Made in Abyss Movie 3: Dawn of the Deep Soul [শর্ট রিয়েকশন] — Shifat Mohiuddin

মেইড ইন অ্যাবিস বের হয়েছিল সেই তিন বছর আগে, ২০১৭ সালে। দেখেছিলাম সেই বছরেই, তিন বছর পরে যখন এই সিকুয়েল মুভিটা দেখতে বসলাম তখন দেখা গেল এনিমের ভেতরকার অনেক তথ্যই ভুলে বসে আছি।
তবে এতদিন পরে সিরিজটার সংস্পর্শে যাওয়ার পরেও বুঝতে সমস্যা হয় নি তেমন। মুভিটাতে ফিফথ লেয়ারে পৌছানোর পর রিকো আর তার গ্যাংয়ের ফিফথ লেয়ারের sovereign ব্নড্রেডের সাথে কাহিনী দেখানো হয়েছে, যে জিনিসটাকে সিরিজের শেষ পর্বগুলাতে দারুণভাবে বিল্ডআপ করা হয়েছিল।
তো তিন বছর অপেক্ষার পর এই বিল্ডআপ বৃথা যায় নি। মুভিটা সিরিজের নান্দনিকতাকে ধরে রাখতে পেরেছে পুরোপুরি। অ্যানিমেশন খুবই ভাল ছিল, সিরিজে প্রথম দিকের লেয়ারগুলায় তাদের অ্যাডভেঞ্চার দেখানোতে সবুজের অনেক অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু এই ফিফথ লেয়ার মারাত্মক কর্কশ একটা জায়গা, প্রাণের ছিটেফোঁটা সেখানে অল্পই আছে। তো পরিবেশ এভাবে বদলে যাওয়ার পরেও Kinema Citrus তাদের মুন্সিয়ানা ঠিকই দেখিয়েছে।
সাউন্ডট্র্যাক আগের মতই সেরা ছিল। কেভিন পেনকিনের জাদু আবার টের পাওয়া গেছে, শিল্ড হিরোতে জিনিসটা পাই নি তেমনভাবে। সিরিজের আগের ওএসটি Hanezeve কে আরো এপিকভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। আর যে মুহূর্তে ট্র্যাকটা বাজানো হয়েছে সেটার আর কথা আর নাই বললাম।
সবশেষে আসি কাহিনীতে। এখানে কিছু বললেই স্পয়লার হয়ে যাবে। তবে এটুকু আশ্বাস দিতে পারি দর্শকরা সিরিজ দেখে যে অনুভূতিগুলার ছোঁয়া পেয়েছিলেন সেই অনুভূতিগুলো মুভিটাও আপনাদের সরবরাহ করবে। MIA এর ট্রেডমার্ক কাহিনীর হুট করে ডার্ক টার্ন নেয়াটা এখানে একেবারেই শুরু থেকে আছে। রিকো-রেগু-নানাচিদের সাথে আপনিও হাসবেন আর কাঁদবেন মুভি দেখার সময়।
১০ এ সলিড ৮.৫ দিলাম মুভিটাকে ব্যক্তিগত জায়গা থেকে। ৯ দিতাম যদি কাহিনীটা আরেকটু কম প্রেডিক্টেবল হতো।
দারুণ ব্যাপার হলো ১০৪ মিনিটের এত দারুণ একটা সিকুয়েলের পরেও সিরিজটার সাসপেন্স একটুও কমে নি। অ্যাবিসের রহস্য যেন শেষ হওয়ার নয়, মুভি শেষ হওয়ার পর আপনার মনে প্রশ্নের সংখ্যা না কমে বরং বাড়বে। এত এত রহস্য রেখে যায় বলেই সিরিজটার জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করা স্বার্থক।
 

উচিয়াগে হানাবি ও কিছু অসংলগ্ন চিন্তাভাবনা — Shifat Mohiuddin

Uchiage Hanabi, Shita kara Miru ka? Yoko kara Miru ka?
 
Warning! পুরো পোস্টটাই একটা স্পয়লার।

উচিয়াগে হানাবি ও কিছু অসংলগ্ন চিন্তাভাবনা:
 
উচিয়াগে হানাবি মুভিটা আমি দেখেছিলাম সেই ২০১৮ সালে। বের হওয়ার পর যখন নেটে আসলো তার পরপরই দেখেছিলাম বলা চলে। দেখার পর স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম দেড় ঘন্টা সময় নষ্ট ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে কেন এতদিন পরে পুরনো জিনিসকে টেনে আনা!
কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখলাম মুভিটার সাথে আমার কোন এক ধরণের আত্মার সংযোগ রয়েছে। হ্যাঁ, সিরিয়াসলিই বলছি। এনিমের সাথে আত্মার সংযোগ হওয়া সম্ভব আসলেই। এখন আপনারা একে নিছক উইবগিরি বলে উড়িয়ে দিতে পারেন, আমি বিতর্কে জড়াবো না কোন।
উচিয়াগে হানাবি নোরিমিচি ও নাজুনা নামের দুই কিশোর-কিশোরীর কাহিনী। কাহিনী না বলে কল্পনাও দাবি করা যেতে পারে। পুরো মুভিটাতে ফ্যান্টাসি আবহ শুরু থেকেই ছিল। এরকম ফ্যান্টাসির আবহ ক্লানাড নামের এনিমেটাতে দেখেছিলাম তবে সীমিত আকারে। উচিয়াগে হানাবিতে ফ্যান্টাসি মাধ্যমের উপূর্যপুরি ব্যবহার ছিল বারবার, ফলে মারাত্মক জগাখিচুড়িতে পরিণত হয়েছিল মুভিটা। বাস্তবতা আর কল্পনার ফারাক ধরতে গিয়ে যদি মুভিই শেষ হয়ে যায় তাহলে উস্মা প্রকাশ করাটাই স্বাভাবিক।
শুরুতেই একগাদা অভিযোগ করে ফেললাম। এখন উচিয়াগে হানাবির সাথে আমার নাড়ির টান কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো সেই আলোচনায় আসি।
উচিয়াগে হানাবির সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে এর ইউটোপিয়ান ভিশনের মধ্যে। কমবেশ সব স্লাইস অফ লাইফ, রোমান্টিক এনিমেই ইউটোপিয়ান। এই জনরার এনিমেগুলো বেছে বেছে আমাদের জীবনের ইতিবাচক স্লাইসটাকেই পর্দায় তুলে আনে। বাস্তব জীবনের দুঃলহ-দুর্দশা তুলে ধরার চেষ্টা যে একদুইটা হয় না তা না, তবে বেশীরভাগ প্রদর্শনীই হয় মধুমাখা। কেন জানি ইনজাস্টিসে জর্জরিত এই দুনিয়ার সাথে এনিমের দুনিয়াকে মেলাতে পারি না।
 
উচিয়াগে হানাবি সম্ভবত এই কারণেই স্পেশাল যে এতে ইউটোপিয়ান উপাদানের পরিমাণ এতই বেশী যে দর্শকরা ঠিকভাবে এর সাথে মানসিক সংযোগই স্থাপন করতে পারে নি। একে অপরের হাত ধরে জাপানের কোন এক মফঃস্বল থেকে দুই কিশোর-কিশোরীর পালাতে চাওয়াটা ছিল ইউটোপিয়া তৈরির প্রথম ধাপ। নোরিমিচি আর নাজুনা দুজনেই কিন্তু বাহিরের কঠিন দুনিয়া সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। আবার নোরিমিচির জীবনে নাজুনার আগমনও অপ্রত্যাশিতভাবে। তার উপর সাঁতারের সময় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়া ইত্যাদি আসলে শুরু থেকেই মুভিটার চরম অবাস্তবতার দিকে ধাবিত হওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছিলো। খেয়াল করা উচিত, মুভিটা কিন্তু কিশোর মানসিকতাকে আঁকড়ে ধরে বানানো। সেজন্য কিশোর নোরিমিচির চোখে কিশোরী নাজুনা সবসময়েই রহস্যের এক ভাণ্ডার। নাজুনা আকৃতিতে নোরিমিচির চেয়ে দীর্ঘাকৃতির। পুরুষ হিসেবে বলতে পারি ছেলেবেলায় ড্রিমগার্লরা এভাবেই আমাদের মানসপটে এসে জায়গা করে নিতো। তন্বী দেহই ছিল আমাদের অনেকের আদর্শ নারীর উদাহরণ। তুলনামূলক নাতিদীর্ঘ আকৃতির মেয়েরাও যে পূজনীয় হতে পারে তা তো পরে ইস্ট এশিয়ান কালচার হাতে-কলমে শেখালো!
 
নোরিমিচির মতো কিশোরকালে মিশুক মেয়েদের দিকে মন ঝুঁকে থাকতে চাইতো বেশী। মুভিতে খেয়াল করলে দেখা যায় নাজুনা বেশ বাঁচাল প্রকৃতিরই। নোরিমিচির দ্বিগুণ কথা সে নিজেই বলেছে বলা যায়। সে কথার টানেই কিন্তু নোরিমিচি সিদ্ধান্ত নিল বাসা থেকে পালাবে।
 
মুভির সবচেয়ে সুন্দর জায়গার একটা ছিল সাইকেলের পেছনে নাজুনাকে বসিয়ে নোরিমিচির ঢালু পথ বেয়ে নেমে যাওয়া। দৃশ্যটা দুটো জায়গার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল এক মুহূর্তে:
১। Whisper of the heart মুভির একেবারে শেষে ভোরে নায়ক-নায়িকার সাইকেলে চড়ে কাটানো সময়।
২। মুহাম্মদ জাফর ইকবালের ‘রাজু ও আগুনালির ভূত’ নামের কিশোর উপন্যাসের একেবারে শেষে ১১০ সিসি হোন্ডা বাইকে করে রাজু আর শাওনের পালিয়ে যাওয়া।
 
এই যে সাত-পাঁচ না ভেবে বাসা থেকে পালানোর মত ভয়ানক সিদ্ধান্ত নেয়ার যে তড়িৎ ক্ষমতা, অনেকে একে অদূরদর্শীতা বললেও আমি একে বয়ঃসন্ধিকালের সবচেয়ে বড় শক্তি বলবো। হাইস্কুলের কিশোর নোরিমিচি নাজুনাকে নিয়ে যে অবাস্তব স্বপ্ন দেখেছিল তা সে নিশ্চয়ই বিশ পেরিয়ে গেলে এত সহজে নিতে পারতো না। নাজুনাও সাহস যোগাতে পারতো না কোথাকার এক অর্ধপরিচিত ছেলের হাত ধরে টোকিওর মত বিশাল শহরে যাওয়ার।
কথা প্রসঙ্গে নাজুনার মনস্তত্ত্ব নিয়ে কিছু বলি। শ্যাফটের অ্যানিমেশনের কারিগরির কারণে তাকে প্রথম দিকে খুবই দুর্বোধ্য মনে হচ্ছিল। এতদিন পরে আস্তে আস্তে তাকে কিছুটা হলেও উপলদ্ধি করতে পেরেছি। নাজুনাও আসলে বয়ঃসন্ধি কালের অস্থির সময়ের এক প্রতিনিধি। পরিবারের শেকল ভেঙে সে কিছু দিনের জন্য হলেও বাঁধনহারা জীবন উপভোগ করতে চায়। প্রবল ইচ্ছে থাকার পরেও নানা বাঁধার কারণে কাজটা করতে পারছিল না সে। নোরিমিচিকে সঙ্গী করার মাধ্যমে সে শেষমেষ নিজেকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করতে পারে কাজটা করার। আমার মতে নাজুনার সম্পূর্ণ আবেগে বয়ঃসন্ধিকালের আধাআধি বেড়ে উঠা যৌন চেতনার কোন প্রভাব ছিল না। পুরো ব্যাপারটাই ছিল তার কাছে কৌতুহলের খেলা। টোকিওতে গিয়ে সে কিভাবে নিত্য প্রয়োজনের যোগাড় করবে তার দুশ্চিন্তা বিন্দুমাত্র তার মাথায় ছিল না। সম্ভবত নোরিমিচিকে আশ্বাস দেয়ার জন্য সে কাজ খোঁজার কথা বলেছিল।
 
তবে ট্রেনের বগির ভেতরে আমরা নাজুনার চিন্তার আরেকটা পিঠ দেখতে পাই। Ruriiro no Chikyuu গানটা গাওয়ার সময় নাজুনা নিজেকে রাজকুমারী হিসেবে কল্পনা করে। সে কল্পনা করে নোরিমিচি রাজপুত্র বেশে তাকে রথে করে অনেক অনেক দূরে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে। শ্যাফটের অপূর্ব অ্যানিমেশন কিশোরী মস্তিষ্কের নিউরনের প্রতিটি স্পন্দনকে পিক্সেলে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করেছে এই জায়গাটাতে। নির্ভেজাল আবেগমেশা এই মুহূর্তগুলো তখন স্পর্শ না করলেও এখন হৃদইয়ে দাগ কাটতে সমর্থ হয়েছে।
নোরিমিচির জীবনে নাজুনার আগমনের মত করে আমাদের জীবনে কারোর আসার প্রশ্নই আসে না। তবে এর কাছাকাছি অনুভূতি নিশ্চয়ই অনেকেই নিয়েছেন কল্পনায় অথবা বাস্তবে। আমি আমার কিশোরকালের ব্যক্তিগত একটা ঘটনার বিবরণ দিচ্ছি প্যারালাল টানার জন্য:
 
২০১১-২০১২ সালের দিকে প্রচুর হংকংভিত্তিক মার্শাল আর্টস সিনেমা দেখা হতো। সেসব সিনেমায় নায়িকারা থাকতো চরম অবলা, নায়করা উদ্ধার না করলে তারা কিছুই করতে পারতো না। damsel in distress ই ছিল আমার কাছে নারীর একমাত্র সংজ্ঞায়ন, femme fatale বলতে যে কিছু আছে তা জানতাম না তখন!
স্কুলের একটা মেয়েকে বেশ ভাল লাগতো তখন। যদিও মুখ ফুটে কখনো বলা হয়ে উঠে নি। সে মেয়েটা আবার এলাকায় নতুন আসায় রাস্তাঘাট চিনতো না একদম। পাশাপাশি পাড়াতেই ছিল দুজনের বাসা।
ঘটনাক্রমে একদিন রাত নয়টার দিকে বাসা থেকে বের হওয়ার পর রাস্তার মোড়ে দেখা! মফঃস্বল এলাকায় রাত আটটা বাজলেই তখন ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। তার উপর লোডশেডিং চলছিল। জানতে পারলাম আত্মীয়ের বাসা থেকে ফেরার পথে পথ হারিয়ে ফেলেছে! এলাকার ছেলে হওয়ায় অনায়াসেই বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যেতে পেরেছিলাম। কিছুদিন আগেই The Karate Kid দেখায় নিজের উপর নিজেরই ভক্তি বেড়ে গিয়েছিল!
 
এই মেলোড্রামাটিক ঘটনার রেশ আমার উপর মাসখানেক ছিলো। তখন যদি নাজুনার মত আমাকে বলা হতো পালিয়ে যেতে, অনায়াসেই পনের বছরের আমি দু-চোখ যেদিকে যায় সেদিকে চলে যেতাম। যে চিন্তা ও কাজ উভয়ই এই বিশোর্ধ্ব নাগরিক আমার দ্বারা কোনভাবেই সম্ভব হতো না। অগ্রীম নানারকম দুশ্চিন্তার বেড়াজালে আটকে শেষমেষ ইতস্ততই করতাম। নোরিমিচি কিন্তু এই দ্বিধায় ভুগে আটকে থাকে নি, ঐ বয়সে আমিও অত ভাল-মন্দের ধার ধারতাম না।
 
উচিয়াগে হানাবি বয়ঃসন্ধি কালের এই অপার সম্ভাবনাকে সেলিব্রেট করে। একই সাথে মুভিটা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সীমাবদ্ধতাকে ফ্যান্টাসির বর্শা দিয়ে বিদ্ধ করতে চায়। মরবিড চিন্তাভাবনার এ জায়গাটাতেই মুভিটার সার্থকতা আমার মতে। তবে তারমানে এই নয় যে এই দিকগুলো অন্য কোন এনিমের চেয়ে অনেক বেশী ভাল দেখিয়েছে। দিনশেষে প্রচন্ড সীমাবদ্ধতা থাকা একটা মুভি উচিয়াগে হানাবি। তবে কিছু জিনিস থাকে যার শত ক্রুটি থাকার পরেও মনের মধ্যে আলাদা একটা আবেদন থাকে, উচিয়াগে হানাবি আমার জন্য সেরকম একটা এনিমে।
 
দ্রষ্টব্য: জাফর ইকবাল পরবর্তীতে ‘রাতুলের রাত রাতুলের দিন’ নামে একটা বই লিখেছিল। এটাও কিছুটা এই ঘরানার হলেও আগুনালির মত হতে পারে নি মোটেই। চরিত্রগুলা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়াতেই সম্ভবত গল্পটা মাঠে মারা গিয়েছিল। আগুনালির মত গল্পের সাজেশন চাচ্ছি সবার কাছে।

Beastars [রিভিউ] — Shifat Mohiuddin

এই উপমহাদেশের লোকগল্পের একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এতে প্রচুর পরিমাণে anthropomorphic চরিত্র ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের জীবনের নানা কাহিনীর বর্ণায়ন করা হয়। ছোটবেলায় শেয়াল পণ্ডিত আর কুমিরের বাচ্চাদের সেই কাহিনী শুনে নি এমন কেউ বোধহয় নেই। এই গল্পে পশুপাখির মাধ্যমে যেভাবে মানব চরিত্রের নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে সেটাকেই anthropomorphism বলে। লোকগল্পে এই উপাদানটার ব্যবহার বেশ পুরনো। অনেক অনেক আগের পঞ্চতন্ত্রে যেমন এর ব্যবহার আছে, আমাদের সুপরিচিত ঠাকুরমার ঝুলিতে আম-সন্দেশ নামের একটা অধ্যায়ই আছে পশুপাখির মাধ্যমে বলা রূপকথাগুলো নিয়ে। আধুনিক সাহিত্যেও এর ব্যবহার আছে। লর্ড অফ দ্যা রিংসের কথা উল্লেখ করা যায় আর জর্জ অরওয়েলের অ্যানিমেল ফার্মের কথা তো সবারই জানা।

তো জাপানিজ পপ কালচারে জিনিসটা যেভাবে ব্যবহার করা হয় সচরাচর তাকে আর যাই হোক সুশীল কিছু বলা যায় না। ইন্টারনেটে furry কমিউনিটির কার্যকলাপ অনেক দেখা যায়, তা নিয়ে আমার কোন আপত্তি নেই। অন্যকে বিরক্ত না করে সবাই যার যার আগ্রহের জিনিস চর্চা করা মোটেই খারাপ কিছু নয়।

তো এই গতানুগতিক ধারায় একটা নতুন হাওয়া নিয়ে আসা এনিমের নাম Beastars. সিরিজটা একই নামের একটা মাঙ্গা থেকে অ্যাডাপ্ট করা হয়েছে। সেই ২০১৬ সাল থেকে মাঙ্গাটা চলছে, অথচ এতদিন এটা নজরেই পড়ে নি কখনো।

বিস্টার্সের দুনিয়া আমাদের দুনিয়ার মতই এক দুনিয়া যেখানে পশুপাখিরা মানুষের মত সামাজিক জীবনযাপন করে। মানবসমাজে সাধারণত যা দেখা যায় তার সবই আছে সেখানে শুধু মানুষই নেই। সেখানে নগর, বন্দর, সভ্যতা যা বলা যায় সবই আছে। এখানে পশুপাখি মানুষের মত নয়টা-পাঁচটা অফিস করে বাসায় এসে সন্তানের কপালে চুমু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তারা সুখ পেলে হাসে, দুঃখ পেলে কান্নাও করে। ধর্ম, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবগুলা superstructure ই সেখানে দারুণভাবে বিদ্যমান।

তবে মানবসমাজের হাজার বছরের পুরনো অভিশাপ বর্ণবাদ বিস্টার্সের দুনিয়াতে এখনও প্রবলভাবে নিজের আসন গেঁড়ে বসে আছে। বিস্টার্সের সমাজ মোটা দাগে তৃণভোজী ও মাংসাশী; এই দুই জাতিতে বিভক্ত। সমাজে কঠোর বিধিনিষেধ থাকায় এখানে তৃণভোজী আর মাংসাশীরা একই সাথে বসবাস করে। তারপরেও সর্বদা একটা অদৃশ্য টেনশন কাজ করে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে। মাংসাশীরা কোন একদিন নিজেদের মধ্যকার
শিকারী সত্ত্বার কাছে হার মানবে এই ভয়ে তৃণভোজী প্রাণীরা সবসময়েই তটস্থ থাকে।

সেই দুশ্চিন্তায় জ্বালানি যুগিয়ে দেয় এনিমের শুরুতেই ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা। তেম নামের এক মেষকে মৃত ও আধাখাওয়া অবস্থায় আবিষ্কার করা হয় চেরিংটন হাইস্কুলের অডিটোরিয়ামে। ধারণা করা হয় তেমের কোন মাংসাশী সহপাঠীই খুনটা করেছে। পুরো স্কুলে একটা আতংকের জোয়ার বয়ে যায়। তৃণভোজী প্রাণীরা রাত ও অন্ধকার এড়িয়ে চলতে শুরু করে আর তাদের মাংসাশী বন্ধুদের অবিরাম সন্দেহের চোখে রাখা শুরু করে।

তো এসব ঘটনার সাক্ষী চেরিংটন হাইস্কুলের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আমাদের প্রোটাগনিস্ট লেগোসি। এই স্কুলের সবাই ডরমিটরিতে থেকে পড়াশুনা করে। লেগোসি একজন নেকড়ে, লম্বা একহারা তার গড়ন; চালচলনে একজন স্বাভাবিক নেকড়ের পুরো উল্টো সে। ক্লাসের সবাই লেগোসিকে ধোয়া তুলসি পাতা বলেই জানে, কারোর সাত-পাঁচ কোনটাতেই নেই সে। তেম নামের সেই মেষ ছিল ড্রামা ক্লাবে তারই ক্লাসমেট, তাই মানসিকভাবে সেও কিছুটা মুষড়ে পড়ে।
তার পরের দিনই লেগোসির জীবনে একটা মারাত্মক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যায়। ড্রামা ক্লাবের একটা কাজের জন্য সে যখন ক্যাম্পাসে রাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে তখন তার চোখে একাকী এক খরগোশকে চোখে পড়ে। দেখামাত্রই চকিতে তার মধ্যের শিকারী মনোভাব জেগে উঠে। সারাজীবনেও সে যে কাজ করার কথা ভাবে নি সে তাই করে বসে, প্রচণ্ড এক লাফে সে সেই খরগোশটার উপর ঝাপিয়ে পড়ে…

থিমের দিক দিয়ে চিন্তা করলে বিস্টার্স অসাধারণ একটা গল্প। সুক্ষ্ম ও স্থূল, দুই ভাবেই এখানে এই এনিমেতে বর্ণবাদের নানা দিক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। শ্রেণী বৈষম্যকে পশুপাখির মাধ্যমে বেশ বাস্তবভাবে তুলে ধরা হয়েছে এই এনিমের গল্পে। আধুনিকায়ন যে আসলে আদিম সমাজের শিকারী ও শিকার মনোভাবকে দমিয়ে রাখতে পারে না তার সুন্দর চিত্রায়ণ ঘটেছে এই এনিমেতে। টুকরো টুকরো অনেক জায়গা আছে বিস্টার্সে যা আসলে মানবসমাজের অনেক অস্বস্তিকর বাস্তবতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এর ফলেই বিস্টার্স পরিণত হয়েছে একটা দারুণ সাইকোলজিকাল এনিমেতে। এখানে হাইস্কুলের একগাদা ছাত্র-ছাত্রীদের মাধ্যমে পুরো সমাজব্যবস্থাটাকেই সুনিপুণভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই জায়গায় মাঙ্গাকার প্রশংসা করতেই হবে, এরকম ভিন্নধর্মী চিন্তাভাবনা সচরাচর দেখা যায় না। কিশোর-কিশোরীরা গল্পের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় coming-of-age স্টোরি হিসেবেও বিস্টার্সকে অনবদ্য মনে হয়েছে আমার কাছে।

বিস্টার্সের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক নিঃসন্দেহে এর চরিত্রগুলো। এখানে মাঙ্গাকার প্রশংসা করে কুলানো সম্ভব নয়। তিনি রীতিমতো বাধ্য করেছেন আমাদের চরিত্রগুলোকে মানুষের মত বিবেচনা করতে। কল্পনাশক্তি ও বাস্তবতাবোধের পরিমিত মিশ্রণ না ঘটাতে পারলে বিস্টার্সের চরিত্রগুলো এত ইন্টারেস্টিং হতো না। নানা দ্বন্দ্বে ভোগা লেগোসি, জীবনের কোন অর্থ খুঁজে না পাওয়া খরগোশ হারু, অতি উচ্চাভিলাষী হরিণ লুই; এই তিনটি ক্যারেকটারের আচার-আচরণ যেন আমাদের জীবনের পাতা থেকেই তুলে আনা। ছোট ছোট চরিত্র যেমন লেগোসির কৌহাই আরেক নেকড়ে জুনো আর তার ড্রামা ক্লাবের ক্লাসমেটগুলো অনেক কম স্ক্রিনটাইম পেয়েও নিজেদের কাজ পুরোপুরি করতে সমর্থ হয়েছে। সাথে আছে বিপদের বন্ধু পান্ডা গিওর্নো-সান যে কিনা লেগোসির কমপ্লেক্স সাইকোলজির উপর আলোকপাত করতে সমর্থ হয়। চরিত্রগুলো একে অপরের প্রতি যে অনুভূতিগুলো ধারণ করে থাকে যেমন: লেগোসি-হারু-লুইয়ের ত্রিভুজ প্রেম দ্বন্দ্ব, বিলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা তৃণভোজীদের প্রতি ঘৃণা আর সে সুবাদে লুইয়ের প্রতিও সুপ্ত জিঘাংসা মনোভাব, জুনো আর হারুর মধ্যে লেগোসিকে ঘিরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা; এগুলো এত এত বাস্তব যে পশুপাখির মুখোশের আড়ালে যেন নিজেদের চেহারাই দেখতে পাই। শুধু নেতিবাচক ঘটনগুলোই মনে দাগ কাটে এমন নয়, কিছু ছোট ছোট ইতিবাচক ঘটনাও আমাকে দারুণ স্পর্শ করেছে। ব্ল্যাক মার্কেটে পথ হারানো লুই যখন শেষে দেখে তার মাংসাশী বন্ধু আওবা সৎবিৎ ফিরে পেয়ে তার মতই অন্ধকার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তখন লেগোসির মত আমিও সমান আনন্দিত হই এত এত আবর্জনার ভিড়ে এমন এক পদ্মফুল ফুটতে দেখে। আরেকটা ছোট গল্প খুব ভাল লেগেছিল, সেটা হল লেগোসির ক্লাসে তার পাশে বসা মুরগীর কাহিনী। এই মুরগীর মত মানবিক চরিত্র কমই আছে এই সিরিজে আর সেটা সে তার পাঁচ মিনিটের উপস্থিতিতেই বুঝিয়ে দিয়ে সক্ষম হয়েছে। মুরগীটা নিয়মিত উন্নতমানের ডিম পাড়ে যেন মাংসাশীদের পুষ্টির অভাব না হয় সাথে এটাও যেন না হয় যে মাংসাশীরা খাদ্যের অভাবে তাদের সুপ্ত প্রবৃত্তির কাছে হার না মেনে ফেলে। এরকম সর্বমুখী আদর্শবাদী কাজকর্ম সমাজে এখন বিরল।

বিস্টার্সের একটা বড় থিম হলো শিকারী প্রাণীদের শিকার করার প্রবৃত্তি ও তা নিবৃত্ত করার জন্য সমাজব্যবস্থার গ্রহণ করা নানা পদক্ষেপ। এই জায়গাটাতে এসে আমি চিন্তার খোরাক পেয়েছি অনেক। শিকার করা যদি মাংসাশীদের মজ্জার মধ্যে মিশেই থাকে তাহলে সেটাকে এভাবে নিয়মকানুন দিয়ে চাপিয়ে নিবৃত্ত করার চেষ্টাটা আসলে কতটা সফল? আমরা মানুষেরা এভাবে নানা বেড়াজালের মধ্যে ক্রমাগত আটকে থেকে আসলেই নিজেরাই নিজেদের বন্দী করে রাখছি, বিপরীতে অন্যান্য সৃষ্টিকুল নিজেদের প্রবৃত্তি দ্বারা পরিচালিত হয়ে একটা স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে; এরকম চিন্তা বিস্টার্স দেখে আবারও এসেছে আমার মাথায়। বিস্টার্সের দুনিয়ার নাগরিকরা মানুষের মত নিজেদের নানা নিয়মে আবদ্ধ রেখে এই অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে। আর এই অস্বস্তিকর পরিবেশে তৈরি হওয়া টেনশনকে দারুণভাবে কাজে লাগিয়ে মাঙ্গাকা এই ভাল ভাল গল্পগুলো উপহার দিয়েছেন আমাদের। এই জায়গায় আবারও মাঙ্গাকার ভূয়সী প্রশংসা করবো।

অ্যানিমেশনের প্রসঙ্গে আসি। কোন এনিমের সাথে সিজিকে এত সুন্দরভাবে খাপ খাওয়াতে খুব কমই দেখেছি বিস্টার্সের মত। দেখে মনে হয়েছে মাঙ্গাটা লেখাই হয়েছিল এভাবে থ্রিডি সিজিতে তৈরি করার জন্য। সিজির ব্যবহারে যে জড়তা তৈরি হয় অ্যানিমেশনে, সেটা ব্যবহার করে এনিমেটা আরো দশগুণ অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে। রটোস্কোপিক অ্যানিমেশনের কারণে যেমন আকু নো হানার এনিমে রীতিমতো জান্তব হয়ে উঠেছিল। এনিমেটা স্টুডিও অরেঞ্জের বানানো, যারা এর আগে Land of the lustrous বানিয়ে সিজির ঝলক দেখিয়েছিল। এই স্টুডিও কোন মাঙ্গা অ্যাডাপ্ট করার সিদ্ধান্ত নিলে সেটার এনিমে ভিন্ন একটা আবহ নিয়ে বের হয়ে আসে। সামনে তাদের আরো একক কাজের অপেক্ষায় রইলাম।

ওপেনিং সং Wild একটা অসাধারণ মিউজিক কম্পোজিশনের উদাহরণ। ইউটিউবে দেখলাম আর্টিস্ট ব্যান্ড ALI একটা মাল্টিন্যাশনাল গ্রুপ। জ্যাজ আর র‍্যাপ মিশিয়ে তারা দারুণ একটা গান তৈরি করেছে। আর এর সাথে সমানভাবে তাল মিলিয়েছে স্টপ মোশন অ্যানিমেশনে বানানো ওপেনিং ক্রেডিটটা। ওপেনিং ক্রেডিটটা সিরিজটাকে আরো জান্তব করে তুলেছে। বিশেষ করে That’s called Jazz বলার মুহূর্তে যে রক্তের দৃশ্যটা দেখানো হয় তার মত ক্রিপি দৃশ্য আমি কমই দেখেছি। এরকম অস্বস্তিকর অনুভূতি হয়েছিল আরেক গ্রেট সাতোশি কনের এনিমে Paranoia Agent এর ওপেনিং ক্রেডিট দেখার সময়। চরম অস্বস্তিকর হওয়ার পরেও একবারও স্কিপ করতে পারি নি ওপেনিংটা।

২০১৯ সালের অনেকগুলো ভাল এনিমে দেখা বাকী পড়ে ছিল এতদিন, বিস্টার্স তার মধ্যে একটা। এখন আফসোস হচ্ছে আগে দেখে থাকলে টপচার্টে সাইকোলজিকাল পোলে একে ভোট দিতে পারতাম। বিস্টার্স নিঃসন্দেহে ম্যাচিউর ঘরানার এনিমে দর্শকদের জন্য বড় একটা উপহার। আবার নেটফ্লিক্সে সম্প্রচারিত হওয়ার কারণে অনেক নন-এনিমে দর্শকও এনিমের প্রতি ঝুঁকবে এর মাধ্যমে। সেকেন্ড সিজনের ঘোষণাও এসে গেছে শুনলাম। মাঙ্গাটা পড়বো কিনা ভাবছি। সিরিজের অ্যানিমেশনের স্টাইল নিয়ে মাঙ্গা ফ্যানদের বেশ কিছু আপত্তিও দেখলাম।

সবশেষে, ম্যাচিউরড ও কিঞ্চিৎ ডার্ক জিনিস পছন্দ করা দর্শকদের জন্য বিস্টার্স প্রচণ্ডভাবে রেকমান্ডেড। Furry জিনিস বলে একে এড়িয়ে যাবেন না।

Chainsaw Man [মাঙ্গা রিভিউ] — Shifat Mohiuddin

Chainsaw Man

জনরা: অ্যাকশন, ডার্ক ফ্যান্টাসি

১৬ বছরের অনাথ কিশোর দেনজি। সদ্য সে নিজের একটা কিডনি বারো লাখ ইয়েনে, একটি চোখ তিন লাখ ইয়েনে আর নিজের একটি অণ্ডকোষ বিক্রি করেছে এক লাখেরও কম ইয়েনে। গাছ কেটে সে কষ্টেসৃষ্টে আরো হাজার ষাটেক ইয়েন যোগাড় করেছে। তারপরেও ইয়াকুজার কাছে তার ঋণ শোধ করা বাকী আছে আরো তিন কোটি আশি লাখ চল্লিশ ইয়েনের মতো। অযোগ্য বাবা মরে গিয়ে তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে গেছে এই ভার। প্রিয়জন বলতে তার আছে শুধু পোষা কুকুর পোচিতা যে আসলে একটা চেইন-স সদৃশ ডেভিল।
তো পোচিতাকে নিয়ে ঋণ শোধের জন্য ডেভিল হান্ট করে দেনজি। জীবনের সব মৌলিক চাহিদা থেকে বলতে গেলে বঞ্চিতই দেনজি। স্কুলে যায় নি সে কখনো, থাকে একটা নড়বড়ে ঘরে, যা পায় তাই খায়। বুক ভরে তার স্বপ্ন একটা সুন্দর জীবনযাপন করার, হয়তোবা সুন্দরী কোন এক মেয়ের সঙ্গও পাওয়ার আশা করে দেনজি।

বিন্দু বিন্দু শিশির দিয়ে দীঘি পূর্ণ করার আশা রাখা দেনজিকে একদিন তার ইয়াকুজা বস ডেকে নেয় বিশেষ কাজে। এক পরিত্যক্ত ফ্যাক্টরিতে নিয়ে যাওয়া দেনজিকে ডেভিল হান্ট করার জন্য। সেখানে ইয়াকুজার সাঙ্গপাঙ্গরা পোচিতাসহ তাকে টুকরো টুকরো করে কেটে ময়লার ড্রামে ভরে রাখে। আসলে ইয়াকুজারা সবাই এক ম্যানিপুলেটিং ডেভিলের আদেশ মানছিল এতক্ষণ। বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হওয়া দেনজি অবচেতন মনে পোষা কুকুর পোচিতার সাথে চুক্তি করে, সে নিজের পুরো দেহ দান করবে পোচিতাকে বিনিময়ে পোচিতা তাকে দেবে স্বাভাবিক মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণের সুযোগ।

লাইফ লাইন পেয়ে দেনজি আবির্ভূত হয় চেইন-স ম্যান হিসেবে। চেইন-সর নির্মম আঘাতে সে কেটে টুকরো টুকরো করে ডেভিল আর তার চেলাপেলাদের। সরকারি ডেভিল হান্টাররা ঘটনাস্থলে এসে রক্ত-মাংসের স্তুপের মাঝে দেনজিকে আবিষ্কার করে। উচ্চতর অফিসার মাকিমার নজরে পড়ে যায় দেনজি আর মাকিমা তাকে সরকারি ডেভিল হান্টারদের দলে যোগদানের প্রস্তাব দেয়। বিনিময়ে তিনবেলা খাবার আর একটা শোয়ার জায়গার প্রস্তাব পেয়ে খুশীমনে রাজি হয়ে যায় দেনজি।

তো চেইন-স ম্যানের কাহিনী শুরু এখানেই। মাঙ্গাটা ২০১৯ সাল থেকে উইকলি শোউনেন জাম্পে প্রকাশিত হয়ে আসছে। এ পর্যন্ত বের হয়েছে ৭২ চ্যাপ্টার। বেশ জনপ্রিয়তা কুড়িয়েছে এর মাঝে। Mangaplus এ টপ টেনে থাকে প্রতি সপ্তাহেই।

চেইন-স ম্যান মাঙ্গাটার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ সম্ভবত এর আন-অর্থোডক্স অ্যাপ্রোচ। মাঙ্গাটা আসলেই শোউনেন জাম্পে কিভাবে এত ভালভাবে ছাপানো হচ্ছে সেটা আসলে চিন্তার বিষয়। জাম্পে সাধারণত এত ব্রুটাল আর grotesque আর্টের মাঙ্গা সহজে দেখা যায় না। শোউনেন হিসেবে ধরলে এর স্টোরি, ক্যারেকটার ডিজাইন, আর্টস্টাইল আর সংলাপ সবই অত্যন্ত প্রথাবিরোধী। পুরো মাঙ্গাটাতেই গোছানো জিনিস খুঁজে পেলাম না তেমন, সবকিছুই প্রচণ্ড রকমের অগোছালো। যেন কেউ চেইন-স দিয়েই এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছে মাঙ্গাটাকে আগাগোড়া।

চেইন-স ম্যানের ক্যারেকটারগুলো চরম ব্যতিক্রম। শোউনেন মাঙ্গার নিয়মিত বৈশিষ্ট্য যে বন্ধুত্বের জয়গান তার ছিটেফোঁটাও নেই ক্যারেকটারগুলোর মাঝে। ক্যারেকটারগুলো এমন একটা দুনিয়ায় বসবাস করে যেখানে যেকোন মুহূর্তে জীবন চলে যেতে পারে ডেভিলের হাতে। তার প্রভাবে ক্যারেকটারগুলো হয়ে উঠেছে প্রচণ্ড আত্মকেন্দ্রীক, নিষ্ঠুর আর বাস্তববাদী। দিনে এনে দিনে খেতে খেতে ক্যারেকটারগুলো মানুষ মানুষের জন্য এই প্রবাদটা যেন সবাই ভুলেই গেছে। আর মাঙ্গাকাও যেন এই জিনিসটা লুকানোর কোন চেষ্টাই করেন নি। পাবলিক ডেভিল হান্টাররা বেশিরভাগই জনগণের সেবার জন্য কাজে যোগ দেয় নি। বেশীরভাগই ডেভিলদের হাতে কোন না কোনভাবে ক্ষতির স্বীকার তাই প্রতিশোধস্পৃহাই তাদের কাজে লেগে থাকার মোটিভেশন। হিরোইজমের ছিটেফোঁটাও নেই তাদের মাঝে। মানুষও তাদের অত মহান কিছু মনে করে না। এই বৈশিষ্ট্যটা মাঙ্গাটার ডার্ক ফ্যান্টাসি হওয়ার পেছনে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে যে জিনিসটা Shueisha এর অন্য দুই মাঙ্গা হিরো অ্যাকাডেমিয়া আর ওয়ান পাঞ্চ ম্যান সযত্নে পরিহার করেছে। ক্যারেকটারগুলো মারাও যায় ধুপধাপ, এমনকি টেরও পাওয়া যায় না কখন কে মারা গেল। বেঁচে থাকা মানুষগুলোও মারা যাওয়া মানুষগুলো নিয়ে অত চিন্তিত না। বিশাল একটা ম্যাসাকারের মাধ্যমে বড় একটা পেইজ শেষ হয়ে গেলে দেখা যায় পরের পেইজেই সবাই দৈনন্দিন জীবনযাপন করছে, যেন সবকিছু সয়ে গেছে তাদের। এই জায়গাটাতে মাঙ্গাকা তাতসুকি ফুজিমোতোকে রীতিমত ‘uncensored’ বলবো আমি।

মাঙ্গার শ্রেষ্ঠ দিক নিঃসন্দেহে এর brutal, gritty, grotesque আর্টস্টাইল। কালো কালির অত্যধিক ব্যবহারের কারণে প্যানেলগুলো আরো ভয়াবহ রকমের ভায়োলেন্ট হয়ে উঠে। বিশেষ করে কিছুটা মানুষের মত দেখতে (হিউমনয়েড) ডেভিলগুলার আর্টগুলো সবচেয়ে ভয়াবহ। দেনজির প্রতিটা ট্রান্সফরমেশন গায়ে কাঁটা দেয়। এনিমে আসবে নিঃসন্দেহে তবে এই gory পরিবেশটা কিভাবে স্টুডিও ধরে রাখবে সেটা একটা দেখার মত বিষয়। অ্যাকশন প্যানেলগুলো সব দুর্দান্ত আর প্রচণ্ড ফাস্ট-পেসড। ইউসুকে মুরাতার আঁকার সাথে মিল পাওয়া যায়, তবে মুরাতার মত অত ডিটেইলড না। ক্যারেকটারগুলোর ভয়ার্ত, আতংকিত আর নিষ্ঠুর ভাবলেশহীন চাহনি মাঙ্গাটাতে হরর এলিমেন্টের আমদানী করেছে সুন্দরভাবে।

তারমানে মাঙ্গাতে কমেডি নেই এমন না। দেনজির জীবন-দর্শনটাই একটা বিশাল কমেডি। বিশেষ করে ভয়ংকর ভয়ংকর কাজ করার পেছনে তার হাস্যকর স্বার্থসিদ্ধিগুলো সবচেয়ে মজার। বিস্তারিত বলে পাঠকদের মজা নষ্ট করতে চাচ্ছি না এখানে। তবে বেশীরভাগ কমেডিগুলাই কেমন জানি অস্বস্তিকর। এচ্চি কিছু ম্যাটেরিয়াল দেয়া হয়েছে তবে সেগুলাও সস্তা বিনোদনের যোগান দেয় না। বিন্দুমাত্র কামভাব জাগায় নি এচ্চি সিচুয়েশনগুলা। বরং বয়ঃসন্ধিকালের অস্বস্তিকর মানসিক টানাপোড়েন উঠে এসেছে আকু নো হানার মতো। পাওয়ার আর দেনজির এক বাথটাবে শুয়ে সময় পার করার দৃশ্যটা ভিন্ন এক অনুভূতির জন্ম দিয়েছে। এই সাইকোলজিকাল দিকগুলো মাঙ্গাটাকে বেশ মৌলিক করে তুলেছে আমার মতে। শোউনেন জাম্পের পাতায় এমন জিনিস দেখতে পাবো ভাবি নি।

সব মিলিয়ে বিধ্বংসী এক অভিজ্ঞতা উপহার দিয়েছে আমাকে চেইন-স ম্যান আমাকে। দুইদিনেই পড়ে ফেলেছি সবগুলা চ্যাপ্টার। আস্তে আস্তে ওয়ার্ল্ড-বিল্ডিংও হচ্ছে মাঙ্গাটাতে। গান ডেভিলই সম্ভবত সিরিজের মেইন ভিলেন, দারুণ একটা মিথ গড়ে উঠেছে তাকে ঘিরে। সবাই কেন চেইন-সর হার্ট শিকার করতে চাইছে তাও একটা দারুণ সাসপেন্স জন্ম দিয়েছে। সব মিলিয়ে প্রথাবিরোধী এই মাঙ্গার সাফল্য কামনা করছি, আশা করি জাম্পের টপ ফাইভে উঠে আসবে সামনে। (যেহেতু Kimetsu no yaiba শেষ ও The Promised Neverland শেষের দিকে)

Ride Your Wave [মুভি রিভিউ] — Shifat Mohiuddin

ইচ্ছেপূরণ বা wish-fulfillment একটা ইতিবাচক জিনিস হিসেবেই বিবেচিত আমাদের কাছে। দিনশেষে সবকিছু ভালভাবে মিটে গেলেই আমরা খুশী, মিটে না গেলেও সবকিছু মিটে যাওয়ার সুখস্বপ্ন নিয়ে থাকতে আমরা ভালোবাসি। কিন্তু লেবু বেশী চিপলে যেমন তিতে হয়ে যায় তেমনি অতিরিক্ত উইশ-ফুলফিলমেন্ট বাস্তবতাকে ততোধিক বিকৃত করে ফেলে। এনিমে ইন্ডাস্ট্রির একটা বড় আকারের কাজ এই দোষে দুষ্ট। তারপরেও এনিমে ইন্ডাস্ট্রিতে এ ধরণের গল্পের চাহিদা প্রচুর। প্রথমেই সমালোচনা করছি মানে এ নয় যে আমি এ ঘরানার গল্প নিতান্তই অপছন্দ করি। Clannad এই বৈশিষ্ট্যের পরাকাষ্ঠা হওয়ার পরেও আমার সেরা দশ এনিমের তালিকায় অনায়াসে জায়গা করে নেয়।

তবে Ride Your Wave নিয়ে শুরুতেই কেন আমার এত নেতিবাচক ভূমিকা! দোষটা আসলে সরাসরি এনিমে মুভিটার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া যায় না। দোষ দিলে দিতে হবে আমার এক্সপেক্টেশনকে! মাসায়াকি ইউয়াসা আর Science Saru এর কাছ থেকে আমার প্রত্যাশা বরাবরই প্রবল থাকে। ইউয়াসার কাজকে ক্ষুদ্র পরিসরে মাপা দুরূহ কাজ। সংক্ষেপে বলতে গেলে তার কাজের ব্রিলিয়ান্সটা লুকিয়ে আছে অদ্ভুতুড়ে জিনিস উপহার দেয়ার মধ্যে। জাদুবাস্তবতাও তার কাজের আরেকটা বড় উপাদান। এহেন ইউয়াসা যখন দু-বছর পরে (The Night is Short, Walk on Girl এর মুক্তির পর) এমন generic একটা মুভি বানিয়ে ফেলেন তখন নেতিবাচক পোস্ট দেয়া ছাড়া উপায় থাকে না।

Ride Your Wave মুভিটা যাবতীয় জেনেরিক দোষে দুষ্ট। ঘটনাক্রমে নায়ক-নায়িকার দেখা হয়ে গেল, তারপর তারা কিছু সময় কাটানোর পর কাছাকাছি হওয়া শুরু করলো, একে-অপরের অনুপ্রেরণা হিসেবে আবির্ভূত হল; এরকম কয়েকটা কমন থিম নিয়েই মুভির শুরুটা। তাও প্রথম ত্রিশ মিনিট আমি মুভিটাকে কিছুটা মাফ করে দিতাম কারণ নায়ক-নায়িকার মিষ্টি মিষ্টি সময় কাটানোটা ভালই লাগছিল। চরম ইউটোপিয়ান একটা পরিবেশে তখন দুজনে বাঁধা পড়ে, বল্গাহীন ভাবে তারা জীবনকে যৌবনের নিরীখে উপভোগ করছিল। একটা ভাল দিক ছিলো, মিনাতো আর হিনাকো দুজনেই ছিল হাইস্কুল পেরোনো মানুষ, তাই তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলো ছিল সাধারণ এনিমের চেয়ে বেশী সাহসী। এখানে উইশ-ফুলফিলমেন্ট থেরাপি কাজ করছিল আমার উপর। দৈনন্দিন জীবনের যাঁতাকলে নিত্য পিষ্ট আমার কাছে দুই তরুণ-তরুণীর আগলছাড়া রোমান্টিসিজম ভাল লাগবে অবশ্যই।

ভাল না লাগার মাত্রাটা বাড়ে যখন গল্পের তাগিদে মিনাতো মারা যায়। মৃত্যূটা বীরোচিত ছিল তবে নিঃসন্দেহে বলা যায় কোন গভীরতা বহন করছিল না। ২০১৮ সালে বের হওয়া I wanna eat your pancreas মুভিতেও একই ঘটনা ঘটতে দেখেছি। এরপরেও ভেবেছিলাম মুভিটা সম্ভবত প্রিয় মানুষ হারানোর বেদনার উপর আলোকপাত করবে হিনাকোর দৃষ্টিকোণ থেকে। তাও হলো না! আকাশ থেকে আনা হলো সুপারন্যাচারাল ম্যাটেরিয়াল, আমাকে পুরো বোকা বানিয়ে মুভিটা দেখালো যে পানির মধ্যে মিনাতোর অস্তিত্ব নিতান্ত হিনাকোর হ্যালুসিনেশন নয় বরং বাস্তব! তারপর আবার ‘দেখা পেয়েও ছোঁয়া হলো না’ ঘরানার জেনেরিক জিনিসের আমদানী। অথচ বোকা আমি Shape of Water এর গন্ধ খোঁজার চেষ্টা করছিলাম তখন ফিল্মে! (অট্টহাসির আওয়াজ হবে)
শেষমেষ ফিল্মটা আমাকে শতভাগ বেকুব আর হতাশ বানিয়ে হিনাকোর সিঙ্গেল থাকা দেখিয়ে শেষ হলো।

তারমানে এমন না যে মুভিটাতে ভাল কোন উপাদান নেই। অ্যানিমেশন মনকাড়া, সার্ফিংয়ের জায়গাগুলা অপূর্ব। ইউয়াসার ট্রেডমার্ক ফ্লুইড অ্যানিমেশন আছে জায়গায় জায়গায়। ক্যারেকটার ডিজাইন সুন্দর, রোমান্টিক জায়গাগুলোতে হিনাকো আর মিনাতোকে খুবই সুন্দর লাগছিল। কিন্তু ঐযে style over substance বলে একটা কথা আছে না, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই মুভিটা। আর ওএসটির কথা বলতে গেলে আরেক নাটকের অবতারণা করতে হয়! পুরো মুভিতে একটা মাত্র গান বারবার ব্যবহার করা হয়েছে যে জিনিসটা আমার কাছে পরে বিষপানের মত মনে হচ্ছিল। এমন বলবো না যে Generations from Exile Tribe এর গাওয়া ‘Brand New Story’ গানটা খারাপ, বরংচ বেশ ভাল একটা গানই এটা নিজ জনরার মনে করি। তবে বারবার একই গান ব্যবহার করাটা খুব বাজে লাগছিল, কেন একই গ্রুপকে দিয়েই আরো দু-তিনটা গান গাইয়ে মুভিতে ব্যবহার করা হলো না তা এখনও বোধগম্য হলো না। এই প্রথমবারের মত ইউয়াসা আমাকে পুরোপুরি হতাশ করতে সমর্থ হলেন!

সারাংশ:
সাধারণ মুভি হিসেবে উপভোগ্য
মাসায়াকি ইউয়াসা মুভি হিসেবে চরম হতাশাজনক

Kimetsu no Yaiba [রিয়্যাকশন/সাজেশন] — Shifat Mohiuddin

KnY 1

সত্যি বলতে এই সিজনে এই এনিমেটা যে বের হচ্ছে তা আমি জেনেছি অনেক পরে। AOT আর OPM এর উপরেই মনযোগটা নিবদ্ধ ছিল বেশী, সিজনের নতুন জিনিস হিসেবে কোন এক কারণে Fairy Gone ই দেখছিলাম শুধু। কারণ ছিল ইন্টারনেট হাইপ আর শিল্প বিপ্লব পরবর্তী ঘরানার পটভূমি। অথচ যে কয়টা পর্বই দেখলাম আপাতত, ফেয়ারি গন পুরোই হতাশ করছে আমাকে এপর্যন্ত। তখনই আসলে কিমেতসু নো ইয়াইবা নিয়ে গ্রুপের বিভিন্ন পোস্ট বিশেষ করে গ্রুপের কাভার ফটোর সুন্দর পোস্টটা চোখে পড়লো। সেখান থেকেই জানতে পারলাম এনিমেটা ইউফোটেবলের, আমি মোটামুটি ইউফোটেবলের ফ্যানবয় হিসেবেই দাবী করি নিজেকে, এখন এত বড় খবর মিস হয়ে যাওয়ায় নিজের কাছে নিজেরই লজ্জায় মাথা কাটায় যোগাড়!

তো প্রথম পর্বটা প্লে করার সাথে সাথেই হুকড হয়ে গেলাম বরফে আচ্ছাদিত ল্যান্ডস্কেপ দেখে। তাতে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ দেখতে অসাধারণ সুন্দর দেখাচ্ছিল যদিও মনে মনে বিশাল অমঙ্গলের আশা করছিলাম। শেষমেশ কী যে বিশাল অমঙ্গল হয়েছে তা তো দর্শকদের সবার জানাই! তারপর বলতে গেলে একটানেই দশটা পর্ব দেখে ফেললাম। সেই ডিসেম্বরে গুরেন লাগান দেখার পর আর কোন এনিমে এভাবে একটানা দেখতে পারি নি। সে হিসেবে জিনিসটা খুব স্বস্তির ছিল, ভয় পাচ্ছিলাম যে এনিমের প্রতি আগের সেই অনুরাগ হারিয়ে ফেলছি বুঝি।

তো এনিমেটার যেসব জিনিস ভাল লেগেছে তা সংক্ষেপে নিচে তুলে ধরছি:

প্রথমেই এনিমের শুরুটা, প্রথম পর্বেই যথেষ্ট পরিমাণে ভায়োলেন্স আর গোর দিয়ে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে এনিমেটা ডার্ক ফ্যান্টাসি ঘরানার। এটাতে যে দর্শকদের অনেক আশার প্রতিফলন হবে না তাও যেন জানান দেয়া হল। প্রথম পর্ব হিসেবে যথেষ্ট ক্লাইমেটিক ছিল যা দর্শকদের এনিমেটা আরো দেখাতে আগ্রহী করেছে বলতেই হবে।

দ্বিতীয়ত ইউফোটেবলের অসাধারণ ক্যামেরা অ্যাঙ্গেলের কাজ। বিশেষ করে তানজিরোর মুভমেন্টের সাবলীলতা। জানি না কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই ফ্লুয়েন্সিটা আনা হয়, সম্ভবত মোশন সেন্সর জাতীয় কিছু দিয়ে। এ ঘরানার ফ্লুয়েন্ট মুভমেন্ট দেখেছিলাম Kara no Kyoukai সিরিজের মুভিগুলাতে। সবার নিশ্চয়ই শিকির করিডোর ফাইটের কথা মনে আছে! তানজিরোর থ্রি ডাইমেনশনাল নাড়াচাড়ার সাবলীলতা মুগ্ধ করার মত। অন্যকোন স্টুডিও হলে নিশ্চিত ভজকট পাকিয়ে ফেলতো, ভিডিও গেইম অ্যাডাপ্টেশনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ইউফোটেবলকে এখানে অনেক সাহায্য করেছে মনে করি।

KnY 2

আরেকটা ভাল লাগা ছিল এনিমেতে সুন্দর সিজিআইয়ের ব্যবহার। সাথে সাথে এটাও স্বস্তিদায়ক ছিল মানুষ ও বিশেষ করে ডিমনগুলাকে পরিশ্রম বাঁচানোর জন্য সিজিআই দিয়ে অ্যানিমেট না করাটা! আসলে চলন্ত আর নাড়াচাড়া করা জিনিস অ্যানিমেট করার বেলায় হাতে আঁকা ফ্রেমই এখনো শ্রেষ্ঠ। অথচ সেই জায়গায় ফেয়ারি গনের ফেয়ারিগুলাকে সিজি দিয়ে বীভৎস বানানো হয়েছে।  ইউফোটেবল খুব বুদ্ধিমানের মত অন্ধকার জঙ্গল, গাছপালা, বাড়িঘর ইত্যাদিকেই শুধু সিজি দিয়ে তৈরি করেছে। আর আমরা তো সবাইই জানি ইউফোটেবল রাতের দৃশ্য বানানোর ওস্তাদ! (UBW দ্রষ্টব্য) সেই হিসেবে KNY এনিমেটার বলতে গেলে সব মেজর দৃশ্যই রাতে, (যেহেতু শুধু রাতের বেলাতেই ডিমন আসে) ইউফোটেবলের অ্যাডাপ্ট করার জন্য একেবারে পারফেক্ট এনিমে ছিল এটা।

এনিমেটার স্টোরি আর ওয়ার্ল্ড বিল্ডিংয়েরও প্রশংসা করতে হবে। নেজুকোকে ডিমন বানানোর কারিগরকে বেশ তাড়াতাড়ি স্টোরিতে দেখানোটা খুব ভাল হয়েছে আমার মতে। আবার এটাও জানান দেয়া হয়েছে যে তার বারোজন ঘনিষ্ঠ সহচরও আছে, মানে তাদের মুখোমুখি না হওয়ার আগ পর্যন্ত বস ফাইট হবে না। আবার Demon Slayer Corps. এর অর্ডারেরও বেশী কিছু খোলাসা করা হয়নি। তারমানে অনেক চমকপ্রদ জিনিস এখনো আছে মাঙ্গাকার ঝুলিতে। শুধু নেজুকোকে নিয়ে তানজিরোর একা একা জার্নি করাটাই ভাল লাগছে বেশী আপাতত। শীঘ্রই মনে হয় কমরেড পেতে যাচ্ছে তানজিরো, দেখি তারা কেমন ক্যারেকটার হয়।

এনিমেটাতে যথেষ্ট শৌনেন এলিমেন্ট আছে। যেমন পাওয়ারের নাম মুখে এনে পাওয়ার ব্যবহার করা ইত্যাদি। তানজিরোর সোর্ডের স্কিলগুলা দেখার মত। ওর সোর্ডের পানির যে অ্যানিমেশন সেরকম অ্যানিমেশন আমি এর আগে দেখি না কোনখানে। দারুণ অ্যাস্থেটিক স্কিলগুলা আর নামগুলাও খুব সুন্দর। তানজিরো একদমই মাথা গরম ঘরানার প্রোটাগনিস্ট না, সেটা আরো বড় স্বস্তির। আর তার পাওয়ারফুল হওয়ার কাজটাও হচ্ছে ধীরে ধীরে, আশা করি এই মাঙ্গার মাঙ্গাকা হুটহাট পাওয়ার বাড়ানোর ভুলটা করবেন না। (যেটা নারুতোসহ অনেক ভাল শৌনেন মাঙ্গার বিশাল একটা সমস্যা ছিল।)

এই এনিমের আরেকটা অত্যন্ত আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে এর মিউজিক, শুনেই বুঝেছিলাম কাজিউরা ইউকির কাজ! বিশেষ করে ডিমন আসার ক্রিটিকাল মোমেন্টে যে অশরীরী choir টা বাজে সেটা পুরোই গায়ের লোম দাঁড় করিয়ে দেয়। এই মিউজিকটা আবার প্রতি পর্বের নাম দেখানোর জায়গাটাতেও দেয়া হয় যেটা দারুণ একটা ভৌতিক আবহ তৈরি করে। প্রতিটা পর্বের নাম যে ক্যানভাসের উপর স্ক্রিপ্ট আকারে আসে সেই জিনিসটাও ভাল লাগে, এনিমেটা যে সম্রাট হিরাহিতো আমলের পটভূমিতে রচিত তা টের পাওয়া যায়।

শেষমেশ এনিমেটার এন্ডিং সংয়ের পর যে ফান সেগমেন্টটা হয় সেটা অনেক প্রশান্তি দেয়। পুরো পর্বের ভয়ানক ভয়ানক ঘটনার পর যখন নেজুকোর মৃদু মৃদু কণ্ঠস্বর শুনি তখন আসলে মন ভাল না হয়ে উপায় থাকে না।

KnY 3

Steins;Gate 0 [রিভিউ] — Shifat Mohiuddin

Steins Gate 0

Steins;Gate 0
জনরা: সায়েন্স ফিকশন
পর্ব: ২৩
স্টুডিও: White Fox
ম্যাল রেটিং: ৮.৮

স্পয়লার অ্যালার্ট!!!
(যারা ২০১১ সালে বের হওয়া Steins;Gate সিরিজটি দেখেন নি তারা পোস্টটি এড়িয়ে চলুন)

স্টাইন্স গেইট দেখেছিলাম সেই ২০১৫ সালের মাঝামাঝিতে। অন্য সবার মতই দেখার সাথে সাথে এনিমেটা একেবারে সবচেয়ে প্রিয় এনিমের সংক্ষিপ্ত তালিকায় ঢুকে যায়৷ সে অবস্থান এখনও এনিমেটা দারুণ শক্তভাবে দখল করে আছে৷ স্টাইন্স গেইটের সিকুয়েল আসছে তার প্রথম খবর পাই ২০১৭ সালের প্রথম দিকে। সত্য কথা বলতে গেলে অত বেশী প্রত্যাশা ছিল না। ভেবেছিলাম মূল এনিমের এত ভাল একটা সমাপ্তি থাকার পরেও আরেকটা কিস্তি বানানোর কীইবা দরকার আছে! তাই এপ্রিলে যখন স্টাইন্স গেইট জিরো এনিমের সম্প্রচার শুরু হয় তখন অতটা পাত্তা দেই নি৷ টনক নড়ে 23বেটা এপিসোডটা দেখার পর৷ বেটা টাইমলাইনের ভয়াবহ ভবিষ্যতের আঁচ টের পাই পর্দার এপাশে বসেই। ম্যাড সায়েন্টিস্টের বদলে স্যাড সায়েন্টিস্ট হওয়িন কিয়োমাকে দেখে রীতিমত আঁতকে উঠি! তাই কালবিলম্ব না করে দেখে ফেললাম স্টাইন্স গেইট জিরো! দেরী করে দেখার আরেকটা কারণ ছিল অনগোয়িং দেখাটাকে এড়ানো৷ কারণ স্টাইন্স গেইটের মত এনিমে অনগোয়িং দেখার মত পেইনফুল কাজ করতে আমি মোটেই রাজী ছিলাম না! তো আজকে শেষ করে ফেললাম মহাকাব্যিক এই এনিমের সিকুয়েল৷ যা প্রত্যাশা করেছিলাম তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশী ভাল জিনিস পেয়েছি এনিমেটার কাছ থেকে৷

প্লট:
স্টাইন্স গেইট জিরোর কাহিনী আবর্তিত হয়েছে বেটা টাইমলাইনকে ঘিরে৷ যাদের বেটা টাইমলাইন কোনটি তা মনে নেই তাদের স্বার্থে বলছি, বেটা টাইমলাইন হল সেই টাইমলাইন যেখানে ওকাবে মাকিসে কুরিসেকে বাঁচাতে ব্যর্থ হয়৷ বিনিময়ে মায়ুরি বেঁচে থাকে। অন্যদিকে আলফা টাইমলাইনে কুরিসু বেঁচে যাওয়ায় মায়ুরিকে প্রাণ দিতে হয়৷ এই দুই টাইমলাইনের মাঝেই অবস্থান করে স্টাইন্স গেইট টাইমলাইন যেখানে কুরিসু এবং মায়ুরি দুজনেই বেঁচে থাকে ও বিশ্বের পরাশক্তিগুলো টাইম মেশিনের দখল পাওয়ার জন্য বিশ্বযুদ্ধেও জড়িয়ে পড়ে না।

স্টাইন্স গেইট এনিমে সিরিজে আমরা ওকাবেকে দেখি স্টাইন্স গেইট টাইমলাইনে সফলভাবে পৌছুতে। কিন্তু জিরো এনিমেটি জগতের বেটা টাইমলাইন দেখায়। জিরো প্রদর্শন করে বেটা টাইমলাইনের জগতের ভয়াবহতা যেখানে কুরিসুর বিনিময়ে মায়ুরিকে বাঁচালেও মানবজাতির উপর অশুভ শক্তির কালো ছায়া ঠিকই বিদ্যমান থাকে। ভবিষ্যত থেকে আসা সুজুহা বারবার ওকাবেকে মনে করিয়ে দেয় যে বিশ্বযুদ্ধ আসন্ন। ৫-৭ বিলিয়ন মানুষের জীবন ওকাবের হাতে, সে একটু সাহস প্রদর্শন করতে পারলেই এত মানুষের জীবন বেঁচে যায়। ওকাবে দৃঢ়ভাবে আবার টাইম ট্রাভেল করতে অস্বীকৃতি জানায়, সে আবারও তার প্রিয় কারোর মৃত্য দেখার যন্ত্রণা ভোগ করতে চায় না। সে বলে স্টাইন্স গেইট টাইমলাইন বলতে কিছুই নেই, সবই তার অলীক কল্পনা ছিল। ম্যাড সায়েন্টিস্ট ওকাবে রিনতারো হয়ে যায় স্বল্পভাষী স্বাভাবিক যুবক যে কিনা নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় আর বিভিন্ন সেমিনারে অংশগ্রহণ করে। ফিউচার গ্যাজেট ল্যাবরেটরির ০০১ নাম্বারধারী মেম্বারের আর পা পড়ে না ল্যাবে। যে মায়ুরির জন্য এতকিছু সে নিজেও ল্যাবে আসলে ফাঁকা ফাঁকা বোধ করে।

কাহিনীর মোড় ঘুরে যায় যখন এক সেমিনারে একটি AI (আর্টিফিশিয়াল ইনটিলিজেন্স) এর উদ্ভোধন অনুষ্ঠানে ওকাবে হাজির হয়। সেখানে তরুণী বিজ্ঞানী হিয়াজো মাহো (আমাদের লিগাল ললি!) এবং অধ্যাপক লেনস্কিনের সাথে ওকাবের পরিচয় হয়। মাহো আর লেনস্কিন Amadeus নামের এক AI সিস্টেমের আবিষ্কর্তা। ওকাবে জানতে পারে যে মাহো আর কুরিসু একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল এবং তারা একই বিষয়ের উপর গবেষণা করেছে৷ ওকাবে এটা জেনে দারুণ অবাক হয় যে আমাডেউস সিস্টেমটি তৈরি করা হয়েছে কুরিসুর মেমরির উপর ভিত্তি করে৷ কম্পিউটারের স্ক্রিনে জলজ্যান্ত কুরিসুকে দেখে ওকারিন তো প্রায় পাগলপ্রায়। প্রফেসর আর মাহো ওকাবেকে অনুমতি দেয় AI টির সাথে নিয়মিত কথাবার্তা বলে সিস্টেমটির উন্নতি ঘটাতে৷ ওকাবের ফোনে আমাডেউস ইনস্টল করে দেওয়া হয় আর সেখান থেকেই ওকাবে আবার টাইম ট্রাভেল জগতের ভয়ংকর বেড়াজালে আটকা পড়ে।

প্রতিক্রিয়া:
স্টাইন্স গেইট এনিমের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ নিঃসন্দেহে এর স্টোরি আর সেই স্টোরির টুইস্ট। জিরোর স্টোরিতে সেটা ভালভাবেই বিদ্যমান ছিল। আগের সিরিজের প্রথম কয়েকটা পর্ব ছিল বেশ ধীরগতির। ইউনিভার্স আর চরিত্রগুলাকে ব্যাখা করতে গিয়ে এরকম হয়েছিল বলে মনে করি৷

জিরোতে মোটামুটি ভালরকমভাবে সবকিছু আগে থেকে গোছানো থাকায় প্রথম পর্ব থেকেই পেসিং বেশ সুন্দর মনে হয়েছে। বেশ কয়েকটা নতুন চরিত্র ছিল, তাদেরকে বেশ ভালভাবেই কাহিনীতে জায়গা দেয়া হয়েছে৷ তাছাড়া পুরনো চরিত্রগুলোকেও নতুন ডেভেলপমেন্ট দেয়া হয়েছে৷ ওকাবের নতুন রূপকে কেন জানি একটু বেশীই ভাল লেগে গিয়েছে। সারাদিম আকাশ-কুসুম কল্পনা করার ওকাবের বদলে শান্ত-সৌম্য, ধীরস্থির, স্বাভাবিক ওকাবেকেই বেশী মনে ধরেছে।
তাই বলে হওয়িন কিয়োমার রিটার্নের জায়গাটা খারাপ ছিল এটা কোনভাবেই বলা যাবে না৷ মুহাহাহা করে সেই শয়তানি হাসিটা দেওয়ার পর তো গায়ের রোম পুরো খাড়া হয়ে গিয়েছিল, রক্ত চলাচলও সম্ভবত বেড়ে গিয়েছিল তিন বছর পর হাসিটা শোনার কারণে৷ পলকের মধ্যে শার্ট-প্যান্টের উপর ওকারিনের ল্যাবকোট গায়ে দেয়ার দৃশ্যটা সম্ভবত এনিমেটার সেরা জায়গা ছিল।

অন্য চরিত্রগুলার মধ্যে দারুণ উন্নতি হয়েছে দারু আর মায়ুশির৷ বিশেষ করে মাথাঠাণ্ডা দারুর এরকম দারুণ আকর্ষণীয় দিক আছে তা কে জানতো! আগের সিরিজে তো দারুর পার্ভার্টনেসটাকেই বেশী দেখিয়েছে। এখানে বোঝা গেছে কেন দারু ভবিষ্যতে টাইম মেশিন আবিষ্কার করতে সমর্থ হয়েছে। সুজুহার ব্যাপারটা জানা থাকায় দারুর পিতৃসুলভ আচরণ অনেক দেখা গেছে যা অনেক নান্দনিক ছিল। ইউকির সাথে ডেইটের পর ছাদের উপর বিষণ্ণ দারুকে দেখে অনেক খারাপ লেগেছিল।

অন্যদিকে জিরোতে মায়ুশির কাজকর্মের পরিধি ছিল অনেক বিস্তৃত। মায়ুশির চিন্তাভাবনার অনেক গভীর দিক দেখিয়েছে সিরিজটা। আগের সিরিজে অনেকটাই সাক্ষী গোপাল থাকায় অনেকের হয়তো মায়ুশিকে মনে ধরে নি। এবার তাদের আগের চেয়ে মায়ুশিকে বেশী লাগবে আশা করি। আর এতদিন পর ‘তুত্তুরু’ শোনার আনন্দ তো আছেই।

সুজুহা চরিত্রটা এ সিরিজে আরো বেশী গুরুত্ব পেয়েছে। বিশেষ করে কয়েকটা অ্যাকশন সিন দুর্দান্ত হয়েছে সুজুহা আর কাগারির কল্যাণে। আগের সিরিজে সেরকম কোন অ্যাকশনই ছিল না। এবার তো মিলিটারি অ্যাকশন দেখিয়ে আরো ডার্ক হয়ে উঠেছিল সিরিজটা।

নতুন চরিত্রগুলার মধ্যে কাগারিকে অতটা ভাল লাগে নি আমার৷ ওর ‘মমি’, ‘মমি’ শুনতে বেশ বিরক্তই হয়েছিলাম। তবে কাহিনীর সাথে চরিত্রটা বেশ মিশেছিল। আর মাকিসের মত চেহারা হওয়ায় তো রীতিমত বুকটা ধকই করে উঠেছিল প্রথমবার তাকে দেখে।

বেশী ভাল লেগেছে হিয়াজো মাহো চরিত্রটা। মেয়েটা এতই ছোট যে পাঁচ ফুটও লম্বা হবে কিনা সন্দেহ!মাহোর প্রতিনিয়ত নিজেকে মাকিসের সাথে তুলনা করার জায়গাগুলা well written ছিল। সালিয়েরি আর মোজার্টের তুলনাকে রূপক হিসেবে দেখানোটা দুর্দান্ত ছিল। স্টায়েন্স গেইট একটা কল্পবিজ্ঞান এনিমে হলেও এতে যেন জ্ঞানের সব শাখার ছোঁয়া থাকে একটু হলেও৷ তো মাহোর প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
মাহোর সাথে ভাল একটা ডেভেলপমেন্টই দেখানো হল ওকাবের৷ আমি ভাবছিলাম ক্যানন লেভেলের একটা শিপিংই কি শুরু করেছি নাকি! জিনিসটার মীমাংসা যেভাবে হয়েছে সেটা আমার খারাপ লাগে নি। মাহো খুব সুন্দর করে মিশে গিয়েছিল ফিউচার গ্যাজেট ল্যাবরেটরির সাথে।

আগের সিরিজের মত রুকাকোর সাথে ভাল একটা মোমেন্ট ছিল ওকাবের৷ দেখে বেশ আবেগপ্রবণই হয়ে পড়েছিলাম। মাঝে মাঝে মনে হয় রুকাকোর সাথেই মনের মিল হোক ওকাবের! (সমস্যা নেই, ভিজুয়াল নভেলে একটা রুট শুধুমাত্র এই দুজনের জন্যই!)

আর যার কথা না বললেই নয় সে হল মাকিসে কুরিসু। কাহিনীতে সশরীরে উপস্থিত না থাকার পরেও প্রেতাত্মার মত আমাকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে চরিত্রটা৷ ওকারিনের মতই সিরিজটার প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে মাকিসের অভাব অনুভূত করছিলাম। আবার আমাডেউসের স্ক্রিনে তাকে দেখে দুধের স্বাদ বিন্দুমাত্র ঘোলে মিটছিল না। উল্টো বারবার মনে পড়ছিল মাকিসে এখন মৃত৷ ভাল রকমের ইমোশানাল ব্ল্যাকমেইল করে ছেড়েছে মাকিসে আমাকে বলতে হবে। ওকারিন যে পর্বে কিছুক্ষণের জন্য আলফা টাইমলাইমে চলে যায় সে পর্বটা এত বেদনাবিধুর ছিল! মাকিসে যেভাবে বেটা টাইমলাইনের ওকাবেকে শান্ত করে ওকে ভবিষ্যতে কী করতে হবে তা বুঝিয়ে দিয়েছিল সেটা খুব ভাল লেগেছিল৷ এর মাধ্যমে মাকিসে কুরিসু আবারও বুঝিয়ে দিল সে কেন এত জনপ্রিয় হওয়ার যোগ্য। ভাল থাকুক আমাদের ওয়াইফু সে যেখানেই থাকুক না কেন!

স্পয়লার অ্যালার্ট 
*
*
*
*
*
জিরোর একটা ভাল দিক ছিল যেখানে স্টায়েন্স গেইটের দুনিয়াটা খুব বিস্তারিতভাবে দেখানো হয়েছে। ২০২৫ আর ২০৩৬ সালের দুনিয়াকে খুব ডিটেইলড দেখানোতে আমরা আরেকটা বিশ্বযুদ্ধের।ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরেছি। ওকারিনের ৩০০০ বার টাইম লিপের জায়গাটা অসাধারণ ছিল। সেই ২০৩৬ থেকে ২০১১ তে ফিরে আসা, তারপর আমাডেউসকে মুছে দিয়ে convergence মোচন করা, তারপর সফলভাবে টাইম মেশিনকে রক্ষা করা; সবই খুব দারুণভাবে দেখানো হয়েছে। আরেকটা চমৎকার দিক ছিল শেষে ওকাবে স্টাইন্স গেইট খুঁজে পেয়েছে কিনা তা পরিষ্কার না দেখানো। লেখকরা বেটা টাইমলাইনের দায়িত্ব দর্শকদের হাতে ছেড়ে দিয়ে দারুণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। অবশ্য স্টাইন্স গেইটের মত এনিমের কাছ থেকে এমন সমাপ্তি আশা করাই যায়!

আর ম্যাড সায়েন্টিস্ট হওয়িন কিয়োমার পূর্ণাঙ্গ আগমন সমাপ্ত হয় ২৩ নং পর্বের শেষ দুই মিনিটে। স্পয়লার অ্যালার্ট থাকার পরেও কেউ যদি এই জায়গাটা পড়ে ফেলেন তাই কিছু লিখলাম না এই ব্যাপারে৷ শুধু বলবো 18000 B.C এর জায়গাটা আমার জীবনে দেখা অন্যতম সেরা এনিমে মোমেন্ট ছিল।
*
*
*
স্পয়লার অ্যালার্ট সমাপ্ত

স্টাইন্স গেইটের ওএসটি নিয়ে কিছু কথা না বললেই নয়। স্টাইন্স গেইট মানেই যেন Ito Kanko, এবারও একগাদা গান ছিল ভদ্রমহিলার। ওপেনিং সং Fatima দারুণ লেগেছে, পরে জানলাম লিরিকের দিক দিয়ে এটা Hacking to the Gate এর উত্তরসূরি। ভালই লেগেছে পুরো সিরিজ ধরে একটা মাত্র ওপেনিং সং রাখায়৷ এন্ডিং দুটোই ভাল ছিল। Last Game, Amadeus সবগুলা গানই ভাল ছিল।

আর নতুন সাউন্ডট্র‍্যাকগুলা অত খেয়াল করি নি তেমন। তবে বরাবরের মত Gate Of Steiner আর Christina ট্র‍্যাক দুটো শুনে শিহরিত হয়েছি৷ শেষের পর্বে আবার Hacking to the Gate ও বেজে উঠেছিল কিছুক্ষণের জন্য! লিরিকসহ Gate Of Steiner এর একটা ইংরেজি বোনাস ট্র‍্যাকও আছে৷ এখনো কানে বাজছে গানটা, লুপ সরাতে পারছি না একদম!

যদিও জানি জাপানি ভয়েস অ্যাক্টিং সবসময়েই উৎকৃষ্ট তারপরেও ২১ পর্ব পর্যন্ত ডাবেই দেখেছি এনিমেটা৷ ফলাফল আবারও কানা হানাজাওয়া আর মামোরু মিয়োনোর ভয়েস মিস! তবে সেটা কোন ব্যাপার না। যে গুটিকয়েক এনিমের ডাব, সাবের সাথে তুলনা করতে পারে তার মধ্যে স্টাইন্স গেইট একটা৷ আমার আবার মায়ুশির ইংরেজি ভয়েসটা বেশী ভাল লাগে কিনা! কানা হানাজাওয়ার ভক্তরা আমাকে মেরে বসবেন না কিন্তু!

রেটিং: ১০/১০

Anohana: The Flower We Saw That Day [রিভিউ] — Shifat Mohiuddin

Anohana 1

এনিমে: Anohana: The Flower We Saw That Day
পর্ব: ১১
স্টুডিও: A-1 Pictures
মুক্তি: ২০১১
MAL রেটিং: ৮.৬

কাহিনী সংক্ষেপ: সিক্সস্থ গ্রেডে পড়া ছয় কিশোর-কিশোরীকে নিয়ে কাহিনীর শুরু। ছয় বন্ধুর তিনজন ছেলে, তিনজন মেয়ে। তারা একে অপরকে ডাক নামেই ডাকে। নাম: জিনতা, মেনমা, আনারু, সুরুকু, ইয়োকিয়াতসু ও পোপ্পো। সমবয়সী আর সব ছেলেমেয়েদের মত তারাও মাঠে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। পুরাতন এক কাঠের কেবিনে তাদের সংগঠনের হেডকোয়ার্টার। তাদের দলের নাম: Super Peace Busters.

অনেকটা তিন গোয়েন্দা বা ফেমাস ফাইভের কথা মনে পড়ছে না? চলুন দেখে আসি এরপর কী হয়।

হুট করে দলের সবচেয়ে উচ্ছল সদস্য মেনমা রহস্যজনক ভাবে মারা যায়। মনমালিন্যে ভেঙ্গে যায় সুপার পিস বাস্টারস। বাকী পাঁচ বন্ধুকে জোড়া দেবার জন্য মেনমা আর রইলো না, সবাই চলে গেল যার যার পথে।

কিন্তু কাহিনীর এখানেই শেষ নয়। দলের নেতা জিনতা হাইস্কুল ফাঁকি দিয়ে অলস দুপুর কাটাচ্ছিল একদিন বসে বসে। হুট করে তার ঘরে এসে হাজির হয় মেনমা! জিনতা তো অবাক, প্রথমে ভেবেছিল অতিরিক্ত গরমের কারণে মরীচিকা বুঝি। পরে ভূত মনে করে ভয়ই পেয়েছিল!

মেনমা আসলে ভূতই বটে। পরকাল থেকেই এসেছে সে। তবে কেনই বা তার পরকাল থেকে এই ইহলোকে আসার দরকার পড়লো! কারণ একটাই: মেনমার শেষ আবদার! মেনমা জানায় যে বেঁচে থাকতে তার একটা অপূর্ণ শখ ছিল। সেটা পূরণ না হওয়ায় সে পরকালে ফিরে যেতে পারছে না অতৃপ্ত আত্মা বলে। জিনতার প্রতি তার একটাই অনুরোধ, যেভাবেই হোক তার এই উইশ পূরণ করতে হবে। মজার ব্যাপার হল সেই ইচ্ছের কথা মেনমা নিজেই মনে করতে পারছে না!

অনুরোধটা কঠিন হয়ে যায় জিনতার কাছে। সুপার পিস বাস্টারসের সবাই প্রায় বিচ্ছিন্ন। সবাইকে একই ছাতার নিচে আনা সম্ভব হবে না সহজে। আরো বড় বিপদ হল মেনমাকে জিনতা ছাড়া আর কেউ দেখতে পায় না। এখন কিভাবে জিনতা বাকী চারজনকে মেনমার কথা বিশ্বাস করাবে! তাই বলে কী বেচারী মেনমার শেষ ইচ্ছাটা পূরণ হবে না!

জানতে হলে এনিমেটার এগারোটা পর্ব পেরিয়ে যেতে হবে মন শক্ত করে।

Anohana 2

প্রতিক্রিয়া:

রোমান্টিক এনিমে তো এই জীবনে কম দেখা হল না। বেশীরভাগ এনিমেতে বন্ধুত্ব জিনিসটা প্রধান থিম থাকে না। বন্ধুতা একপর্যায়ে রাইভাল বা প্রেমের সম্পর্কে গিয়ে গড়ায় জাপানিজ কালচারে। সেই জায়গায় আনোহানা একটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রমী উদাহরণ। আনোহানার আগাগোড়া থিমটাই গড়ে উঠেছে বন্ধুত্বকে নিয়ে।

বাকী চার বন্ধুকে একত্র করতে গিয়ে জিনতা আর মেনমাকে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তা অত্যন্ত বাস্তবিক। না বলা অনেক কথা-আবেগ-অনুভূতি অনেক সময় বন্ধুত্বের কাল হয়ে দাঁড়ায়। সুপ্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাও অনেক সময় দেয়াল তুলে দেয় বন্ধুত্বের মধ্যে। অতিরিক্ত অনুরক্ততা ও লুকিয়ে রাখা ভালবাসা যথেষ্ট একটা সার্কেলের জমাট দেয়ালে ফাটল ধরাতে। কুড়ে কুড়ে খাওয়া অপরাধবোধের কারণে যে অনেকে নিজের বন্ধুদের ছেড়ে চলে যায় তার উদাহরণ অনেক আছে। আর হীনম্মন্যতার মত বড় শত্রু বুঝি বন্ধুত্বের আর নেই।

তো আনোহানার চরিত্রগুলোকে উপরের মোটামুটি সবগুলা সমস্যাতেই ভুগতে দেখা যায়। এনিমেটা শুধুই বন্ধুত্বকে নিয়ে। এনিমেটা শুধুমাত্র এক মৃত বন্ধুর অসম্ভব ইচ্ছাকে পূরণ করার অনেকগুলা মানুষের আত্মগরিমা বিসর্জনের গল্প। ভুল বোঝাবুঝি হতে হতে যখন জিনতার সব প্রচেষ্টা যখন ভেঙে পড়ার যোগাড় তখন বন্ধুত্বের সুতোর টানে সবাই এক হয়। সেই এক হওয়া কি ক্ষণস্থায়ী হবে নাকি চিরস্থায়ী হবে তা বলে দেবে এনিমের গল্পটা। মেনমার অপূর্ণ ইচ্ছা কি আসলেই তাদের এত এত বিসর্জনের যোগ্য কিনা তাও বলে দেবে গল্পটা। সাথে বের আসবে ছয় বন্ধুর মনে লুকিয়ে থাকা যত খেদ-ক্ষোভ-অভিযোগ-বিরাগ আর ভালবাসা।

ব্যক্তিগতভাবে বন্ধুত্ব জিনিসটা মূল থিম হওয়ায় আনোহানা দেখতে আমি আগ্রহী হয়েছিলাম। যদিও চেইন রিয়্যাকশনের মত প্রেমের ব্যাপার ছিল তবে তা বেশী বাঁধা দেয় নি গল্পটা উপভোগের রাস্তায়। এনিমেটা দেখার পর ভয়ানক ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল অন্তরের ভেতরটা। ইচ্ছে করছিল বন্ধুদের সাথে এতদিন যা যা অন্যায় করেছি তার জন্য করজোরে ক্ষমা প্রার্থনা করি। আসলেই আনোহানা আপনাকে এই চিন্তার যোগান দেবে, ইচ্ছে করবে লুকিয়ে রাখা সকল অপরাধবোধের কথা বন্ধুদের বলে দিতে। সেটা যে অবশ্যই একটা খাঁটি কাজ তা শেষ পর্বের সমাপ্তির পর একটা অদ্ভুত পূর্ণতা অনুভবের মাধ্যমে উপলদ্ধিও হবে। দু ফোঁটা অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লেও একে চেপে রাখা উচিত হবে না।

এনিমের গল্প লিখে দিয়েছেন মারি ওকাদা যিনি True Tears, Nagi no Asukara, Anthem of the Heart, Hanasaku Iroha ইত্যাদি এনিমের গল্প লিখে দেবার জন্য খ্যাত। গাদা গাদা মিডিওকোর এনিমের মধ্যে আনোহানার মত কিছু এনিমেই A-1 Pictures এর সবেধন নীলমণি। ভাল কাজ দেখিয়েছে A-1 তা বলতেই হবে। পুরো এনিমেটার অ্যানিমেশনেই একটা আলোকিত ভাব ছিল। বিশেষ করে দিনের বেলার দৃশ্যগুলা ছিল উজ্জ্বল ও মনমাতানো। জঙ্গল, কেবিন, নদী, ব্রিজ, মাঠঘাটের দৃশ্যের অ্যানিমেশন এনিমেটার ইমোশনাল সাইডটাকে ভালভাবে সাহায্য করেছে। রাতের দৃশ্যগুলা আরেকটু ভাল হতে পারতো বলে আমার মতামত। তবে ফায়ারওয়ার্কসের পর্বটার বেলায় এই অভিযোগ খাটবে না।

আর আনোহানা যে জিনিসটার জন্য বিখ্যাত তা হল এর ওপেনিং আর এন্ডিং সং। Aoi Shiori
ওপেনিং সংটা বারবার দেখতাম, বিশেষ করে বাকী পাঁচ বন্ধুর মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা মেনমার ফুল হয়ে যাওয়ার জায়গাটা। গ্যালিলিও গ্যালিলাই ব্যান্ডটা আর নেই, তাদের ভোকালের আরো দুয়েকটা গান শুনেছি, তবে আওই শিয়োরিই সেরা আমার মতে।

এখন আসি এন্ডিং সংয়ের বেলায়। Secret Base Kimi ga Kureta mono- 10 years after ver. নামের এই গানটা শুনে অন্তর কাঁদে নাই এমন দর্শক মনে হয় আর পাওয়া যাবে না। বিশেষ করে প্রতিটা পর্বের একেবারে শেষে এমন জায়গায় গানটা বাজানো শুরু করে দিত যে বুকটা কেঁপে উঠতো প্রতিবারই। শেষ পর্বে ফুল ভার্সনটাই ছেড়ে দেওয়ার পর আর সহ্য না করতে পেরে পজ করে দিয়েছিলাম ভিডিও প্লেয়ার। এনিমের তিন নারী চরিত্রের তিন হেভিওয়েট ভয়েস অ্যাক্ট্রেস কায়ানো আই, তোমাতসু হারুকা আর হায়ামি সাওরির গাওয়া এই জাদুকরী গানের তালে তালে পিচ্চি মেনমা, আনারু আর সুরুকোকে দেখতে খুব ভাল লাগতো। একটা লাইভ পারফরমেন্স আছে এই গানের, দেখলে আবেগে ভেসে যেতে হয়।

আসলে আনোহানা ঐ ধরণের এনিমে যার হয়তো বিধ্বংসী কোন প্লট নেই, ডিরেক্টর সাহেবের ক্যামেরার কারিকুরিও নেই অতটা, মাকাতো শিনকাইয়ের মত সিনেমাফটোগ্রাফি নেই, সিরিয়াস বা ম্যাচিউরড থিমও অল্পই। তারপরেও ইমোশনাল রাইড আর সুন্দর সমাপ্তির জন্য এনিমেটা ভক্তদের মনে মনে অনেক অনেক দিন অক্ষয় হয়ে থাকবে তা নিশ্চিত হয়েই বলা যায়।

Anohana 3

Honey and Clover [Reaction] — Shifat Mohiuddin

Honey and Clover 1

(প্রচুর স্পয়লারযুক্ত পোস্ট, আসলে পুরো পোস্টটাই স্পয়লার। তাই এনিমে যারা দেখেননি তাদের না পড়ার অনুরোধ রইলো)

“বাথবিহীন ছয় তাতামির একটি রুম, কলেজ থেকে দশ মিনিটের হাঁটা দূরত্ব। পঁচিশ বছরের পুরনো বাসা, ভাড়া ৩৮০০০ ইয়েন। দেয়ালগুলো যথেষ্ট পুরু নয় এবং শব্দনিরোধকও নয়। বাসিন্দারা সবাই ছাত্র। পূর্বমুখী হওয়ার কারণে সূর্যের আলোও ভাল পাওয়া যায়। আর্ট কলেজে ভর্তির সুবাদে গতবছর থেকে আমি টোকিওর বাসিন্দা। ক্যাম্পাসের চারদিকটা অনেক খোলা জায়গা দিয়ে ঘেরা থাকায় আমি যারপরনাই অবাক হয়েছি। আরও অবাক হয়েছি আমার নিজের হাতের রান্নার বাজে স্বাদ দেখে। অবাক হয়েছি পাবলিক বাথহাউসের উচ্চমূল্য দেখে এবং গাদা গাদা হোমওয়ার্কের স্তূপ দেখে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এসব এখন আমার নিত্য জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

*

আর্ট কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তাকেমতো ইউতার জীবনের সারসংক্ষেপ হয়তো এটাই। জীবন নিয়ে শূন্য প্রত্যাশাধারী এই সদ্য কৈশোরত্তীর্ণ এই যুবক কিছু একটা খুঁজে পাওয়ার জন্য ভর্তি হয় স্থাপত্যবিদ্যা বিভাগে। কিন্তু সেই মানে আর খুঁজে পাওয়া হয়ে উঠে না। তাকেমতো মনে করে সে প্রতিভাহীন। মধ্যবিত্ত সন্তান হওয়ার কারণে কোন ধরণের বিশাল সাহায্যও তার পেছনে নেই। গ্র‍্যাজুয়েট হয়ে বের হওয়ার পরে নিজের পায়ে দাঁড়াবে এই প্রত্যাশাই তাকেমতোর মফঃস্বলবাসী বাবা-মার।

*

তাকেমতো কিন্তু আবার পিতৃহীন। শীর্ণকায় তাকেমতোর পিতা ছিলেন অনুপ্রেরণাদায়ী। তাকেমতোর শৈশব তাই পিতার স্নেহের ছায়াতলেই কেটে যায়। কিন্তু হাসপাতালে দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকা তাকেমতোর পিতা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তাকেমতোর হাত ধরা অবস্থাতেই। চলে যাওয়ার আগে এগিয়ে যাওয়ার শেষ উপদেশ দিয়ে যান নিজ সন্তানকে। তাকেমতো তাই মাঝেমাঝেই সাইকেলে চড়া অবস্থায় চিন্তা করে সে পেছন দিকে না তাকিয়ে প্যাডাল ঘুরিয়ে কতটুকু আগাতে পারবে। তাকেমতোর মানসপটে তাই বারবার চলে আসে বিকেলের সোনালী আলোতে ঘুরতে থাকা সাইকেলের চাকা। মানসপটে এই দৃশ্য আসার সাথে সাথে তাকেমতো এগিয়ে যেতে না পারার আফসোসে নিমজ্জিত হয়।

*

মেসে থাকা আপারক্লাসম্যান মোরিতা শিনোবু এক রহস্যময় মানুষ। সেই সাথে সে প্রতিভাধরও বটে। ভাষ্কর্য বিভাগের ছাত্র মোরিতা পড়াশুনায় চরম অমনোযোগী। ঠিকঠাকমত প্রথম ক্লাসে উপস্থিত না থাকা এবং গ্র‍্যাজুয়েট থিসিস জমা দেওয়াতে গাফিলতি করায় চার বছরের কোর্স করতে তার আজ সাত বছর লাগছে। এ বছরও তার পাস করা নিয়ে শিক্ষক-সহপাঠী সবাই সন্দিহান। হুটহাট করে উধাও হয়ে যাওয়া এই মানুষটিকে ঘুম থেকে জাগানোর সাধ্য কারোর নেই। প্রতিবার নিরুদ্দেশ অবস্থা থেকে ফিরে আসার পর আশ্চর্যজনকভাবে তার পকেটে মোটা অংকের টাকার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। নিজের চারপাশের মানুষদের নিয়ে আবার ভালই সচেতন এই খেয়ালী মানুষটি। কিন্তু এই সচেতনতার বিন্দুমাত্রও খাবার শেয়ার করার সময় বরাদ্দ থাকে না!

*

তাকেমতোর পাশের রুমে থাকা আরেক আপারক্লাসম্যান তাকুমি মায়ামা। চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মায়ামা ঠান্ডা মাথার অধিকারী। তাদের আরেক শুভাকাঙ্ক্ষী হল মৃৎশিল্পের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী আয়ুমি ইয়ামাদা। মেস থেকে অনতিদূরে বসবাস করেন চিত্রকলার অধ্যাপক হানামতো শুজি। ঘনিষ্ঠতার কারণে তার বাসায় নিয়মিত যাতায়াত তাকেমতো-মায়ামা-আয়ুমিদের। মোরিতাও খুব প্রিয়পাত্র হানামতো-সানের। একদিন হানামতো-সান তার কাজিনের মেয়ে হাগুমি হানামতোর সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দেন। আসল বয়সের চেয়ে দেখতে কয়েক বছর কম মনে হওয়া হাগু-চানের সাথে সবার ঘনিষ্ঠতা হতে সময় লাগে না। ঘটনাস্থলেই তাকেমতোর চেহারায় সদ্য প্রেমে পড়ার চিহ্ন দেখতে পায় মায়ামা। তৈলচিত্রের প্রথম বর্ষের এই ছাত্রীর চেহারা যেন তার মানসপটে তৈলচিত্রের মতই স্থায়ী হয়ে যায়।

তাকেমতো যেন তার অন্যান্য অপ্রস্তুত গুণাবলীর মতে প্রেম প্রকাশেও সদ্য অপ্রস্তুত। তবে আমতা আমতা করে সবার আগে হাগু-চানের সাথে বন্ধুত্ব করে ফেলে সেই সবার আগে। ঘটনাস্থলে তখনই আগমন মোরিতা-সানের। মোরিতার জোরালো আবেদনের কাছে তাকেমতো যেন খড়কুটো মাত্র। আর এখানেই যেন তাকেমতোর থেকে মোরিতার স্বতন্ত্রতা। তাকেমতো যেখানে নিজের পছন্দের কথা বলতে অপারগ মোরিতা সেখানে প্রথম থেকেই স্বতঃস্ফূর্ত। প্রথম থেকেই সে হাগু-চানের সাথে আচরণ করতে থাকে নিজের ইচ্ছেমত। হাগু-চানকে বহুদিনের পরিচিত মানুষের মত সাজাতে থাকে ইচ্ছেমত। ফলে তাকেমতো বিরতিহীনভাবে নিজের ক্ষমতাহীনতা উপলদ্ধি করতে থাকে। সে না পারে মোরিতা সানের মত ৩২০০০ ইয়েনের একজোড়া জুতো উপহার দিতে, না পেরে উঠে এক টুকরো কাঠ থেকে মনে রাখার মত একটা শিল্পকর্ম বানিয়ে হাগু-চানকে দিতে। তাকেমতো বুঝতে পারে তার না আছে অগাধ প্রতিভা, না আছে অর্থনৈতিক প্রাচুর্য। অথচ এই দুটো জিনিসই থাকা মোরিতা-সানের প্রবল উপস্থিতি তাকেমতোর মনে সেই পুরনো প্রশ্নের অবতারণা ঘটায়, “ব্যর্থ প্রেমের কি কোন অর্থ আছে বাস্তবে”।

Honey and Clover 2
*

তাকেমতোর মানসপটে ফিরে আসে আবার সেই সাইকেলের চাকার ছবি। অস্বস্তি কাটানোর জন্য তাকেমতো মফঃস্বলে তার বাড়িতে ফিরে আসে। তাকেমতো তার শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে থাকে। এর মধ্যে হুট করে তাকেমতোর সৎ পিতা এই মৌনাবস্থা ভেঙ্গে দেয়। তাকেমতো তার এই পিতাটির মধ্যে মৃত পিতার উপস্থিতি বিন্দুমাত্র অনুভব করে না। শীর্ণকায় দেহের বদলে এই লোকটি যথেষ্ট শক্তসামর্থ্য, তার পিতার স্বল্পভাষীতার তুলনায় এই লোক যথেষ্ট বাচাল। আড্ডা-গল্পের মাধ্যমে তাকেমতোকে জিইয়ে রাখার চেষ্টা করেন ভদ্রলোক। এত কিছুর পরও বিচলিত তাকেমতোর মনে একটি ঋণাত্মক মনোভাব এসেই যায়, “হাহ, এবার আমার মা একজন শক্তিশালী জীবনসঙ্গীকেই বেছে নিয়েছেন। আগের মত ভুল তিনি আর করেন নি।”

*

এদিকে কেটে যায় দু-দুটো বছর। হানামতো সানের তত্ত্বাবধানে হাগু-চানের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটে। তাকেমতো শেষ বর্ষে পদার্পণ করে। নিজের সামর্থ্য নিয়ে এখনো সন্দীহান সে। মোরিতা-সান এক জরুরী কাজ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যায়। কিছুটা হলেও স্বস্তি আসে তাকেমতোর মনে। হাগু-চানের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ বাড়ে তাতে। হাগু-চানের প্রতিভা আর শিল্পের প্রতি একনিষ্ঠতা দেখে চমকিত হয় তাকেমতো। নিজের গ্র‍্যাজুয়েট থিসিস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তাকেমতো। কিন্তু লক্ষ্যহীন সে ঘোড়াকে ছোটাতে গিয়ে ব্যর্থ হয় তাকেমতো। শিক্ষকদের আন্তরিকতার পরও নিজের তৈরি ‘কৈশোরের মিনার’ নামক স্থাপনাকে তাকেমতো নিজের হাতেই গুড়িয়ে দেয়! অস্তিত্ব সংকটে ভোগা তাকেমতো পুনরায় থিসিস জমার ডেডলাইন পূরণ করতে চাইলে শরীর তাতে আর সায় দেয় না। তাকেমতোকে ভর্তি হতে হয় হাসপাতালে আর অন্যদিকে মোরিতা আমেরিকা থেকে অস্কার নিয়ে চলে আসে! আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার জন্য তাকেমতো তাই কাউকে কিছু না জানিয়েই ঘর ছাড়ে। সাইকেলে প্যাডেল মারতে মারতে তাকেমতো জাপানের একের পর এক এলাকা প্রদক্ষিণ করতে থাকে। অনেক সময়ই বিশুদ্ধ পানির মত প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করার জন্য তাকেমতোকে বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের কাছে অনুরোধ করতে হয়। অনেকে অবশ্য সন্দেহের চাওনি দেয়, তবে বেশিরভাগ মানুষের কাছেই তাকেমতো পায় আন্তরিক ভালবাসা। এক দোকানি মহিলা তো তাকেমতোকে দুপুরের খাবার খাইয়েই তবে ছাড়ে। ব্রিজের গোড়া, পার্কের বেঞ্চ ইত্যাদি হয়ে উঠে তাকেমতোর রাত কাটাবার জায়গা। নদীর তীরে কাপড় শুকাতে দেওয়া ভবঘুরে তাকেমতোর মনে সরল উপলদ্ধি জাগে “হয়তো জাপানে জায়গার অভাব নেই তবে বসবাসের মত ভাল জায়গা কমই আছে।”

*

ক্লান্ত-শ্রান্ত তাকেমতোর সাইকেল একপর্যায়ে মহাসড়কের মাঝপথেই ভেঙ্গে পড়ে। সাইকেল ঠেলে ক্লান্ত তাকেমতো একপর্যায়ে এক শিন্তো মন্দিরের সামনেই ঘুমিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পরে শ্রমিক শ্রেণির মানুষের কোলাহলে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। তাকেমতো পরিচিত হয়ে একদল চিরন্তন ভবঘুরে মানুষের সাথে যারা ঘুরে ঘুরে জাপানের বিভিন্ন বৌদ্ধ আর শিন্তো মন্দিরগুলোর সংষ্কারের কাজ করে। দিনে ৪২০০ ইয়েনের বদলে তাকেমতো কাজ জুটিয়ে নেয় এই দলের সাথে। আর্কিটেকচারের ছাত্র হওয়ায় তাকেমতোর মনে কিছুটা হলেও আকাঙ্ক্ষা ছিল নির্মাণকাজে দক্ষতা দেখানোর ব্যাপারে। কিন্তু সেই আশায় গুড়ে বালি, তাকেমতোর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা তেমন কোন কাজে আসে না তাদের। তাই তাকেমতো দায়িত্ব নেয় রান্নাঘরের। তাকেমতোর হাতের রান্নায় যেন অমৃত খুঁজে পায় নির্মাণশ্রমিকরা। বিশেষ করে বৃদ্ধ লোকগুলার আবেগ তো অতিরিক্ত বেশি ছিল! ফলে কিছুদিনের মধ্যেই তাকেমতো সবার আপন হয়ে যায়। দশদিনের চুক্তিতে কাজ নেওয়া তাকেমতো তাই কোন ফাঁকে চৌদ্দদিন কাটিয়ে ফেলেছে তা উপলদ্ধিই করতে পারে না। পাওনা পঞ্চাশ হাজার ইয়েন নিয়ে সাইকেল মেরামত করতে চাইলে সহৃদয় ম্যানেজার তাকেমতোকে সেই টাকাসহ একটা নতুন সাইকেলই দিয়ে দেন। তিনি টাকা ফেরত নিতে চান না বরং তাকেমতোকে অনুরোধ করেন ভ্রমণ শেষে যেন তাকেমতো যেন তাদের দলের সাথে দেখা করে যায়। একগুচ্ছ ভাল লাগা অনুভূতিকে সম্বল করে তাকেমতো তার উত্তরমুখী যাত্রা আবার শুরু করে। প্যাডাল মারতে মারতে তাকেমতো উপলদ্ধি করে যে, তার মানসপটে থাকা চলতে থাকা সাইকেলের চাকার চিত্র যেন এই চিরভবঘুরে দলেরই প্রতিচ্ছবি। সেখানেই তাকেমতো তার আজীবনের গন্তব্য খুঁজে পায়।
প্যাডাল মারতে মারতে তাকেমতো এক পর্যায়ে জাপানের উত্তর দিকের একেবারে শেষ পয়েন্টে এসে হাজির হয়। সামনে এগুনোর আর জায়গা তাই আর রইলো না, প্যাডেল মেরে কতটুকু যাওয়া সম্ভব তারও যাচাই হয়ে গেল। সুদূর টোকিও থেকে হোক্কাইডো প্রদেশ পর্যন্ত সাইকেল চালিয়ে আসা তাকেমতো এক অদ্ভুত প্রশান্তি নিয়ে বাড়ির পথে প্যাডাল মারতে থাকে। সঙ্গী হল একরাশ বর্ণীল অভিজ্ঞতা এবং কষ্টার্জিত পরিণতবোধ। তাকেমতো তাই আর সেই আগের অগোছানো তরুণ রইলো না।

*

বাড়ি ফেরত তাকেমতোকে পেয়ে সবাই উল্লাসে মাতোয়ারা। মোরিতা সানের অত্যাচারের দিন শেষ, তাকেমতো এখন তার সাথে সমানে পাল্লা দেয়। হাগু-চান মুগ্ধ নতুন এই তাকেমতোকে দেখে। তাকেমতো ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার গ্র‍্যাডুয়েট থিসিস নিয়ে। এক বছর পড়াশুনা পিছিয়ে যাওয়া তাকেমতো যত দ্রুত সম্ভব পড়াশুনা শেষ করে কর্মক্ষেত্রে যোগদান করতে চায়। অন্যদিকে মোরিতা-সান পৃথিবীর অষ্টমাশ্চর্য ঘটিয়ে ফেলেন! দীর্ঘ আট বছর পর অবশেষে তিনি পাস করেই ফেলেন তাও আবার থিসিস জমার ডেডলাইন শেষ হওয়ার বিশ মিনিট আগে! ঘটনার আকস্মিকতায় মোরিতার শিক্ষক, ভাষ্কর্য বিভাগের ইমিরেটাস অধ্যাপক তাঙ্গে-সেনসেই প্রায় স্ট্রোক করে বসেন। ভূপাতিত হওয়া অধ্যাপকের সেবায় যখন সবাই নিয়োজিত মোরিতার মুখে তখন স্মিত হাসি। অধ্যাপক তখন শিক্ষক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে দারুণ এক আবেগী উক্তি করেন, “আসলে আমরা শিক্ষকরা অনেক দুর্ভাগা। যত কিছুই করি না কেন আমরা, ছাত্ররা একদিন ঠিকই পাশ করে বেরিয়ে যায়। একবার পাশ করে গেলেই হল, কবে যে তাদের সাথে আমাদের আর দেখা হবে তার কোন ঠিকঠিকানা থাকে না।”

*

তাকেমতোর গ্র‍্যাজুয়েট থিসিস শেষের পর্যায়ে, মোরিতা-সান নিখোঁজ এইদিকে। আসে প্রত্যাশিত সামার ফেস্টিভাল আর তাকেমতো নিজের ভালোবাসার কথা সরাসরি স্বীকার করে হাগু-চানের কাছে। বলতে গেলে প্রত্যাখ্যাতই হয় তাকেমতো কিন্তু দুঃখ পায় না সে। বরং বুকের উপর থেকে একটা বিশাল ভার নেমে যায় তাকেমতোর। তাকেমতো জানতো ঘটনাটা এভাবেই ঘটবে, সে প্রত্যাখ্যাতই হবে। কিন্তু অব্যক্ত ভালোবাসার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার স্বস্তি তাকেমতোর কাজে নতুন উদ্যম যোগায়। তাকেমতো আর কাপুরুষ রইলো না।

চারদিকে যখন সবকিছু সহজ-সরল গতিতে চলমান তখনই দুর্ঘটনার আবির্ভাব। হাগু-চানের উপর বিশাল বড় কাঁচের পাত আছড়ে পড়ে তুমুল বাতাসের কারণে। থিসিসের যত্ন-আত্তিতে ব্যস্ত তাকেমতো তাই খবর পায় কিছুটা বিলম্বে। ঘটনাস্থলে পৌছে তাই রক্তমাখা কাঁচ ছাড়া কিছুই খুঁজে পায় না তাকেমতো। আতংকের শিহরণ ছড়িয়ে পড়ে তাকেমতোর সারাদেহে। অন্যদিকে হানামতো সেন্সেই তখন হাগু-চানকে নিয়ে হাসপাতালে। হাগু-চানের ডানহাতের আঙুলগুলো সাময়িকভাবে অবশ হয়ে যায়। একজন্য শিল্পীর জন্য হাতের চেয়ে মূল্যবান কিছু হতে পারে না, তাই হাগু-চান সুস্থতার জন্য যেকোন ধরণের চিকিৎসাপদ্ধতির আশ্রয় নিতে রাজী। হানামতো সেনসেই তাই রিহ্যাবের সময় সারাদিন পাশে থাকেন হাগু-চানের। তাকেমতোর থিসিসের কথা মনে করিয়ে তাকে তিনি তাড়িয়ে দেন শিক্ষকসুলভ আচরণ দেখিয়ে। প্রিয় মানুষের আপদকালীন সময়ে পাশে থাকার তাড়না বোধ করে সদাঅপ্রস্তুত তাকেমতো। বাসায় ফেরার সময় ফুলের দোকানে চোখ পড়ে তাকেমতোর। রোগীকে ফুল উপহার দেওয়ার রীতির কথা মনে পড়ে যায় তাকেমতো। কিন্তু ফুলের দাম দেখে হতাশ হয় তাকেমতো। একেকটা ফুলের দামই ৩০০ ইয়েন, তিনটা ফুল কিনতেই ১০০০ ইয়েন চলে যায়। একতোড়া ফুল কিনতে কত লাগতে পেরে ভেবে তাকেমতো দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আর্থিক সমস্যা থাকায় তাকেমতো ভাবে মানসিক সাহায্য দিয়েই সেই হাগু-চানের প্রতি দায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু এক পর্যায়ে এই ক্ষেত্রেও বাঁধার সম্মুখীন হতে হয় তাকেমতোকে। কমপক্ষে দুই মাস রিহ্যাবে থাকতে হবে হাগু-চানকে আর তাকেমতোরও গ্র‍্যাজুয়েশনের দিন ঘনিয়ে এসেছে। পড়াশুনায় অতিরিক্ত মনযোগ দেয়ার সাথে সাথে এপ্রিল মাসে তাকে নতুন কর্মক্ষেত্রেও যোগদান করতে হবে। তাকেমতোর মস্তিষ্কে ভেসে উঠে তার বাবা-মার ছবি যারা কিনা স্বভাবতই তাকেমতোর গ্র‍্যাজুয়েশনের পর স্বাবলম্বী তাকেমতোকে প্রত্যাশা করছেন। অন্যদিকে ভেসে উঠে শয্যাশায়ী হাগু-চানের ভয়ার্ত চেহারার ছবি। কাজে যোগদান করা মানেই হাগু-চানের কাছ থেকে দীর্ঘ সময়ের জন্য আলাদা হয়ে যাওয়া। এইরকম বহুমাত্রিক সমস্যায় ভোগা তাকেমতো এক সময় হাগু-চানের পাশে থাকার কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়।

*

তখনই দৃশ্যপটে মোরিতা-সানের আগমন। এক বিকেলে হুট করে হাগু-চানকে নিয়ে মোরিতার অন্তর্ধান। চিন্তিত হানামতো সেন্সেইকে আশ্বস্ত করে তাকেমতো। আবেগঘন এক রাত্রি যাপনের পর হাগু-চান ভালবাসার উপরে হয়তো শিল্পপ্রেমকেই বেছে নেয়। হানামতো সেন্সেই তাই আজীবন হাগু-চানের পাশে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। তাকেমতোর মত তাই মোরিতাও হয় প্রত্যাখ্যাত। নদীর তীরে দুইজনের মধ্যে হয়ে যায় তাই তীব্র বাদানুবাদ। তাকেমতো যেন ব্যর্থ প্রেমের ভার চাপিয়ে দিতে চায় মোরিতার উপরেও, মোরিতা আবার এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে চায় না। এক পর্যায়ে দুইজনেই বুঝতে পারে যে তারা একই গোয়ালের গরু এবং হাঁপাতে হাঁপাতে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে থাকা অবস্থায় সন্ধি করে নেয়।

*

সময় গড়িয়ে যায় এবং এক পর্যায়ে তাকেমতোর কর্মক্ষেত্রে যোগ দেওয়ার সময় ঘনিয়ে আসে। এক আবেগঘন পার্টির মাধ্যমে যাত্রার আগের রাতে তাকেমতো সকলের কাছ থেকে বিদায় নেয়। সকালে ট্রেনে চেপে বসে তাকেমতো। বগিতে অন্য কোন যাত্রীর অস্তিত্ব না দেখে তাকেমতো দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তখনই স্টেশনে হাগু-চানের ছোট্ট দেহের অবয়ব দেখা যায়। তাকেমতো দৌড়ে ট্রেনের দরজার কাছে পৌছে। হাগু-চান একটা বেন্তো বক্স ধরিয়ে দেয় তাকেমতোর হাতে। অনেক কিছু বলতে চায় হাগু-চান কিন্তু অটোমেটেড দরজার লক হয়ে যাওয়ার শব্দে হাগু-চানের অব্যক্ত অনুভূতি ঢাকা পড়ে যায়। প্ল্যাটফর্মের গোড়া পর্যন্ত হাগু-চান দৌড়ে এসে তাকেমতোকে হাত নেড়ে বিদায় জানায়। এই পাগলামির কোন অর্থ খুঁজে না পেয়ে তাকেমতো স্মিত হাসি হেসে বেন্তো বক্সটা খুলতে থাকে। একগাদা পাউরুটি দেখে তাকেমতো অবাক হয়। উপরের পাউরুটিটা সরানোর পর তাকেমতো নিচের স্তরে মধু মাখানো দেখে আনমনে হেসে উঠে। কিন্তু ভাল করে লক্ষ্য করার পরে তাকেমতো পাউরুটির মধ্যে একটা ফোর-লিফড ক্লোভার দেখতে পায়। একটার পর একটা পাউরুটি উল্টানোর পর তাকেমতো একটা করে মধুমাখানো ফোর-লিফ ক্লোভারের দেখা পায়। আনমনা সেই হাসি রূপ নেয় আবেগের কান্নায়। হাগু-চানের ভালবাসার নিদর্শন সেই পাউরুটি হাতে নিয়ে কান্নাজর্জরিত তাকেমতো সেই মুহূর্তেই ব্যর্থ প্রেমের স্বার্থকতা খুঁজে পায়। জন লেননের সেই উক্তিটাই হয়তো তখন নেপথ্যে বাজতে থাকে,
“The Time you enjoyed wasting, is not wasted”.

*

আমাদের জীবনটা হয়তো এই হানি আর ক্লোভারের মতোই। মধুর প্রলেপ দেয়া সুখকর অনুভূতির সমান্তরালে আমাদের জীবনে আগাছাময় ভুলে যেতে চাওয়া মুহূর্তও আসে। মাত্র ৩৬ পর্বের এনিমেটাতে রীতিমতো কাব্যিকভাবে সাত-আটটি প্রধান চরিত্রের মধু-আগাছাময় জীবনগাথা পরিবেশন করা হয়েছে। এক তাকেমতো-হাগু-মোরিতার ত্রিভুজ সম্পর্ককে নিয়েই এত বকবক করতে হয়েছে! মায়ামা-আয়ুমি-নোমিয়া, মায়ামা-রিকা, রিকা-হানামোতো-হারাদা, মোরিতা ভাতৃদ্বয়ের ব্যাপারে কিছু বলতে গেলে একেবারে থিসিস পেপার নিয়ে বসা লাগবে। মাঙ্গাকা উমিনো চিকাকে মন থেকে আন্তরিক অভিনন্দন এত নাটকীয়, ভালোবাসাপূর্ণ একটি জগতের সাথে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। এনিমেজীবনের অন্যতম সেরা একটা এনিমে দেখে শেষ করে ফেললাম।

Shakugan no Shana [রিভিউ] — Shifat Mohiuddin

Shakugan no Shana 1

এনিমে: Shakugan no Shana
পর্ব: ৭২ + specials
সিজন: তিন (২৪+২৪+২৪)
স্টুডিও: J.C. Stuff
জনরা: ফ্যান্টাসি, অ্যাকশন, সুপারন্যাচারাল

লাইট নভেল থেকে বানানো এনিমেগুলা খুবই দুর্ভাগা হয়। অ্যানিমেটররা বার-তের পর্বের একটা সিজন বানিয়ে সেটাকে নভেলের বিক্রি বানানোর টোটকা হিসেবে বাজারে ছেড়ে দেন। এরপর ফ্যানদের শত আবদার-আকুতি তাদের কানে ঢোকে না।
তো শাকুগান নো শানা এনিমেটার নাম কালেভদ্রে গ্রুপে দেখেছিলাম। সবাই পজিটিভ মন্তব্যই করতো এনিমেটা নিয়ে কিন্তু আগ্রহ খুঁজে পাই নি দেখার।

দেখার আগ্রহ এক মুহূর্তে বেড়ে যায় যখন জানতে পারি এনিমেটা তার সোর্স ম্যাটেরিয়াল অর্থাৎ এলএনকে পুরোপুরি অ্যাডাপ্ট করেছে। এলএনের পুরো এনিমে হওয়া জিনিসটা অমাবস্যার চাঁদের মত। এ পর্যন্ত মাত্র দুটো সিরিজ পেয়েছি এই গোত্রের: Durarara! ও Golden Time. পরে দেখি সিজন তিনটা, পর্বও অনেক, ৭২টা! এই বাণিজ্যের যুগে তো এমন জিনিস দেখা যায় না! তাই দেরী না করে দেখা শুরু করে দেই।

প্লট: শানার শুরুটা একেবারেই মার্কামারা। হাইস্কুল পড়ুয়া কিশোর সাকাই ইউজির জীবন ঠিকঠাক মতই চলছিল। একগাদা বন্ধু, ঢাল বেয়ে প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া, বাসায় ফিরে আসা এইতো। কিন্তু একদিন হুট করে ইউজি নিজেকে এক বিশাল অতিপ্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে আবিষ্কার করে। ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে বাসায় ফেরার সময় ইউজি একদিন দেখতে পায় তার চারপাশের সব মানুষ স্থির হয়ে গেছে। দুঃস্বপ্নের মত সে দেখতে পায় তার চারপাশের সব মানুষকে কিছু দানব খেয়ে ফেলছে। ইউজি দৌড়ে পালাতে গেলে সে একটা দানবের নজরে পড়ে যায় এবং পাকড়াও হয়। দানবের দাঁত আর সে যখন কয়েক ফুট দূরে তখন কালো একটা অবয়ব দৌড়ে এসে তাকে রক্ষা করে। ধীরস্থির হওয়ার পর ইউজি দেখতে পায় অবয়বটা তার সমবয়সী একটা লালচুলো মেয়ের। মেয়েটার হাতে ইয়া লম্বা এক কাতানা ও গলায় একটা লকেট। লকেট থেকে আবার কণ্ঠস্বরও ভেসে আসছে একটা!

শীঘ্রই ইউজি জানতে পারে সে হাজার বছর ধরে লুকিয়ে থাকা এক সত্য জানতে পেরেছে। দানবগুলোকে তোমগারা বলা হয় যারা Guze নামের এক প্যারালাল ইউনিভার্সের বাসিন্দা। তারা তাদের খিদে মেটানোর জন্য এই দুনিয়াতে এসে মানুষের আত্মা খেয়ে যায়। আর এই তোমোগারাদের ঠেকানোর জন্য আছে মেয়েটির মত আরো অনেক যোদ্ধা। এই যোদ্ধাদের Flame Haze বলে। ফ্লেইম হেইজ, তোমোগারাদের মেরে পৃথিবীর ভারসাম্য বজায় রাখে। কাতানাওয়ালা মেয়েটি নিজেকে Red Hot Eyed Burning Haired Shana বলে পরিচয় দেয়।

ইউজি আরো জানতে পারে তার মধ্যে একটি বিশেষ অস্ত্র আছে যার কারণে দলে দলে তোমোগারা তার পেছনে ছুটে আসতে পারে। তোমোগারারা পৃথিবীতে আসলেই Fuzetsu নামের এক ধরণের জাদু প্র‍য়োগ করে। যার ফলে গুজে ও পৃথিবীর মধ্যে একটা মাঝামাঝি জায়গার উদ্ভব হয়। সাধারণ মানুষ ফুজেতসুর মধ্যে চলাফেরা করতে পারে না তাই শিকার করা সহজ হয়। ইউজি ফুজেতসুর মধ্যেও নড়তে পেরেছিল সেই বিশেষ জিনিসের জন্যই। শানা জানায় ইউজি একজন মিস্টেস (Mistes). আস্তে আস্তে শানা ও ফ্লেইম হেইজদের দুনিয়ার মধ্যে ইউজি জড়িয়ে পড়তে থাকে। অন্যান্য ফ্লেইম হেইজ ও তোমোগারাদের মধ্যের দ্বন্দ্বে ইউজি ও শানার ভূমিকা নিয়েই এনিমেটার কাহিনী।

Shakugan no Shana 2

আসলে এত ছোট সিনোপসিস দিয়ে শানার কাহিনী বোঝানো সম্ভব নয়। ছাব্বিশ ভলিউমের লাইট নভেলকে এনিমে বানানো হয়েছে তাই গল্পের গভীরতা অনেক বেশী। পুরো নারুতো সিরিজের কাহিনী যেমন স্পয়লার ছাড়া বোঝানো সম্ভব নয়, শানার ব্যাপারেও তা প্রযোজ্য।

শাকুগান নো শানার মধ্যে একসাথে স্লাইস অফ লাইফ ও ফ্যান্টাসি, দুই এলিমেন্টের চর্চাই করা হয়েছে। প্রথম দিকে দুটো জিনিস ভালমত খাপ খাচ্ছিল না কেন জানি। খুব গতানুগতিক মনে হচ্ছিল এনিমেটা। ইউজিকে মনে হচ্ছিল বোকাসোকা, ভোলাভালা টাইপের গতানুগতিক এলএন নায়কগুলোর মত। শানাকেও সুন্দেরে গোছের মাথা গরম পিচ্চি ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছিল না। খারাপ ইমপ্রেশনটা বাড়ানোর জন্য এনিমেটার ক্যারেকটার আর্টও দায়ী। সবার চেহারা এত বাবু মার্কা যে বিশ্বাসই হচ্ছিল না এই দুনিয়াতে প্রতিনিয়ত মানুষের আত্মা দানবদের পেটে যাচ্ছে।

এনিমেটার উন্নতি ঘটে নতুন নতুন চরিত্র আসার পরে। প্রথম ভিলেন হান্টার ফ্রিয়াগনের সাথে লড়াই পর্যন্ত এনিমেটা দেখে নিয়মিত হাই তুলছিলাম সত্য বলতে। নয়া ফ্লেইম হেইজরা আসার পরে সিরিজটার রস বাড়ে। তাদের বর্ণনায় আস্তে আস্তে গুজে ও পৃথিবীর মেকানিজম উঠে আসে দর্শকদের সামনে। সুন্দরী কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীন ফ্লেইম হেইজ মারজরী দো আর শানার অভিভাবিকা উইলহেলমিনা কারমেলের আগমনের পরে সিরিজটা প্রাণ পায়। নতুন নতুন ভিলেনরাও আসতে শুরু করে। এক ফাঁকে শানার ব্যাকস্টোরিও দেখানো হয়। তাই এক পর্যায়ে হাই তোলা বন্ধ করে মনযোগ দিয়ে এনিমেটা দেখা শুরু করি।

শাকুগান নো শানার যেসব গুণাবলি আমার চোখে পড়েছে তা পয়েন্ট আকারে নিচে উল্লেখ করছি:

১. রহস্য ও অজানাকে লুকিয়ে রাখা। এই জায়গায় এনিমেটা খুবই সার্থক। তিন সিজন জুড়ে যখনই ভেবেছি আর কিছু নিশ্চয়ই বাকী নেই, তখনই নতুন একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে এনিমের গল্পটা।

২. পাওয়ার সিস্টেমের কোন বালাই না থাকা। বিষয়টা নেতিবাচক হলেও শাকুগান নো শানার ব্যাপারে খুবই কাজে দিয়েছে। এনিমেটাতে ফাইট সিনের অভাব নেই কিন্তু কোনটাতেই আগে থেকে বলা যায় নি অমুকের চেয়ে অমুক বেশী শক্তিশালী। তুরুপের তাস বের করা চলতেই থাকে কিন্তু দুই পক্ষই এত পাওয়ারফুল যে সমস্যা হয় না তেমন কোন। লেভেল আপ নামের কিছুই নেই এনিমেটাতে কারণ তোমোগারা ও ফ্লেইম হেইজদের বয়স কয়েকশো বছর। তাই তাদের ক্ষমতার কৌশলগত ব্যবহারটাই ছিল মুখ্য।

৩. ভিলেনদের বিল্ডআপ জিনিসটা শানাতে দুর্দান্ত হয়েছে। সাধারণত ফ্যান্টাসি এনিমেতে প্রথমে ছোট ছোট তারপর শেষে একেবারে ভিলেন অর্গাইনাইজেশনের রাঘব বোয়ালদের সাথে লড়াই শুরু হয়ে যায়। ফলে দেখা যায় প্রত্যাশা জাগিয়েও রাঘব বোয়ালরা দর্শকদের অনুভূতির জায়গাটায় স্থায়ী হয়ে থাকতে পারেন না। শানাতে মেইন ভিলেনরা একেবারে শুরুর দিকেই ধর্না দিয়ে যায়। তারপর বারবার তাদের আগমন ঘটতেই থাকে। কোনবারেই তাদের অনেক শক্তিশালী আবার একেবারে দুর্বল দেখানো হয় নি। ফলে তাদের ক্ষমতা নিয়ে একটা দুশ্চিন্তা গড়ে উঠলেও দর্শকরা নিশ্চিত হতে পারেন এই ভেবে যে তাদের হারানো সম্ভব।

৪. শানাতে ফ্লেইম হেইজ ও তোমোগারাদের মধ্যে খণ্ড যুদ্ধ প্রচুর হলেও লেখক আমাদের বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন যে কোন লড়াইই বিচ্ছিন্ন নয়। দৃশ্যপটের আড়ালে যে বিশাল কোন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ভিলেনরা করে যাচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছিল। প্রতিটা লড়াইয়েই ভিলেনদের গুপ্ত উদ্দেশ্য ছিল তাই যতবারই তারা হেরে যাক না কেন তাদের বৃহৎ পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয় নি। পরে এর ব্যাপকতা টের পাওয়া যায় থার্ড সিজনে।

৫. শাকুগান নো শানা ঐ ধরণের এনিমের অন্তর্গত যার গল্প সময়ের সাথে সাথে ভাল হতে থাকে। বর্তমান সময়ের লম্বা এনিমেগুলা ভয়াবহ ভাবে এই গুণবর্জিত। সেকেন্ড সিজনে কাহিনীটা বেশ জমজমাট হয়ে যায়। তারপরেও সমাপ্তিটা বেশ ম্যাড়মেড়ে লাগছিল। বন্ধু তখন মুখ চেপে হেসে খালি বলেছিল থার্ড সিজনের প্রথম পর্ব দেখে তাকে একটু জানাতে। দেখে তো পুরো মাথা ঘুরে যাওয়ার মত অবস্থা। পুরো এনিমের প্রেক্ষাপটই বদলে গিয়েছিল। কে ভিলেন কে নায়ক তা ঠাহর করা কঠিন হয়ে গিয়েছিল। সাধারণ একটা গল্প যে in universe build up এর কারণে অসাধারণ হতে পারে তা টের পেলাম।

৬. আর সবচেয়ে ভাল লাগা ব্যাপার হল শেষ ভিলেনের দুর্দান্ত ফিলোসফি। বেশী কথা বললে স্পয়লার হয়ে যাবে তাই এতটুকুই বলে রাখি, মাদারা উচিহার সাথে বেশ মিল আছে ভিলেনের। মিলটা আদর্শিক ও ক্ষমতা দুই জায়গাতেই আছে। এন্ডিংটাই একেবারে সলিড, সন্তুষ্টি নিয়েই শেষ করতে পেরেছে। নারুতো শিপ্পুডেনের সমাপ্তিটা এরকম সন্তোষজনক করতে পারলে মন্দ হতো না।

Shakugan no Shana 3

অ্যানিমেশন নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক। ফুজেতসুর সময় একটা নির্দিষ্ট রঙের প্রাধান্য থাকে বলে অপার্থিব ভাবটা খুব ভালভাবে ফুটে উঠে দুই দুনিয়ার সংঘর্ষের সময়। পুরো এনিমের বাজেট আসলে ফাইট সিনের পেছনেই খরচ করা হয়েছে বোঝা যায়। বেশীরভাগ অ্যাকশনই শূণ্যে তাই কোরিওগ্রাফির বালাই ছিল না। থার্ড সিজনে প্রচুর সিজি ছিল। খারাপ লাগে নি যদিও তবে গড অফ ডেস্ট্রাকশনের মূল বডির অ্যানিমেশন জঘন্য ছিল। সেইরেই-দেনকে এমন ভাবে সাজিয়েছিল যে মনে হচ্ছে সাইন্স ফিকশন কোন এনিমে দেখছি। প্রতিটা ফ্লেইম হেইজের ব্যাটল গিয়ারে পরিবর্তিত হওয়ার জায়গাগুলা খুব ডিটেইলে বানানো হয়েছে। বিশেষ করে শানার অগ্নিবর্ণ চুলের ফুলকি ছড়ানো দেখার মত ছিল।
অন্যদিকে সব বাজেট এইদিকে নিমগ্ন হওয়ায় বাসাবাড়ি ও হাইস্কুলের অ্যানিমেশনগুলা একেবারেই মার্কামারা ছিল। পিচ্চি পিচ্চি ক্যারেকটার ডিজাইন দেখে বিপুল বিরক্ত হয়েছি।

চরিত্রদের ব্যাপারে বলতে গেলে লিখে শেষ করা যাবে না। ভিলেন এবং নায়ক, উভয় দিকেই বিশাল সংখ্যাওয়ালা কুশীলব ছিল। এমনিতে শানা আর ইউজিকে সবারই ভাল লাগার কথা। থার্ড সিজনে দুজনের মানসিক পরিপক্বতার প্রদর্শনী খুব উপভোগ করেছি। ইয়োশিদা কাজুমিকে প্রথম দিকে বিরক্তিকর লাগলেও পরে ভালই লেগেছে। মারজরি সান আর মার্কোশিয়াসের রসায়ন চমৎকার ছিল। ইউজির বন্ধুদেরও ভাল লেগেছে। তবে আসল ওয়াইফু ছিল উইলহেলমিনা কারমেল, তার প্রেমে বিভোড় ছিলাম পুরো সিরিজটা দেখার সময়। (অবশ্যই কারণ, একজন অনুগত ব্যাটল মেইডের চেয়ে ভাল আর কিছু হতে পারে না। )
ভিলেনদের মধ্যে বেশী ভাল লেগেছে বেল-পেওল আর সাবরাককে। সাবরাক একেবারে আসল অ্যান্টি-হিরো ছিল। ওর ব্যাকস্টোরিটা আরো দেখাতে পারতো।
আর অবশ্যই ফাইনাল ভিলেন, তাকে ভাল না লেগে উপায় নেই। Seeking Researcher, Dandalion সেই বিনোদনের একটা চরিত্র ছিল। ডমিনোওওও বলে যে কি চিল্লাচিল্লিগুলা করতো। 

মিউজিক ডিরেক্টর Kow Otani. ভদ্রলোকের কাজ দেখেছিলাম এর আগে Another এ। শানাতেও বেশ কিছু ভৌতিক টেনশন জাগানিয়া ট্র‍্যাক আছে। তবে তার ব্যাটল থিমগুলাই ভাল লেগেছে বেশী। পুরনো পুরনো ভাব ছিল সাউন্ডট্র‍্যাকগুলাতে। ভায়োলিন ভিত্তিক মিউজিক ছিল বেশী। থার্ড সিজনে choir মিউজিকের আমদানি ঘটানোয় বলতে পারি এনিমের সাথে সাথে এর ওএসটিরও ক্রমাগত উন্নতি হয়েছে।

ওপেনিং-এন্ডিং ছিল একগাদা। সবচেয়ে ভাল লেগেছে থার্ড সিজনের ফার্স্ট ওপেনিং Light My Fire. গানের বিটের তালে তালে শানার দৌড়ানোর দৃশ্যটা চমৎকার ছিল।

সব মিলিয়ে ফ্যান্টাসি এনিমে হিসেবে শাকুগান নো শানা বেশ ভাল একটা অভিজ্ঞতা দিয়ে গেল। হাইস্কুলপড়ুয়া একগাদা চরিত্র, নায়ককে নিয়ে মেয়েদের মধ্যে টানাটানি ইত্যাদি নেতিবাচক দিক থাকলেও আস্তে আস্তে কাহিনীর জোরে সব অতিক্রম করে ভাল একটা অভিজ্ঞতা উপহার দিয়েছে। ফ্লেইম হেইজ হওয়ার কারণে ভালবাসার মত একটি মানবিক অনুভূতি শানার অজানা ছিল। এটি আবিষ্কার করতে গিয়ে অনেক ক্লিশে দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল এনিমেটার প্রথম দিকে। অথচ শেষে ইউজি আর শানার আলিঙ্গনের দৃশ্য দেখে বুঝতে পারি কোন কিছুই বৃথা যায় নি। এই একটা ঘটনাই এনিমেটার ধাপে ধাপে উন্নতির বড় একটা সাক্ষী। সব মিলিয়ে মনে রাখার মত একটা অভিজ্ঞতা দিয়ে গেল এনিমেটা। এরকম ভাল এন্ডিংওয়ালা আরো ফ্যান্টাসি এনিমে আসুক এই প্রত্যাশা করি।

রেটিং: ৮/১০
থার্ড সিজন রেটিং: ৯/১০