত, সেখানে কেইচি বরং সুবাশিতে আমাদের ভ্রমণসঙ্গী। আমরা তার সাথে পৌছাই বেজমেন্টের এক ক্যাফেতে যেখানে সব ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকদের আসর বসে, অথবা জ্যোৎস্না রাতে দেখে আসি উদিয়ানার শতাব্দী প্রাচীন এক ধর্মীয় আচার, কিংবা হতবিহবল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি সদ্য বোমা-বিদ্ধস্ত এক নগরীর ধ্বংসস্তুপে। কেইচি আমাদের ন্যারেটর। সে উদিয়ানার ইতিহাস সম্পর্কে জানায়, তার ঐতিহ্য সম্পর্কে জানায় – আর আমরা যখন উদিয়ানার এই সমৃদ্ধ ইতিহাস আর তার প্রাণবন্ত ঐতিহ্য সম্পর্কে জানি – তা কোন অংশেই “ফিকশনাল” মনে হয় না। যেন পৃথিবীর মানচিত্র ফুঁড়ে বের হওয়া জীবন্ত কোন দেশ। উদিয়ানার বারুদের গন্ধ ভেসে বেড়ানো বাতাস আর এর রক্তভেজা পাহাড়, চারিদিক ছড়িয়ে থাকা এর মিথোলজি আর তার মানুষের জীবন-দর্শন, তাদের অনিশ্চয়তায় ঘেরা বর্তমান আর আশায় বুক ভরা ভবিষ্যতের সাথে আমরা একাকার হই।
“Now we are out of place in our own home,” কেইচি সেইসব মানুষের ছবি তুলে, তাদের গল্প শুনে। “You take our pictures and go home. But we have to stay here and live through all of this. Because this is the only place we can stay.” তাদের মুখে লেগে থাকা স্মিত হাসির গভীরে দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়। লুকিয়ে রাখা সেইসব ক্ষত জট পাকিয়ে বেরিয়ে আসে, দুই পাহাড়ের মাঝখানে অস্ত যাওয়ার সূর্যের ক্ষনিক আভায় দ্যুতি ছড়ায়। কেইচির ক্যামেরায় আটকা পরে যুদ্ধের রেখে যাওয়া ধ্বংসলীলা।
ইংলিশ ডাবের ভয়েস অ্যাক্টিং সহজাত। আর্ট আর অ্যানিমেশন চমৎকার। এমনকি থ্রিডি অ্যানিমেশনও আর বেশিরভাগ অ্যানিমের চেয়ে ভালো। আর সবকিছুর মতই এর ক্যারেক্টার আর মেকা ডিজাইনও বাস্তবস্মত। যুদ্ধযন্ত্রগুলো এক লাফে দশ ফুট উঠে যায় না, আকাশে ভেসে বেড়ায় না। বরং যখন নতুন তাতে নতুন এক রাইফেল লাগানোর পরিকল্পনা করা হয়, তখন বেশ কঠিন অংক কষেই তার পরিমার্জন করা হয়। তাদেরও দূর্বলতা, সীমাবদ্ধতা আছে। তারা পদার্থবিজ্ঞানে সূত্র মেনেই চলে। মেকা অ্যাকশন দৃশ্য হাতে গোনা এবং সাধারণ, বরং এর ক্যারেক্টার ড্রামাই গল্পের মূল আকর্ষন।
এর চরিত্ররদের মুভমেন্ট, ফেস এক্সপ্রেশন বাস্তবসম্মত না হয়েও বাস্তবসম্মত – সর্বদাই ক্যামেরা সামনে থাকায়, সেলফ-অ্যাওয়ার হওয়ায়, আলাদা একটা অস্বস্তি, জড়তা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আর এখানেই মূলত FLAG ভালো লাগা, না-লাগার ব্যাপারটা এসে যায়। এর গল্প যতই আকর্ষনীয় হোক, ন্যারেটিভ স্টাইলকে কোনভাবেই অগ্রাহ্য করা যায় না। তার চরিত্রগুলোর মতই ক্যামেরার উপস্থিতি সবসময়ই আমাদের চোখে লেগে থাকে। তার সাথে মানিয়ে নিতে না পারলে ১৩ পর্ব ধরে বসে থাকার মত ধৈর্য্য হওয়ার কথা না। FLAG-এর পেসিং ধীরগতির না হলেও, তখন সেটা “বোরিং” লাগাই স্বাভাবিক।
FLAG অনুসন্ধানী-সাংবাদিকতার প্রতি প্রেমপত্র। একে অ্যানিমেটেড স্যুডো-ডকুমেন্টারি বলা যায়, অথবা তার চেয়েও বেশি বলা যায় কোন ভবিষ্যৎ ডকুমেন্টারি বানানোর পেছনের গল্প – তার কাঁচামাল ইমেজ আর ভিডিওর সমাহার মাত্র। সেই ডকুমেন্টারি আদৌ বের হয় কিনা আমাদের জানা সম্ভব না। কারণ FLAG-এর কাহিনী অসমাপ্তই থেকে যায়। পৃথিবীর বুকে চলতে থাকা বর্তমান সব যুদ্ধের মতই কি না?