আচ্ছা, এবার আমি দুটো চরিত্রকে একসাথে উঠিয়ে আনতে চাচ্ছি লেখাতে। চরিত্র দুটোই গ্রীক মিথের অন্তর্ভুক্ত। ফেইট/অ্যাপোক্রিফা যেহেতু এখন খুব হাইপড মোমেন্টে আছে তাই ভাবলাম এখনই সময় দুইজনকে নিয়ে আলোচনা করার।
প্রতিটি ফেইট সিরিজেই একজন আরেকজনের সাথে পূর্ব পরিচিত এমন একাধিক সারভেন্টের দেখা পাওয়া যায়। ফেইট জিরোতে ছিল আর্থুরিয়া-ল্যান্সেলট, স্টে নাইট আর UBW তে ছিল গিলগামেশ-আর্থুরিয়া। অ্যাপোক্রিফাতেও এর ব্যতিক্রম হল না। হ্যাঁ, আজকের পোস্ট পূর্ব পরিচিত গুরু-শিষ্য যুগল কেইরন আর অ্যাকিলিসকে নিয়ে। দুইজনের কাহিনীই গ্রীক সাহিত্যের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে। দুইজনই দেবতাদের আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন, যুগে যুগে তাদের নিয়ে অসংখ্য কাব্য, নাটক ও চিত্রকর্ম রচিত হয়েছে। আধুনিক সাহিত্য ও অন্যান্য শিল্পকর্মেও তাদের নিয়মিত আবির্ভাব দেখা যায়। যেহেতু মিথ এবং এনিমে দুই জায়গাতেই তারা খুব ডিপলি কানেক্টেড তাই এক পোস্টেই তাদের অতীত নিয়ে আলোচনা করবো।
শুরুর আগে বলে রাখি, কেইরন আর অ্যাকিলিস দুজনই সম্পূর্ণ মিথিকাল চরিত্র। তাদের ঐতিহাসিক সত্যতা নেই বললেই চলে। কেইরন তো মানুষ নন তাই তার অস্তিত্ব থাকার প্রশ্নই উঠে না। অ্যাকিলিসও কাল্পনিক চরিত্র তবে ট্রয় যুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রমাণাদি থাকায় অ্যাকিলিসের মত বড় কোন বীরের অস্তিত্ব থাকার বিষয়টি পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ধারণা করা হয় একাধিক বীরের বীরত্বগাথা যোগ করে গ্রীক কবিরা অ্যাকিলিসের গুণকীর্তন করেছেন।
চরিত্র: কেইরন (Chiron)
এনিমে: Fate/Apocrypha
ভূমিকা: মধ্যমপন্থী
জাতীয়তা: ? (পেলিয়ন নামক এক পর্বতে বাস করতেন)
জন্মস্থান: জানা যায় নি
জন্ম ও মৃত্যুসাল: জানা যায় নি
চরিত্র: অ্যাকিলিস (Achilles)
এনিমে: Fate/Apocrypha
ভূমিকা: মধ্যমপন্থী
জাতীয়তা: গ্রীক (থেসেলিয়ান)
জন্মস্থান: থেসেলি, গ্রীস
জন্ম ও মৃত্যুসাল: জানা যায় নি
যেহেতু শিক্ষক তাই কেইরনকে দিয়েই শুরু করি। সবাই জানি কেইরন মানুষ নন, তিনি একজন সেন্টর। সেন্টররা এক ধরণের পৌরাণিক প্রাণী যাদের শরীরের অর্ধেক ঘোড়া আর অর্ধেক মানুষের মতন। সেন্টররা মারাত্মক অশিক্ষিত, উশৃঙ্খল, মদ্যপ, ধর্ষকামী জাতি হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু কেইরন অন্যান্য সেন্টরদের চেয়ে আলাদা ছিলেন। এর কারণ জানতে চাইলে সেন্টরদের উৎপত্তি নিয়ে আলোচনা করতে হবে।
সেন্টরদের জন্ম হয়েছিল খুব অদ্ভুতভাবে। ইক্সিওন নামের একজন রাজা একবার দেবী হেরার (জিউসের স্ত্রী) প্রতি খুব প্রলুব্ধ হয়ে পড়েছিল। জিউস তাই ইক্সিওনের সাথে একটু কৌতুক করে বলা যায়। জিউস ধুলা আর মেঘের সমন্বয়ে হেরার মত দেখতে একটি আকৃতি তৈরি করে। ইক্সিওনের সাথে এই আকৃতির মিলনের ফলে যেসব প্রাণীর জন্ম হয় তাদের শরীরের নিচের অংশ ঘোড়ার মত আর উপরের অংশ মানুষের মত ছিল। এদের বংশধরেরাই পরে সেন্টর নামে পরিচিতি লাভ করে।
কেইরনের জন্ম এসব সেন্টরদের মত হয় নি। আসলে সেন্টরদের জন্মের অনেক আগেই কেইরনের জন্ম হয়েছিল। টাইটানদের শাসক ক্রোনোস (জিউসের বাবা) একবার ফিলাইয়া নামের এক মৎসকন্যার সাথে ঘোড়ার রূপ ধরে জোর করে মিলিত হন। (এইসব অস্বাভাবিক সম্পর্ক গ্রীক মিথে স্বাভাবিকই বলা যায়!) ফিলাইয়ার গর্ভেই কেইরনের জন্ম হয়। আর কেইরনের দেহের নিম্নাংশের আকার হয় ঘোড়ার মত। টাইটানের ঔরসে জন্ম নেওয়ায় কেইরনের বুদ্ধিমত্তা উচ্চপর্যায়ের ছিল। গ্রীক মিথে খুব কম সংখ্যক বুদ্ধিমান সেন্টরের অস্তিত্ব পাওয়া যায় আর কেইরন ছিলেন তাদের মধ্যে সর্বাধিক বুদ্ধিমান। কেইরনের দৈহিক আকৃতিও অন্য সেন্টরদের চেয়ে ভিন্ন ছিল। বিভিন্ন চিত্রকর্মে দেখা যায় যে, কেইরনের সামনের পা দুটো মানুষের যেখানে অন্য সেন্টরদের চারপাই ঘোড়ার মত ছিল।
কেইরনের শৈশব-কৈশোর সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় নি। শৈশবে অ্যাপোলো ও আর্টেমিসের সঙ্গ কেইরনের শান্তিপ্রিয় ও যৌক্তিক চরিত্র গড়ে তোলার পেছনে ভূমিকা রাখে। কেইরন সেন্টর-মানুষ উভয়ের কাছেই শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। সেন্টরদের সাথেই তিনি বসবাস করতেন এবং মাউন্ট পেলিয়নে তিনি অন্য অসভ্য সেন্টরদের সাথে বিতাড়িত হয়ে আসেন। কেইরন অন্য সেন্টরদের সভ্য করার চেষ্টা চালাতেন। বর্ষীয়ান হওয়ায় মানুষের সাথে কেইরনের পরিচয় কিভাবে হয়েছিল তা জানা যায় না। কয়েক পুরুষ ধরে অসংখ্য বীর কেইরনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছে তাই তার বয়স ও কালও আন্দাজ করা যায় না।
একজন দক্ষ সমরবিদ, জ্যোতিষী ও চিকিৎসক হলেও কেইরনের মূল পরিচিতি ছিল শিক্ষক হিসেবে। অসংখ্য মানুষ তার কাছে যুদ্ধবিদ্যার শিক্ষা নিয়েছিল। পার্সিয়াস, থিসিয়াস, ইনিয়াস, অ্যাজাক্স, জ্যাসন (স্টে নাইটের মিডিয়ার স্বামী), হেরাক্লস (হারকিউলিস), অ্যাকতিওন সহ অনেক বড় বড় বীর কেইরনের নিজের হাতে গড়া। এছাড়া উদ্ভিদবিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্রের একজন আদি পথপ্রদর্শক হিসেবে কেইরনকে কৃতিত্ব দেয়া হয়।
অ্যাকিলিসের কাছে আসা যাক। এই শিক্ষকতার সুবাদে অ্যাকিলিসের সাথে কেইরনের পরিচয়ের সূত্রপাত ঘটে। অ্যাকিলিসকে চেনে না এমন কেউ গ্রুপে মনে হয় না আছে। ট্রয় সিনেমার ব্র্যাড পিটের দুর্দান্ত অভিনয় কে ভুলতে পেরেছে! অ্যাকিলিসকে সহজেই গ্রীক মিথের সবচেয়ে জনপ্রিয় বীর বলা যায়। অ্যাকিলিসের মত সুদক্ষ যোদ্ধা, বক্তা ও নেতা কমই আছে গ্রীক সাহিত্যে। শৌর্য-বীর্যে অ্যাকিলিস অনন্য আর সবচেয়ে সুদর্শন বীর হিসেবেও অ্যাকিলিস স্বীকৃত। এনিমেতে অ্যাকিলিসের বিশৌনেন হওয়াটা তাই খুবই যৌক্তিক। এখন অ্যাকিলিসকে নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা করা যাক।
অ্যাকিলিসের জন্ম থেসেলিতে, তার পিতার নাম পেলেয়ুস, মাতার নাম থেটিস। অ্যাকিলিসের জন্ম নিয়ে বিশাল একটা কাহিনী আছে। সংক্ষেপে বর্ণনা করছি:
অ্যাকিলিসের মা থেটিস ছিল একজন সমুদ্রদেবী। প্রধান দুই দেবতা জিউস আর পোসাইডন দুজনেই থেটিসের পাণিপ্রার্থী ছিল। কিন্তু ভবিষ্যৎবাণী আসে যে থেটিসের গর্ভে জন্মানো সন্তান তার পিতার চেয়েও শক্তিশালী হবে। তাই ক্ষমতা হারানোর ভয়ে দুজনেই পিছিয়ে আসে। থেসেলির শাসক বীর পেলেয়ুসের সাথে থেটিসের বিয়ে ঠিক করা হয়। বলা যায় এই বিয়েতে ঘটিকালির কাজটা কেইরনই করেন। এখানেও একটা বিশাল কাহিনী আছে তবে সেটা অন্যদিনের জন্য তোলা থাকুক। তো এভাবে জন্মের আগেই অ্যাকিলিসের সাথে কেইরনের একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়।
বিখ্যাত ‘অ্যাকিলিস হিল’ প্রসঙ্গে আসা যাক। মানুষ হওয়ার পরও অ্যাকিলিস প্রায় অমর ছিলেন, শুধুমাত্র বাম পায়ের গোড়ালিই তার একমাত্র মরণশীল জায়গা ছিল। ‘অ্যাকিলিস হিল’ তৈরি হওয়া নিয়ে দুটো কাহিনী প্রচলিত:
১। থেটিস সমুদ্রদেবী হওয়ায় পাতালের নদী স্টিক্সের অবস্থান জানতেন। শিশু অ্যাকিলিসকে তিনি সেই নদীর পানিতে গোসল করাতেন নিয়মিত। শিশু অ্যাকিলিসকে বাম পায়ে ধরে উল্টো করে স্টিক্সের পানিতে ডোবানো হত। ফলে অ্যাকিলিসের সারা দেহই অমর হয়ে যায়। পায়ের গোড়ালি হাতে ধরা থাকতো বলে সেই স্থানে পানি লাগে নি। এ কারণেই বাম পায়ের গোড়ালিই অ্যাকিলিসের একমাত্র দুর্বল জায়গা ছিল। এই কাহিনীটিই সবচেয়ে জনপ্রিয়।

২। অন্য আরেকটি কাহিনী অনুসারে থেটিস নিজ পুত্রের সারাদেহ অ্যামব্রোসিয়া (দেবতাদের খাদ্য- সহজ ভাষায় অমৃত) দ্বারা আবৃত করে অ্যাকিলিসের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। এর ফলে অ্যাকিলিসের ভেতরের মরণশীল অংশ পুড়ে যায়। পেলেয়ুস এই ঘটনা দেখতে পেরে নিজ স্ত্রীকে বাঁধা দেন। অ্যাকিলিসের বাম পা শুধুমাত্র আগুনের স্পর্শ পায় নি তাই এই জায়গাটাই তার একমাত্র মরণশীল জায়গা হিসেবে রয়ে যায়। পেলেয়ুস বাঁধা দেওয়ায় থেটিস ক্রোধান্বিত হয়ে পরিবার ত্যাগ করেন এবং সমুদ্রে চলে যান।
‘অ্যাকিলিস হিল’ প্রবাদটি দিয়ে এখন কোন শক্তিশালী জিনিসের দুর্বল জায়গাকে ইঙ্গিত করা হয়।
কেইরনের কাছে অ্যাকিলিসের শিক্ষা গ্রহণের প্রসঙ্গে আসা যাক। হোমারের ‘ইলিয়াডে’ এ প্রসঙ্গে কোন তথ্য নেই। কবি Statius এর কাব্য ‘অ্যাকিলিডে’ এ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ আছে।
অ্যাকিলিসের পিতা পেলেয়ুস নিজেই কেইরনের ছাত্র ছিলেন। থেটিস চলে যাওয়ার পর পেলেয়ুস নিজের ছেলেকে সঠিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য কেইরনের কাছে নিয়ে আসেন। কেইরনের কাছে অ্যাকিলিস নয় বছর অধ্যয়ন করেন। কেইরন অ্যাকিলিসকে তলোয়ারবিদ্যা, রথচালনা, বর্শাচালনা, তীরন্দাজি সহ যুদ্ধবিদ্যার সকল শাখায় পারদর্শী করে তোলেন। হিলিং মেডিসিনেও অ্যাকিলিস তার কাছ থেকে বিশেষ জ্ঞান লাভ করেন যা ট্রোজান যুদ্ধে কাজে এসেছিল। শরীর সম্পর্কিত এসব বিদ্যা ছাড়াও সুস্থ মানসিকতা তৈরির শিক্ষাও তিনি কেইরনের কাছে পান। অ্যাকিলিসের ভাষ্যে,
“তিনিই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ন্যায়ের ধারণার সাথে।” (অ্যাকিলিড- 2.163-4).

এইসব শিক্ষা কোন আরামদায়ক উপায়ে আসে নি। কেইরন অ্যাকিলিসকে সিংহের নাঁড়িভুঁড়ি, স্ত্রী নেকড়ের মজ্জা ও বন্য শুয়োরের মাংস খাওয়াতেন। এই ভয়ানক খাদ্যাভাসের সাথে চলতো কঠোর সাধনা। দয়ালু হলেও বকাঝকার বেলায় কেইরন কোন কার্পণ্য করতেন না। অ্যাকিলিসের ভাষ্যে,
“আমি শক্তভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম কিন্তু নদীর প্রবল স্রোত আর তার ক্রমাগত তাড়া দেওয়ার কারণে আমি নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছিলাম। তিনি আমাকে ভয়ানক হুমকি দিলেন এবং বকাঝকা করে ধুয়ে দিলেন। আমি ভয়ে জায়গা ছেড়ে নড়তে পারলাম না।” (অ্যাকিলিড- 2.146-150).

এইধরণের অম্লমধুর আচরণের কারণে অ্যাকিলিস আর কেইরনের সম্পর্কটা ছাত্র-শিক্ষকের গণ্ডি পেরিয়ে অনেকটা পিতা-পুত্রের মত হয়ে যায়। অ্যাকিলিস কয়েকবার কাব্যে কেইরনকে পিতৃস্থানীয় হিসেবে উল্লেখ করেন। কেইরন যখন অ্যাকিলিসকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন তখন অ্যাকিলিস তাকে পিতা হিসেবেই মনে করতেন। এক সন্ধ্যায় থেটিস তাকে দেখার জন্য কেইরনের আস্তানায় আসলে অ্যাকিলিস মাকে ছেড়ে কেইরনের উপরেই গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকে। কবির ভাষ্যে:
“রাত গভীর থেকে গভীরতর হয়। দীর্ঘদেহী সেন্টর পাথরের উপর এলিয়ে পড়েন আর ছোট্ট অ্যাকিলিস তার কাঁধে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়ে। যদিও তার মা এখানেই আছেন কিন্তু অ্যাকিলিসের কাছে পারিবারিক টানের চেয়ে এটাই বেশী পছন্দনীয়।” (অ্যাকিলিড- 1.195-97).
এখানে কেইরনকেও কোন সেন্টর মনে হচ্ছে না। কেইরনের দেহ পশুর হলেও অন্তরে যে কোন পশুত্ব নেই তা এখান থেকে বোঝা যায়। দয়ালু কেইরন এর এই ভালবাসা অ্যাপোক্রাইফায় কেইরনের মাস্টার ফিয়োরেও পেয়েছে। আমি খুব আবেগান্বিত হয়ে গিয়েছিলাম যখন কেইরন, ফিয়োরের হাতের উল্টোপিঠে চুমু খেয়ে বিদায় নেয়।

অ্যাকিলিসে ফেরা যাক। প্রশিক্ষণ শেষে অ্যাকিলিস নিজ রাজ্যে ফিরে আসে। গ্রীসের সবচেয়ে সুন্দরী নারী হেলেনের স্বয়ংবর সভায় অ্যাকিলিসও অংশ নেয়। পরে হেলেন, প্যারিস কর্তৃক ট্রয় নগরীতে অপহৃত হলে অন্যান্য বীরদের মত অ্যাকিলিসও ট্রয় অভিযানে যোগ দেন। যুদ্ধে যাওয়ার পূর্বে মা থেটিস অ্যাকিলিসের সাথে দেখা করেন। থেটিস বলেন যে দেবতার আশীর্বাদে তিনি অ্যাকিলিসের জন্য দুটো গন্তব্য নিয়ে এসেছেন:
১। অ্যাকিলিস কোন যুদ্ধে যোগদান করতে পারবে না। তবে এর বিনিময়ে অ্যাকিলিস একটি দীর্ঘ, সুখী জীবন পাবে।
২। যুদ্ধে যোগদান করলে অ্যাকিলিস অনেক বড় বীর হবে কিন্তু বেশীদিন বাঁচতে পারবে না।
রোমাঞ্চপ্রিয় অ্যাকিলিস দ্বিতীয় জীবনটাই বেছে নেন। ৫০ জাহাজ বোঝাই ২৫০০ সৈনিক নিয়ে অ্যাকিলিস ট্রয় অভিমুখে যাত্রা করেন। অ্যাকিলিসের বাহিনীর সৈন্যদের মিরমিডিয়ন বলা হয়। (মিরমিডিয়নরা আগে পিঁপড়া ছিল)
এরপরের কাহিনী সবার জানা। যুদ্ধের সবচেয়ে আলোচিত চরিত্র ছিল অ্যাকিলিস। ট্রয়ের সবচেয়ে বড় বীর হেক্টরকে পরাজিত করে অ্যাকিলিস। অবশেষে দেবতা অ্যাপোলোর পথনির্দেশনায় কাপুরুষ প্যারিসের তীর আঘাত করে অ্যাকিলিসের বাম পায়ের গোড়ালিতে। অ্যাকিলিস সেখানেই মারা যান। বন্ধু প্যাট্রোক্লাসের ছাইয়ের সাথে তার ছাই মিশিয়ে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।

এনিমেতে অ্যাকিলিসের দুটো নোবেল ফ্যান্টাজম দেখা গেছে। দুটোই কিছুটা রিয়েলিটি মার্বেল ঘরানার। Diatrekhōn Astēr Lonkhē অ্যাকিলিস ব্যবহার করেছিল কেইরনের বিপক্ষের ফাইটে। প্রতিপক্ষের পেছনে বর্শা ছুঁড়ে মেরে এটা অ্যাক্টিভেট করতে হয়। মজার ব্যাপার হল এই বর্শাটা কেইরন তৈরি করে পেলেয়ুসকে দিয়েছিলেন, পেলেয়ুস পরে নিজ পুত্রকে উপহার দেন। বর্শাটি কেইরনের বাসস্থান মাউন্ট পেলিয়নের গাছ থেকে তৈরি।
Akhilleus Kosmos নোবেল ফ্যান্টাজমটা অ্যাস্টোলফো অসাধারণভাবে ব্যবহার করেছিল কর্ণের বিপক্ষে। দুর্দান্ত এই নোবেল ফ্যান্টাজমের পেছনেও একটা কাহিনী আছে। মনে হয় সবাই কাহিনীটা জানেন তারপরও বলি:
ট্রয়ের যুদ্ধের এক পর্যায়ে অ্যাকিলিস যুদ্ধ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে গ্রীক বাহিনী পর্যদুস্ত হয়ে পড়ে। অ্যাকিলিসের বন্ধুবর প্যাট্রোক্লাস তাই অ্যাকিলিসের বর্ম আর ঢাল ধার নিয়ে যুদ্ধে নেমে পড়ে। সবাই ভাবে অ্যাকিলিস নিজেই যুদ্ধে নেমে এসেছে তাই গ্রীক বাহিনী তার হারানো উদ্যম ফিরে পায়। সারাদিন বীরের মত যুদ্ধ করলেও ট্রোজান বীর হেক্টরের হাতে প্যাট্রোক্লাস নিহত হয়। হেক্টর, প্যাট্রোক্লাসের গা থেকে বর্ম আর ঢাল খুলে নিজের কাছে রেখে দেয়।
প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর অ্যাকিলিস যেন আগ্নেয়গিরি হয়ে উঠে। লৌহশিল্প ও অগ্নির দেবতা হেফাস্টাস, অ্যাকিলিসকে নতুন একটা ঢাল বানিয়ে দেন। এটাই সেই বিখ্যাত ‘অ্যাকিলিস শিল্ড’। ঢালটি অপূর্ব কারুকার্যময় ছিল। হোমার তাঁর ইলিয়াডের আঠারো নাম্বার অধ্যায়ে প্রায় ১০০ শ্লোক ধরে এই ঢালের গায়ে আঁকা কারুকাজের বর্ণনা করেন। ঢালটিতে গ্রীক নগর সভ্যতার একটা মিনিয়েচার আঁকা ছিল। তাই অ্যাকিলিসের নোবেল ফ্যান্টাজমে আমরা একটা গ্রীক সভ্যতার অনুরূপ রিয়েলিটি মার্বেল দেখি। এই জায়গায় হিগাশিদার কল্পনাশক্তির তারিফ করতেই হবে, A-1 পিকচারসও দুর্দান্ত ফ্লুয়িড অ্যানিমেশন ঢেলেছে। ভাসাবি শক্তিকে প্রতিহত করার জায়গাটা চমৎকার ছিল। এইসব ছোটখাটো ডিটেইলের জন্য অ্যাপোক্রাইফার ২২ নম্বর পর্ব স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

অ্যাকিলিসের একটি মাত্র সন্তানই ছিল। সেই ছেলের নাম ছিল নিওপতেলেমাস। নিওপতেলেমাস পরে ‘অ্যাকিলিস শিল্ডের’ মালিক হয়। ট্রয় যুদ্ধের পরে আগামেমননের ছেলে ওরেস্তেসের হাতে নিওপতেলেমাস নিহত হয়। বাবা-ছেলে দুজনের মৃত্যুই ট্র্যাজিক।
গুরু কেইরনের মৃত্যুও আর দশজনের মত হয় নি। টাইটানের ঘরে জন্ম নেওয়ার কারণে কেইরন অমর ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত নিজের ছাত্র হেরাক্লসের কারণেই কেইরন মারা পড়ে। হেরাক্লস একবার গুরুর আস্তানায় ওয়াইনের বোতল খুললে সেই ওয়াইনের গন্ধে মদ্যপ সেন্টররা ভীষণ গোলমাল শুরু করে। এক পর্যায়ে মারামারি শুরু হয়ে যায় এবং তাদের থামানোর জন্য হেরাক্লস হাইড্রার রক্তমাখা তীর ছুঁড়তে থাকেন। কেইরন তখন কী গোলমাল হল তা দেখার জন্য নিজের আস্তানার দিকে যাচ্ছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত একটা রক্তমাখা তীর কেইরনের গায়ে এসে লাগে।
কেইরন যিনি কিনা নিজে ঔষধ নির্মাণে ওস্তাদ, নিজ ব্যথার কোন ঔষধ তৈরি করতে পারছিলেন না। হাইড্রার রক্ত অব্যর্থ বিষ, দেহে স্পর্শ হলেই মৃত্যু নিশ্চিত। অমর হওয়ায় কেইরনের মৃত্যু হচ্ছিল না কিন্তু অসহনীয় যন্ত্রণা ঠিকই পাচ্ছিলেন। যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অবশেষে তিনি নিজের অমরত্ব সরিয়ে নেওয়ার প্রার্থনা জানান দেবতাদের কাছে। তার সৎ ভাই জিউস এই প্রার্থনা মঞ্জুর করেন এবং কেইরনকে আকাশের একটা নক্ষত্রপুঞ্জ বানিয়ে দেন। সেই নক্ষত্রপুঞ্জটিই Sagittarius বা ধনু নামে পরিচিত। দেখলে মনে হয় কোন সেন্টর হাতে তীর-ধনুক তাক করে রেখেছে।
কেইরনের নোবেল ফ্যান্টাজম ‘Antares Snipe’ এর আন্তারেস শব্দটি একটি নক্ষত্রকে নির্দেশ করে। নক্ষত্রটি স্যাজিটেরিয়াসের পাশের স্করপিয়াস নক্ষত্রপুঞ্জে অবস্থিত। স্যাজিটেরিয়াসের দিকে তাকালে মনে হয় এর ডান দিকের শেষ প্রান্ত অর্থাৎ ধনুক সামনের ‘আন্তারেসের’ দিকে তাক করা আছে। এজন্যই কেইরনের নোবেল ফ্যান্টাজম সবসময়ই চালু থাকে।
২১ পর্বে কেইরন আর অ্যাকিলিস নিজেদের মধ্যে যে মার্শাল আর্টসটা চর্চা করেছিল সেটার নাম Pankration. প্যানক্রেইশন সর্বাধিক প্রাচীন মার্শাল আর্ট হিসেবে স্বীকৃত। প্যানক্রেইশনের নির্দিষ্ট কোন নিয়ম ও টাইম লিমিট ছিল না। বক্সিই, রেসলিং, কিকিং, সাবমিশন হোল্ডিং সবকিছুই গ্রহণযোগ্য ছিল, একমাত্র নিষিদ্ধ ছিল প্রতিপক্ষের চোখ খোঁচানো ও কামড়াকামড়ি। লড়াইয়ে অনেক সময়ই অংশগ্রহণকারীদের মৃত্যু হত।

প্রাচীন অলিম্পিকে প্যানক্রেইশন একটা ডিসিপ্লিন হিসেবে ছিল। তবে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দ থেকেই গ্রীসে প্যানক্রেইশন চর্চা হয়ে আসছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায়। স্পার্টান সেনাবাহিনী এবং আলেকজান্ডারের সৈন্যরা প্যানক্রেইশনে দক্ষ ছিল। আলেকজান্ডারের পিতা ফিলিপের প্যানক্রেইশনে অংশ নেয়ার নজির আছে।
মিথলজিতে হেরাক্লস ও থিসিয়াসকে প্যানক্রেইশনের আবিষ্কারক হিসেবে পাওয়া যায়। কেইরনই সম্ভবত ঐ সময়েই প্যানক্রেইশন শেখেন তারপর অ্যাকিলিসকে সেই বিদ্যায় দক্ষ করে তোলেন। আধুনিক যুগে আবার প্যানক্রেইশনের পুনর্জন্ম ঘটেছে। ইউটিউবে বেশ কিছু ভিডিও দেখেছিলাম। নিয়ম-কানুনের কারণে এখন মরণের গন্ধ নেই খেলাটাতে। কেইরন ভার্সাস অ্যাকিলিস পর্যায়ের ভয়ানক গতিময় জিনিসের ছিটেফোঁটাও নেই। তবে এরপরও বেশ উপভোগ্য একটা মিক্সড মার্শাল আর্টস হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ডিসিপ্লিনটা।
(Now just imagine a pankration match between Iskander and Achilles. Also imagine Iskander performing a submission hold on our lovely Gilgamesh.
)
বিশেষ দ্রষ্টব্য: একটা মতবাদ আছে, আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের সময় প্যানক্রেইশন ভারতে প্রবেশ করে। পরে ভারত ঘুরে এই প্যানক্রেইশনই দূরপ্রাচ্যে গিয়ে কুংফু-যুযুৎসুতে পরিণত হয়েছে। কুংফুর প্রচারক বোধিধর্মাকে ‘নীল চোখের দানব’ হিসেবে অভিহিত করা হত। হতে পারে তিনি আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনীর লোক ছিলেন, পরে ভারতবর্ষে থেকে যান। (মতবাদটি অতটা শক্তিশালী নয়)
অ্যাকিলিস আর কেইরনের সম্পর্ক প্রাচীন ভারতের গুরু-শিষ্যদের নিয়ে যেসব কিংবদন্তী রয়েছে তার সমতুল্য। ভারতীয় পুরাণে ছাত্রকে শিক্ষকের আস্তানায় অবস্থান নিয়ে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নানা বিষয়ে দীক্ষিত হতে দেখা যায়। অ্যাকিলিসও সেই প্রক্রিয়া পার হয়ে এসেছে। অ্যাকিলিসের জীবনে কেইরনের ভূমিকা পিতার চেয়ে কোন অংশ কম নয়। এজন্যই অ্যাপোক্রাইফা শুরু হওয়ার পর আমি সবচেয়ে বেশী হাইপড ছিলাম এই দুইজনকে নিয়ে। অ্যাকিলিস জানতো যে ব্ল্যাক ফ্যাকশনের কেউ তাকে ঠেকাতে পারবে না। আর্চার অফ ব্ল্যাকের পরিচয় জানার পর অ্যাকিলিসের সেই আত্মবিশ্বাস অনেক কমে যায়। কারণ অ্যাকিলিসের সকল কৌশল কেইরনের চেয়ে ভাল কেউ জানে না। কেইরনও নিজ শিষ্যের উন্নতি কেমন হয়েছে তা দেখার জন্য মুখিয়ে ছিলেন। অ্যাকিলিস নিজের যুদ্ধলব্ধ বিদ্যা দিয়ে কেইরনকে হতাশ করে নি। পরাজিত হয়ে কেইরন নিজেই আসলে জয়ী হলেন। এই জয় মহান শিক্ষকব্রতের জয়। এনিমের একটা বড় অংশে দুইজনের দ্বন্দ্বকে একটুও ফোকাস করা হয় নি, তবে সব পুষিয়ে দিয়েছে একটা পর্বই। ইডিওলজিকাল কোন ক্ল্যাশ না থাকার পরও শুধুমাত্র দুর্দান্ত একটা অতীতের জোরে দুজনের মধ্যের লড়াইটা চমৎকারিত্ব পেয়েছে। অ্যাকিলিস ‘গুরু মারা বিদ্যা’ প্রয়োগ করলেও আন্তারেস স্নাইপের মাধ্যমে কেইরন দেখিয়ে দিলেন যে ‘ওস্তাদের মার শেষ রাতে”। ![]()
রেফারেন্স:
- britannica.com
- greekmythology.com
- history.com
- Percy Jackson and Greek Gods- Rick Riordan
- গ্রীক বীরদের আখ্যান- রজার ল্যান্সেলিন গ্রীন
- মিথলজি- এডিথ হ্যামিল্টন
- Wikipedia




