একটা ভালো অ্যাডাপ্টেশন হওয়ার জন্য কী প্রয়োজন? অনেক বেশি সংখ্যক অ্যানিমে ফ্যান, এবং সামগ্রিকভাবেই ভিজুয়াল ফিকশনের ফ্যানরাই ভালো অ্যাডাপ্টেশন বলতে সম্ভবত বুঝে তার সোর্স ম্যাটেরিয়ালকে পুরোপুরিভাবে অনুসরণ করাকে। কিন্তু সেটা কি তার গল্প বলায় একটা সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করে না? কারণ শেষ পর্যন্ত, “অ্যাডাপ্টেশন” মানেই তো নতুন পরিস্থীতি, নতুন মাধ্যমের সাথে মানিয়ে নেওয়া – গল্পের বিন্যাস, কাঠামো আর বর্ণনা পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে হলেও। কারণ, অবশ্যই, বইয়ের পাতার লেখার মাধ্যমে গল্প বলা, আর টেলিভিশন, সিনেমার পর্দায় ছবি আর শব্দের মিলনে তা বলার মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য আছে। একই সাথে পার্থক্য আছে, আসলেই গল্প “বলাতে”, এবং তা কেবল “দেখানো”-র মাঝেও। ছবি আর শব্দের মেলবন্ধন – আর তা যদি ভালোভাবে ব্যবহার করা যায়, অ্যানিমেশনের সম্ভাবনা অসীম, তৈরি হয় আসলেই ত্রিমাত্রিক অনুভূতির এক জগৎ। কিন্তু অবশ্যই এক্ষেত্রে গল্প বলার ক্ষেত্রে পরিচালকের কল্পনাশক্তির প্রাচুর্য্য থাকা জরুরী, যেহেতু ছবি এবং শব্দের উপস্থিতি দর্শকদের নিজেদের কল্পনাশক্তি ব্যবহারের সুযোগ অনেকাংশে কেড়ে নিচ্ছে। এবং এটা আরো বিশেষভাবে, যখন একটা উপন্যাসকে অ্যাডাপ্ট করা হয়। কারণ এখানে মাঙ্গার মত আর চরিত্রদের চেহারা, তাদের অঙ্গভঙ্গি কিংবা তাদের আশেপাশের জায়গাগুলোর টেমপ্লেট আগে থেকেই দেওয়া থাকেনা। পুরোপুরিই পরিচালকের নিজের ইন্টারপ্রেটেশনের উপর নির্ভর করে। একজন পরিচালকের প্রতিভার পরিচায়ক তো কেবল সুন্দর কোন গল্প বলাতে নয়, কোন গল্পকে সুন্দরভাবে বলাতেই!
এখানে আর বাকি সব কিয়োঅ্যানির অ্যানিমের মত সুন্দর অ্যানিমেশন আর ভিজুয়াল উপস্থিত, হয়তো মাঝে মাঝে তুলনামূলক কম ভালোও। কিন্তু Hibike-’র শক্তি বরং এর গল্পবর্ণনায়। এর মূল গল্প বড় এক নভেল সিরিজ থেকে নেওয়া, একারণে গল্প আর চরিত্র – উভয়ের গভীরতাই তুলনামূলক বেশি। কিন্তু এই কারণেই বরং তার পুরোটা টিভির পর্দায় ফুটিয়ে তোলা আরো অনেক, অনেক বেশি কঠিন! কিয়োঅ্যানির ফ্ল্যাগশিপ পরিচালক তাৎসুইয়া ইশিদার কাছ থেকে আসায় যদিও এর সাফল্য নিয়ে আশাবাদী হওয়াটা যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু তার পরও, ইশিদার বাকি সব অ্যানিমের চেয়ে Hibike আলাদা। Air, Clannad, Haruhi -‘র মত Hibike-তে বড় এনসাম্বলের কাস্ট থাকলেও, এর গল্প অনেক বেশি কানেক্টেড, কমপ্যাক্ট…বাস্তবিক! ফ্যান্টাসি জনরা গায়ে না লেগে থাকা একটা বড় কারণ, কিন্তু এটা বাদ দিলেও Hibike-’র প্রতিযোগীতা, সাফল্য আর ব্যর্থতার গল্প পরিচিত। গল্পবর্ণতাতে আছে আলাদা একটা নিজস্বতা। কেবল “দেখানো”-তেই সীমাবদ্ধ না, Hibike তার গল্পের বড় একটা অংশ “বলে” তার ভিজুয়াল দিয়ে।
“ক্যামেরা”-’র ব্যবহারটাই চিন্তা করা যাক, Hibike-তে ফোকাসিংকে কাজে লাগানো হয়েছে শিল্পের পর্যায়ে। পুরোটা সময় ঘোলাটে ব্যাকগ্রাউন্ড আর চরিত্রদের চেহারার উপর পূর্ণাঙ্গ ফোকাসই বলে দিবে মনোযোগটা কোথায় রাখা জরুরী। কিয়োঅ্যানিমের আর বাকি সব অ্যানিমে থেকেও তো একে এই এক বিষয় দিয়ে আলাদা করা যায়! কুমিকো গল্পের ন্যারেটর, তার স্বগোক্তিতেই সব বলা, প্রতি পর্ব শুরু আর শেষও তা দিয়ে। তার মাথার ভেতর, বিক্ষিপ্ত চিন্তাভাবনা আর স্মৃতি, কুইক-কাট ট্রানজিশনে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে নিয়ে যায়। কুমিকো যদিও বেশিরভাগ সময়ই আশেপাশে চলমান ঘটনার পার্শ্বচরিত্র; প্রভাবক, নীরব দর্শক আর গুপ্ততথ্যের রক্ষক। She sees everything and she understands. একজন ওয়ালফ্লাওয়ার! যার জন্য উপন্যাসের পাতা ভর্তি লেখা প্রয়োজন, তার জন্য এখানে একটি শব্দেরও প্রয়োজন হয় না; চরিত্রদের মুখের অভিব্যক্তি আর প্রতিক্রিয়া অনুসরণ করলেই হবে। নো-ওয়েইস্টেড-শট!
দ্বিতীয় সিজনের তৃতীয় পর্ব এর একটি ভালো উদাহরণ। এই পর্বের শুরুটা কুমিকোর মনোলোগ দিয়ে, কানসাই কম্পিটিশনের আগে শেষ প্রস্ততি পর্ব। কুমিকো আর আসুকার ছোট কথোপকথনের পরবর্তী ৩ঃ১৬-৩ঃ১৬ এ তিন সেকেন্ডের ট্রানজিশন, আর তার সাথে সাথে কুমিকোর এক্সপ্রেশন, সম্পূর্ণ ভিন্ন দুইটি সময় আর জায়গার মধ্যে সংযুক্তি। কোন এবরাপ্ট কাট না যেটা গল্পের গতি নষ্ট করে দিবে, অথবা কোন দীর্ঘায়িত অপ্রয়োজনীয় শট না, বরং দুটো একত্রে মিলিয়ে দেওয়া, গল্পের প্রবাহ বজায় রাখার জন্য! অথবা তার পরবর্তী দৃশ্য, আসল পারফর্মেন্সের আগে শেষবারের মত সব পারফর্মারদের একসাথে থাকা শেষ দৃশ্য। নিয়ামা আর হাশিমোতো-সেনসেই এর বিদায়ী ভাষন, উপদেশ। ক্যামেরা একজনের থেকে আরেকজনের পারস্পেকটিভে বদলাতে থাকে অনবরত, কার কোন কোন দূর্বলতা জানান দেয়, এবং তার সাথে সাথে পারফর্মারদের প্রতিক্রিয়া। কুমিকোর চেহারার অবিশ্বাস, আনন্দ, ভয় এবং একই সাথে অস্থিরতা ইউফোনিয়াম সোলোর অংশ হওয়ার খবর পাওয়ায়, রেইনার সন্তুষ্টির অভিব্যক্তি। কিংবা ইয়োরোইযুকার চোখে হাতের ওবোর দিকে স্থির, রোবোটিক দৃষ্টি, যখন হাশিমোতো তাকে যান্ত্রিকভাবে বাজানো বাদ দিয়ে আরো বেশি “এক্সপ্রেসিভ” হওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু তার জন্য তো “এক্সপ্রেস” করা সব সময়ই কষ্টকর ছিলো, সংগীত কিংবা শব্দ দিয়েও। তা তার গতবাঁধা জবাবেই আটকানো, “I’ll try to do better.” ব্যাকগ্রাউন্ড ফোকাসে ইউকোর চেহারায় অনিশ্চয়তা! প্রিয় মানুষের জন্য!
গল্পটা কুমিকোর মাথার ভেতরে, তাই তো সবকিছু সামনে থেকে দেখা হয় না। রেইনা যখন তাকি-সেনসেইকে নিয়ামা-সেনসেইয়ের সাথে তার সম্পর্কের কথা জানতে চেয়ে প্রশ্ন করে, আগুনের অপর পাশে। তাদের কথা শোনা যায় না, পর্দায় কেবল দূর থেকে রেইনা আর তাকির শব্দহীন অভিব্যক্তি। কিন্তু অবশ্যই Hibike এই মুহূর্তটা অপচয় করবে না। বরং এপাশে সমান্তরালে হাশিমোতো-সেনসেইয়ের সাথে কুমিকোর কথোপকথন চলতে থাকে। তাকি-সেনসেই এরই অতীত নিয়ে! একই সাথে শব্দ আর ছবি দিয়ে দুটো আলাদা গল্প বলা! কনসার্টেশনে, কোনভাবেই ইনফরমেশনের ওভারফ্লো না, ইকোনমিক! কিংবা আসুকাকে আঁকড়ে ধরা নস্টালজিয়ার প্রতিটি মুহূর্ত, হাইস্কুলের শেষ বছরে এসে। যদিও তা মুখ ফুটে কেবল বেরোয় না সরাসরি। ক্লাবকে আগলে রাখার প্রতিটি চেষ্টায়, প্রতিটি ধাপ পেরোনোর আনন্দের বিহবল হওয়ার পরবর্তী নীরবতায়, অবশ্যম্ভাবী বিদায়ের কথা মনে পড়ায়, গ্রাস করা বিষাদ ঠিকড়ে বেরোয় তার হাসির পেছন থেকে, আর যখন সে বলে, “I wish this summer would never end”।
কিন্তু সবচেয়ে বড় উদাহরণ অবশ্যই এর পারফর্মেন্সের দৃশ্যগুলো! মিউজিক অ্যানিমের সাফল্যের জন্য তো অসাধারণ সঙ্গীতেরই দরকার সবার আগে! Hibike এইক্ষেত্রে বরং Showa Genroku-’র সাথে তুলনীয়। Hibike-’র সঙ্গীতের বিচারক দর্শক নিজেরাই! কোন শর্টকাট না, এমনকি ৮ মিনিটের লম্বা পারফর্মেন্সেও! প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি বিট অ্যানিমেটেড। আর মনে রাখার মত ব্যাপার, অন্যান্য আর বেশিরভাগ অ্যানিমের মত Hibike-’র সঙ্গীত একক পরিবেশনা না, দলীয়! কন্ডাকটরের হাতের নির্দেশনা, প্রতিটি পারফর্মারের চলমান হাত অথবা মুখ, অথবা দুটোই, সঙ্গীতের সাথে মূর্ছনায়; নড়তে থাকা, সামনে, ব্যাকগ্রাউন্ডে একসাথে; ট্রামবোন, ট্রামপেট, টিউবা, ক্ল্যারিনেট, হর্ন, ট্রিমপানি, চাইম, টামবুরিন, ওবো, ফ্লুট, বেস, ইউফোনিয়াম! একসাথে চলতে থাকা! কোন স্ট্যাটিক শট না! আবার যখন রেইনার সোলোর দৃশ্য আসে, তখন পর্দায় রেইনার কল্পনায় ভেসে স্টেজ আর পাহাড়ের কিনারায় মিশে এক হয় কুমিকোর সাথে ফেস্টিভালের সেই রাতের দৃশ্য, কারণ এই পারফর্মেন্স তো তার জন্যই! অথবা ইয়োরোইযুকার কল্পনায় নোজোমি। কাওশিমার সামনে রাখা স্ট্যান্ডে বন্ধুদের সাথে তার ছবি। তাকি-সেনসেইয়ের সামনে তার স্ত্রীর। সবারই আলাদা আলাদা গল্প!
সামনে বসে থাকা দর্শকরা ফোকাসের বাইরে, পেছনে ব্যাকস্ট্যাজে বন্ধুদের বিচলিত পায়ের নড়াচড়া কেবল। আর এই দূর্দান্ত পরিবেশনার পরের দৃশ্যটাই কী? প্রথমে সবার হাঁপাতে থাকা চেহারা, বন্ধুদের কান্নার দৃশ্য, আর সবার শেষে দর্শকদের করতালি। আর তা ক্ষীন হতে হতে সরাসরি এন্ড ক্রেডিট। কারণ শেষ পর্যন্ত এটা তো তা-ই ছিলো, যা উপন্যাসের পাতায় কখনোই বোঝানো সম্ভব না, পাতার পর পাতা বাক্য দিয়ে ভরে ফেললেও, একইসাথে শব্দ আর চিত্রের পরিবেশনায়ঃ শ্বাসরুদ্ধ, চিত্তসম্মোহিত আর হতবিহবল করা।
নো-ওয়েইস্টেড-শট!